বিশেষ সংবাদদাতা : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির চরিত্রের কোনো বদল হয়নি। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-স্বজনদের নবগঠিত কমিটিতে স্থান দিয়ে বিষয়টি তারা পুরো জাতির কাছে স্পষ্ট করেছে। নতুন কমিটিতে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানদের থাকার প্রসঙ্গ তুলে দলটি (বিএনপি) বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে কি নাÑসে প্রশ্ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা বলেন, ৫০০ জনের একটা তালিকা দিয়ে তারা একটা কমিটি গঠন করেছে, যেখানে যুদ্ধাপরাধী, বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী, হত্যা, খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, বুদ্ধিজীবী হত্যার সাথে জড়িত, পাক হানাদারদের সহযোগিতা করার জন্য যাদের এই বাংলার মাটিতে বিচার হয়েছে, তাদেরকে রেখেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০১ সালের পর আপনারা দেখেছেন যে কী ঘটেছে, সকল ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষের ওপর এরা আক্রমণ করেছে এবং এদের চরিত্র একটুও বদলায়নি। তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন, যাদের বিচার হয়েছে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে, এদেরই ছেলেপেলে নিয়ে যদি কোনো দল গঠন করা হয়, তো সেই দল কি এদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, সে দল কি দেশের মানুষের জন্য শান্তি আনতে পারে?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বুধবার তার কার্যালয়ে অসুস্থ, অসচ্ছল ও দুর্ঘটনাজনিত আহত এবং নিহত সাংবাদিক পরিবারের জন্য বাংলাদেশ জার্নালিস্ট ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তার চেক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ প্রশ্ন তোলেন।
এসব যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের কমিটিতে স্থান দেয়া অপরাধীদের প্রশ্রয় দেয়া উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা আজকে দেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট হওয়া উচিত। তারা স্পষ্ট দেখতে পাবেন, এ চক্র দেশটিকে একটি ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, সকল ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষ এদেশে সুখে-শান্তিতে বসবাস করবে। আর এই লক্ষ্য নিয়েই তার সরকার কাজ করে যাচ্ছে। এখানে কোনো সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও যুদ্ধাপরাধীদের স্থান হবে না।
দেশের চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের অনেক দেশেই এ ধরনের বিচার কোনো নতুন ঘটনা নয়। দেশে প্রায় ২১ বছর যুদ্ধাপরাধী চক্র শাসনক্ষমতায় থাকায় তারা অবৈধ বিত্তবৈভবের পাহাড় গড়ে তুলেছে। যে কারণে নানাভাবে বিচারকে প্রভাবান্বিত করার চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা আমাদের নীতিতে অটল রয়েছি। আমরা এই বিচার কার্যকে এগিয়ে নিয়ে যাব এবং এজন্য ক্ষমতায় থাকা বা না থাকা, জীবন-মৃত্যু কোনো কিছুরই আমরা তোয়াক্কা করি না। ক্ষমতা কোনো ভোগের বিষয় নয়। ক্ষমতা হচ্ছে মানুষের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের বিষয়।
শেখ হাসিনা বলেন, সাংবাদিকদের কল্যাণে ‘বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট’ স্থাপনে আমার ব্যক্তিগত আগ্রহ কাজ করেছে। আপনারা (সাংবাদিক) কেউ আমাকে কোনো পরামর্শ দেননি। নিজ উদ্যোগে করেছি। এ বিষয়ে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম জাতির পিতার কাছ থেকে। কেননা জাতির পিতা সংবাদপত্রে কাজ করতেন।
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর মিডিয়াবিষয়ক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী এবং তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি একেএম রহমতউল্লাহ এমপি তথ্য সচিব মরতুজা আহমদ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল ও মহাসচিব ওমর ফারুক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সভাপতি শাবান মাহমুদ ও সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
অনুষ্ঠানে সিনিয়র সাংবাদিক রাহাত খান, গোলাম সারোয়ার, আবুল কালাম আজাদ, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমানসহ তথ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ এবং বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে ১৯৬ সাংবাদিক এবং সাংবাদিক পরিবারের সদস্যদের হাতে প্রধানমন্ত্রী অনুদানের চেক তুলে দেন।
২০১৪ সালের জুলাই মাসে জাতীয় সংসদে সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট বিল পাশ হয়। এর ভিত্তিতে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সরকার এই ট্রাস্ট গঠন করে।
তিনি এ সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বঙ্গবন্ধুর প্রথম উদ্যোগ গ্রহণের তথ্য তুলে ধরে বলেন, এটা বাংলার মানুষের একটা দাবি ছিল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হবে। জাতির পিতা সেই বিচার শুরু করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেই যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ওই অর্ডিন্যান্স মার্শাল ‘ল’ অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে বাতিল করা হয়। সাজাপ্রাপ্তদের মুক্তি দিয়ে তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল এবং যারা বাংলাদেশ থেকে চলে গিয়েছিল পাকিস্তানি পাসপোর্টে, সেই পাকিস্তানি পাসপোর্টেই তাদের আবার দেশে ফিরিয়ে এনে নাগরিকত্বও দেয়া হয়। অথচ তারা বাংলাদেশেই বিশ্বাস করে না।
অনুষ্ঠানে দেওয়া প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শুরুতেই সবাইকে আপন করে নিয়ে ঘোষণা দিলেন, তিনি নিজেও গণমাধ্যম পরিবারেরই একজন সদস্য। জানালেন তার বাবা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকার তৎকালীন পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধি।
এর আগে সাংবাদিক নেতারা তাদের বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রধান দুটি দাবি তুলে ধরেন যার একটি নবম ওয়েজ বোর্ড ঘোষণা আর ১৯৭৪ সালে গঠিত নিউজপেপার এমপ্লয়িস সার্ভিসেস ফাউন্ডেশন অ্যাক্ট-১৯৭৪ এর পুনর্বহাল। তারা বলেন, পৃথক ওই আইনটি প্রণয়ন করে জাতির জনক সংবাদপত্র তথা সাংবাদিকতা পেশাকে মর্যাদার আসনে তুলে এনেছিলেন। ২০০৬ সালে সাংবাদিকতাকে শ্রম আইনের আওতায় ফেলে ওই মর্যাদা ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
তারই জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নবম ওয়েজবোর্ডের কথা তিনি এরই মধ্যে তথ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে বলেছেন। তার কাছে সাংবাদিকদের চাইতে হয় না, নিজে থেকেই দেন, এই দাবি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সাংবাদিকদের কল্যাণে ‘বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট’ স্থাপনে আমার ব্যক্তিগত আগ্রহ কাজ করেছে। আপনারা (সাংবাদিক) কেউ আমাকে কোনো পরামর্শ দেননি, কেউ দাবিও জানাননি। অনুদান নিতে আসা প্রত্যেক সাংবাদিক কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কাউকে কাউকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরেন। কারো কথা আগ্রহভরে শোনেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারের একার পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব নয়। সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। অনেক সংবাদপত্র, টেলিভিশনের মালিক রয়েছেন, তাদের কাছে কোটি টাকা দান কোনো বিষয়ই নয়। তাদেরও আগ্রহী করে তুলতে হবে। এজন্যে প্রয়োজনে নিজেই এ ধরনের তহবিল গঠন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন, এই ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি উপস্থিত থাকলে কেউ কম টাকার চেক নিয়ে আসতে পারবেন না। অনুষ্ঠানে ডেইলি অবজারভারের সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর হাতে ১০ লাখ টাকার চেক হস্তান্তর করেন।
সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা ও কাজের ধরন নিয়েও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা অবশ্যই রয়েছে, কিন্তু সে স্বাধীনতা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে উপভোগ করতে হবে।
সরকারের সমালোচনার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, যত খুশি সমালোচনা করুন, আপত্তি নেই। তবে সে সমালোচনা অবশ্যই গঠনমূলক হতে হবে। গণমাধ্যমের সমালোচনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমি যে কোনো ভুল সংশোধন করতে চাই।
তবে সংবাদমাধ্যমগুলোই তাদের কাজে ভুল করে, এই মত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন হলি আর্টিজানে আমরা দেখেছি হামলা হওয়ার পর কোনো কোনো টেলিভিশন চ্যানেল কীভাবে অভিযান চালানো হবে, পুলিশসহ অন্য বাহিনীর সদস্যরা কীভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে তাও জানিয়ে দিয়েছে। এতে ভেতরে জঙ্গিরাও টেলিভিশন দেখে সতর্ক হয়ে যেতে পারে। আর তাছাড়া কে কোথায় পালিয়ে রয়েছে তাও যখন সংবাদ হয়ে যায়, তখন জঙ্গিরা তো তাদের বের করে হত্যা করতেও পারে। এসব ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, খবরে মৃতদেহের বীভৎস সব ছবি দেখানো হয়। ইউরোপ, আমেরিকায় এমন হত্যাকা- এখন প্রায়ই ঘটছে, কিন্তু বিশ্বের বড় বড় সংবাদমাধ্যম বিবিসি, সিএনএন তা দেখাচ্ছে না। এগুলোর কাছ থেকে শিক্ষা নিতে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
অনলাইনে আজকাল অনেক সংবাদমাধ্যম আসছে, উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনলাইন পত্রিকার জন্যে নীতিমালা করা জরুরি। অনলাইন পত্রিকা ব্যাপকভাবে বের হচ্ছে। তবে এর কোনো নীতিমালা নেই। সবাইকে একটা নীতিমালায় আসতে হবে। ইতোমধ্যে আমরা এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, কেউ যাতে অশ্লীলতা ছড়াতে না পারে সে বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। আমরা আশা করি খুব তাড়াতাড়ি অনলাইন পত্রিকার নীতিমালা করে ফেলব।
অনুষ্ঠানে সাংবাদিক হত্যার বিচারের দাবিও ওঠে সাংবাদিক নেতাদের পক্ষ থেকে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাংবাদিক হত্যার বিচারের জন্যে সবার সহযোগিতা দরকার। এরই মধ্যে এক সাংবাদিক হত্যার বিচার হয়েছে। অনেকগুলো মামলা বিচারাধীন রয়েছে। তিনি বলেন, আমি নিজেই আমার পরিবারের সকল সদস্যকে হারিয়েছি। তাদের হত্যার বিচার করতে আমার দীর্ঘ সময় লেগেছে। সাংবাদিকদের হত্যারও বিচার হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন