মুহিউদ্দীন মুহাম্মাদ আনিছ
বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন, ইসলামী চিন্তাবিদ, অবিসংবাদিত রাজনীতিবিদ ও নিবেদিত সমাজসেবক মাওলানা শাহ্ মুহাম্মাদ বেদারুল আলম রহ. ১৯৫৮ ঈ. সনে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার রুহুল−াহ্্পুর গ্রামের বিখ্যাত জমিদার খান্দান ‘কাযী’ বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী ব্যক্তিত্ব, কুত্বুল ইরশাদ, মুহ্তামিমে আযম হাকীমুন নাফ্স আল−ামা শাহ্ আবদুল ওয়াহহাব রহ.। মাতার নাম মরহুমা মুসাম্মাৎ ছকিনা বেগম। তার বংশ পরিক্রমা- মুহাম্মাদ বেদারুল আলম বিন আবদুল ওয়াহহাব বিন আবদুল হাকীম বিন আফী উদ্দীন বিন আসয়াদ আলী বিন নাসির উদ্দীন ইস্পাহানী রহ.। ইরানের ইস্পাহান নগরীর অধিবাসী কাযী নাসির উদ্দীন রহ. ছিলেন শাহ্ ওয়ালীউলাহ্ মুহাদ্দিস দেহলভী রহ.’র সমসাময়িক। পরে দ্বীন প্রচারের নিমিত্তে স্বপরিবারে হিজরত করে প্রথমে মিয়ানমারের রেঙ্গুন শহরে আসেন। তথায় বেশ কয়েক বছর অবস্থান করার পর বাংলাদেশের সন্দ্বীপে এসে বসবাস শুরু করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁরই পুত্র কাযী আসয়াদ আলী হাটহাজারী থানার অন্তর্গত রুহুল−াহ্্পুর গ্রামে এসে স্থায়ী বসতি গড়ে তোলেন। স্বীয় বিজ্ঞ পিতার স্বযতœ তত্ত্বাবধানে পারিবারিক পরিবেশে তার প্রাথমিক শিক্ষা আরম্ভ হয়। ১৯৭১ সনে দারুল উলূম হাটহাজারীতে ভর্তি হন এবং এক নাগাড়ে এগার বছর অধ্যয়ন করে ১৯৮১ সনে এই জামিয়া হতে দাওরা-ই-হাদীস সম্পন্ন করেন। দাওরা-ই-হাদীস পাস করার পর তিনি দারুল উলূম হাটহাজারীতে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ লাভ করেন এবং আজীবন এই জামিয়ায় কাটিয়ে দেন। সমকালীন বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকবৃন্দের অন্যতম ছিলেন তিনি। এছাড়াও তিনি জামিয়ার অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিভাগের কাজ অত্যন্ত দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে আঞ্জাম দেন।
তিনি একজন রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি ছিলেন। ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশ নেযামে ইসলাম পার্টি ও ইসলামী ঐক্যজোট চট্টগ্রাম উত্তর জেলার সভাপতি, চারদলীয় জোট উত্তর জেলা হাটহাজারী থানার সমন্বয়কারী এবং ইসলামী দাওয়াতী কাফেলার উপদেষ্টাম-লীর অন্যতম সদস্যের দায়িত্ব ছাড়াও আরো বিভিন্ন সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ইসলামী আন্দোলনের কা-ারী ছিলেন। বিগত আওয়ামী সরকারের ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহী যে কোন কর্মকা-ের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামা-মাশায়েখ, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, গবেষক, সকল রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং মন্ত্রী, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সর্বস্তরের জনসাধারণের সাথে ছিল তাঁর অকৃত্রিম সুসম্পর্ক। তারা তার প্রতি শ্রদ্ধাময় ভালবাসা পোষণ করতেন।
রাজনীতি ছাড়াও বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কর্মকা-ের সাথে নিজেকে নিবিড়ভাবে জড়িত রেখেছিলেন। দেশ, জাতি, ইসলামের সেবা এবং দ্বীনী শিক্ষা সংস্কারের কাজে নিজেকে এমনভাবে উৎসর্গিত করেছেন, যার দৃষ্টান্ত বিরল। নিজ পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে সমাজকল্যাণমূলক কাজ করার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন মাওলানা শাহ্্ বেদারুল আলম রহ.। ১৯৯৫ সালে সম্পূর্ণ সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের সংগঠন স্বদেশ সংঘ, ১৯৯৯ সনে দারুল উলূম হাটহাজারীর শিক্ষকম-লীর কল্যাণ সমিতি নাজনাতুল আমানাহ্, গত শতাব্দীর শেষভাগে ব্যতিক্রমধর্মী হজ কাফেলা আল্লাহুম্মা আমীন, ১৯৯৮ সালে ইসলামিয়া আরাবিয়া তালীমুল কুরআন মাদরাসা, ১৯৯৯ সনে নিজ পৈতৃক জায়গায় খাদীজাতুল কুবরা রাযি. মহিলা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তারই পরামর্শ ও সার্বিক সহযোগিতায় ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে ইসলামী ও যুগোপযোগী শিক্ষার সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যাপীঠ আদর্শ ইসলামিক একাডেমী। অসংখ্য মাদরাসা তারই পরামর্শ ও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন মাদরাসার মজলিসে শূরা তথা সর্র্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। হাটহাজারী কাচারী রোডস্থ ‘সাব রেজিস্ট্রারী অফিস জামে মসজিদ’ স্থাপনে তিনি ছিলেন অগ্রগামী, যার সম্মানস্বরূপ তার অনীহা সত্ত্বেও মসজিদ পরিচালনা পরিষদ তাঁকে প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি পদে নির্বাচিত করে।
১৯৮২ সনে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সমাজসেবক ও ধর্মানুরাগী মরহুম মুহাম্মাদ আবদুল মান্নান সাহেবের তৃতীয়া কন্যার সহিত পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৯৯৫ সনে পবিত্র হজব্রত পালন করেন। আধ্যাত্মিক জীবনে তিনি হাকীমুল উম্মাত আলামা শাহ্ আশরাফ আলী থানভী রহ.’র সর্বশেষ খলীফা মাওলানা শাহ্ আবরারুল হক হারদুঈ রহ.’র পবিত্র হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। রাজনীতির অঙ্গনে তিনি খতীবে আযম মাওলানা সিদ্দীক আহমাদ রহ.’র আদর্শ ও কর্মনীতিকে অনুসরণ করে চলতেন।
তিনি উদারমনা, হৃদয়বান ও নম্রভাষী অথচ জালালী মেযাজের অধিকারী ছিলেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি স্বীয় বিজ্ঞ পিতা-মাতার অনুগত, বাধ্য, নম্র-ভদ্র এবং নিরহংকারী ছিলেন। অপরের দুঃখে দুঃখিত হওয়া ও অতিথিপরায়ণতা ছিল তাঁর একান্ত স্বভাব। ছোট-বড় সকলের সাথে হাসিমুখে কথা বলার ব্যাপারে তাঁর জুড়ি ছিল না। সাদাসিধে ও অনাড়¤¦র জীবনযাপনকে তিনি অত্যন্ত পছন্দ করতেন। লৌকিকতা ও তাকাল−ুফের ধারে-কাছেও ছিলেন না তিনি। সদা হাস্যোজ্জ্বল চেহারাওয়ালা, মিষ্টিভাষী শাহ্ সাহেব রহ. পর-আপন নির্বিশেষে সকলের প্রতি মানবতাসুুলভ আচরণ করতেন। অনেকে তার কাছে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আসতেন, তিনি তাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করতেন। কিন্তু কখনো ‘আমি পারবো না, আমার দ্বারা সম্ভব নয় বা আমার এখন সময় নেই’- এমন কথা বলতে তাকে শুনা যায়নি। কাউকে আর্থিক সহযোগিতা করতেন, কারো জন্য টেলিফোন করে বা চিঠির মাধ্যমে সুপারিশ করতেন, আবার পরামর্শ দিয়ে সান্ত¡না দিতেন। কখনো কাউকে নিরাশ করতেন না। একজন প্রভাবশালী সমাজপতি ও দাপুটে রাজনীতিবিদ হয়েও বিত্তের পাহাড় গড়ার স্বপ্ন তিনি কখনো দেখেননি। এমন করার বা করানোর বিন্দুসম ইচ্ছাও তার ছিল না। বস্তুত, মানুষের প্রতি মমত্ববোধ ও সুসম্পর্কটাই ছিল তার জীবনের অমূল্য পুঁজি।
মাওলানা শাহ্ বেদারুল আলম রহ. ছিলেন একাধারে দারুল উলূম হাটহাজারীর সিনিয়র উস্তাদ, যুগ সচেতন উন্নতস্তরের পরামর্শদাতা, সমাজের দরদী নেতৃত্বস্থানীয় পুরুষ ও আত্মত্যাগী সমাজসেবক। অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিবাদে ও চরমসংকটপূর্ণ মুহূর্তে সত্য কথা বলার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন রীতিমতো কিংবদন্তি। আজো সুধী ও সুশীল সমাজের মুখে মুখে তার বীরত্বপূর্ণ কীর্তিসমূহের কথা স্বরণ হতে দেখা যায়। তাঁর জীবনের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য দিক হলো- সুস্পষ্টবাদিতা, বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, মুখ ও অন্তরের মিল। অন্তরে যা আছে মুখেও তা উচ্চারণ করতে তিনি কোথাও দ্বিধাবোধ করতেন না, যা একজন খাঁটি ঈমানদারের পরিচয়। আজকের সমাজে এমন চিত্র বিরল। এখনকার অবস্থাতো অন্তরে ঘৃণাভাব আর মুখে যারপরনাই মুহাব্বাত, যা একজন মুনাফিকের আলামত।
তিনি ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০০৪ ঈ. বৃহস্পতিবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অসুস্থ থাকাকালীন অবস্থায় ৬ মার্চ ২০০৪ ঈ. শনিবার বিকেল ৩টা ১০ মিনিটে হাসপাতালের বেডেই ইহজগত ত্যাগ করে মহান আল্লাহ্্র দরবারে চলে যান। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজিউন। তার বয়স হয়েছিল ৪৬ বছর। তিনি স্ত্রী, ৬ ছেলে, ৩ মেয়ে, ছাত্র-ভক্ত ও আত্মীয়-স্বজনসহ অগণিত গুণগ্রাহী রেখে যান। সেদিনই রাত ৯টায় জানাযার নামাযের সময় ঘোষণা করা হয়। শুভাকাক্সক্ষীরা আসতে থাকে চতুর্দিক থেকে। চতুর্দিকে শত-সহস্র মানুষের ঢল। এতো অল্প সময়ে এ জনসমাগম সবাইকে হতবাক করে দেয়। এ বিপুল জনসমুদ্র তার ব্যাপক জনপ্রিয়তার সাক্ষ্য দেয়। জামিয়া প্রধান মাওলানা শাহ্ আহমাদ শফী দা.বা.’র ইমামতিতে লক্ষাধিক মুসলীর অংশগ্রহণে জামিয়া প্রাঙ্গণে জানাযার নামায সম্পন্ন হয়। জানাযা শেষে জামিয়ার বায়তুল আতীক জামে মসজিদ সংলগ্ন জামিয়ার আসাতিজায়ে কিরামের জন্য নির্ধারিত নতুন কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। এই কবরস্থানে এটিই প্রথম কবর। ইতিপূর্বে এখানে আর কাউকে দাফন করা হয়নি। তাই এই কবরস্থানকে ‘মাকবারায়ে বেদারিয়া’ বলা হয়। আমি ও আমরা তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং মহান আল্লাহ্র শাহী দরবারে ফরিয়াদ করছি, তিনি যেন তার এ প্রিয় বান্দাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করেন। আমীন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন