শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

শক্তিশালী ভূমিকম্প যেকোনো সময়েই

প্রকাশের সময় : ২৫ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৫৪ পিএম, ২৪ আগস্ট, ২০১৬

শফিউল আলম : ভূমিকম্পে পরপর দু’দিন কাঁপল সারাদেশ। আরও জোরালো ভূমিকম্পের আশঙ্কায় জনমনে ব্যাপক ভয়ভীতি ও আতঙ্ক বিরাজ করছে সবখানেই। গতকাল (বুধবার) বিকেলে সংঘটিত ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৬ দশমিক ৮, অর্থাৎ প্রবল। আগের দিনের ভূকম্পন ৫ তথা মাঝারি মাত্রার। উভয় ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল মিয়ানমারে। এর আগেও মাঝেমধ্যে ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিককালে ভূকম্পন প্রবণতা বেড়ে গেছে। এ ধরনের ঘন ঘন মৃদু, হালকা কিংবা মাঝারি মাত্রার ভূকম্পন অদূর ভবিষ্যতে বড় আকারের ভূমিকম্পের অশনি সঙ্কেত বহন করে। বাংলাদেশ এবং এর সংলগ্ন ভারত ও মিয়ানমারের অবস্থান ভূমিকম্পের বলয়ে (জোন)। এ অঞ্চলে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে যে কোনো সময়েই। অথচ ভূমিকম্প নিয়ে ভয়-আতঙ্ক থাকলেও উপযুক্ত সতর্কতা ও পূর্বপ্রস্তুতির দিক থেকে বাংলাদেশ অনেক পেছনে পড়ে আছে। এমনকি ভারত-নেপালের চেয়েও পেছনে।
কর্মব্যস্ত বিকেলে জনজীবনে চাঞ্চল্য ও আতঙ্ক জাগিয়ে গতকাল ফের ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সমগ্র দেশ। এর মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৬.৮ (প্রবল)। ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল এবারও মিয়ানমারে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রথমে মৃদু ও পরে মাঝারি ধরনের ভূকম্পনের ধাক্কা দুই দফায় স্থানভেদে ১৫ থেকে ২০ সেকেন্ড পর্যন্ত স্থায়ী হয়। বুধবার বিকেল ৪টা ৩৪ মিনিট ৫৪ সেকেন্ডে এ ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এতে তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া না গেলেও জনজীবনে ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। ভূকম্পে বৃহত্তর চট্টগ্রামে বিভিন্ন স্থানে বাড়িঘরে ফাটল ধরার খবর পাওয়া গেছে। এ সময় ধর্মপ্রাণ জনগণ দোয়া-দরুদ পাঠ করেন। মানুষজনকে খোলা মাঠে ও রাস্তায় বেরিয়ে আসতে দেখা গেছে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই ভূমিকম্পের দুলুনি ও তীব্রতা ছিল বেশি। ঢাকা, বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ছাড়াও সিলেট, খুলনা, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, ফেনী, যশোরসহ দেশের প্রায় সর্বত্র ভূমিকম্পের খবর পাওয়া গেছে। মার্কিন ভূতত্ত্ব সংস্থা (ইউএসজিএস) জানায়, এ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল মধ্য মিয়ানমারের ছাউকে। এর মাত্রা ৬.৭, যা ঢাকার আগারগাঁও ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে ৫২৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে। বাংলাদেশ, মিয়ানমার ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন এলাকায় এ ভূমিকম্প অনুভূত হয়। গত মঙ্গলবার সকাল ৮টায় রিখটার স্কেলে ৫ (মাঝারি) মাত্রার ভূমিকম্প হয়।
বিশেষজ্ঞদের গবেষণা ও বক্তব্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ও আশপাশের অঞ্চল যেকোনো সময়েই প্রকম্পিত হতে পারে শক্তিশালী মাত্রার ভূমিকম্পের আঘাতে। দিনক্ষণ সুনির্দিষ্ট করে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয়। তবে বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও ভূতাত্ত্বিক অবস্থান, ভূস্তরের পরিবর্তন জানান দিচ্ছে অশনি সঙ্কেত ও আলামত। বাংলাদেশ ও আশপাশ অঞ্চলে জোরালো ধরনের ভূমিকম্পের সম্ভাব্য আঘাতে ভয়াল দুর্যোগ এমনকি মানবিক বিপর্যয়ও ঘটতে পারে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, দেশের ভেতরে অথবা কাছাকাছি যে কোনো উৎপত্তিস্থল থেকে মাঝারি থেকে প্রবল কিংবা তীব্র মাত্রায় ভূমিকম্প আঘাত হানার আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বড় ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, বগুড়া, উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিরাট অংশজুড়ে বিশেষত ত্রুটিপূর্ণ ও অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত হাজার হাজার ভবন, মাটির তৈরি ঘরবাড়ি ভূমিসাৎ হয়ে যেতে পারে। এতে করে মৃত্যুর মিছিল ও সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা হবে অকল্পনীয়। ২০১৫ সালের ২৫ এপ্রিল নেপালে রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে দেশটিতে প্রায় ৯ হাজার মানুষ নিহত হয় এবং আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় কমপক্ষে ১ হাজার কোটি ডলারের সমপরিমাণ।
ভূমিকম্পের বেল্টে দেশ
বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি ও বিপদের দিকটি তুলে ধরে সাদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের প্রো-ভিসি অধ্যাপক এম আলী আশরাফ গতকাল (বুধবার) সন্ধ্যায় দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, ভূমিকম্পে বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলয়ে অবস্থান করছে। এ অঞ্চলে অতীতে শক্তিশালী মাত্রায় ভূমিকম্প আঘাত হানে। ভূতাত্ত্বিক অবস্থা অনুযায়ী এখন সে ধরনের জোরালো ভূমিকম্পের সময় আবারও ফিরে এসেছে। তিনি আরো জানান, বাংলাদেশ এবং সংলগ্ন ভারত ও মিয়ানমারÑএই ত্রিদেশীয় সীমান্ত বরাবর ফাটল লাইন (ফল্ট) রয়েছে, যা ভূমিকম্প সৃষ্টি করছে। ভূস্তরের একটি ফাটল বা ফল্ট লাইন চট্টগ্রামের পাশ দিয়ে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর লম্বালম্বি হয়ে চট্টগ্রাম উপকূল ও বঙ্গোপসাগর দিয়ে আন্দামান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গেছে। এর সমান্তরালে আরেকটি ‘বার্মিজ ফল্ট লাইন’ বাংলাদেশ-ভারতের কাছে দিয়ে মিয়ানমারে চলে গেছে। বার্মিজ ফল্ট থেকে গতকালসহ ইদানীং কয়েকবার ভূমিকম্প হয়েছে। আরেকটি ফল্ট লাইন সিলেট শহরের উত্তরে ‘ডাউকি ফল্ট’, যা ভারতের সীমানা পর্যন্ত চলে গেছে। অতীতের মতো শক্তিশালী ভূমিকম্প যে কোনো সময়েই আঘাত হানতে পারে।
পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা
সাম্প্রতিক সময়ে মৃদু বা মাঝারি ধরনের ঘন ঘন ভূমিকম্প বাংলাদেশের জন্য ‘চোখ-কান’ খুলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট বলে আশঙ্কা করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা জানান, অতীতে এ অঞ্চলে শক্তিশালী ও প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের রেকর্ড রয়েছে। সচরাচর ৫০, ১০০ ও ১৫০ বছর পরপর শক্তিশালী মাত্রায় ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তি ঘটে থাকে। নেপালে একই স্থানে ৯০ বছর পর (২৫ এপ্রিল, ২০১৫) ভয়াল ভূমিকম্পটি সংঘটিত হয়। সে হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশও উচ্চঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কেননা শক্তিশালী ভূমিকম্পের শত বছর পেরিয়ে গেছে। বাংলাদেশ ও এর কাছের অঞ্চলে বিশেষত নেপাল এবং আসামসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের ভূকম্পন-প্রবণ অঞ্চলে বিগত ১৫০ বছরের মধ্যে রিখটার স্কেলে ৭ ও ৮ মাত্রায় কমপক্ষে ৭টি ভয়াল ভূমিকম্প আঘাত হানে। যা ‘দ্য গ্রেট সেভেন আর্থকোয়েক’ নামে পরিচিত। এর মধ্যে ২টি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল বর্তমান বাংলাদেশ ভূখ-ের ভেতরেই। ৭টির মধ্যে ৫টি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব ছিল রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ২৫০ কিলোমিটার ব্যবধানে।
ঘন ঘন কম্পন
বাংলাদেশে বেশ কয়েক বছর যাবৎ ঘন ঘন মৃদু, হালকা ও মাঝারি ধরনের ভূকম্পন অনুভূত হচ্ছে। এগুলোর কোনো কোনোটির উৎস বাংলাদেশের কাছে-কিনারে আবার অনেকগুলো বহু দূরে। এ ধরনের ঘন ঘন অথচ হালকা ভূ-কম্পনকে অদূর ভবিষ্যতে কোনো শক্তিশালী ভূমিকম্পের পদধ্বনি, আগাম সতর্ক সঙ্কেত বা ‘ওয়েক আপ কল’ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন। উপর্যুপরি মৃদু, হালকা, মাঝারি মাত্রায় ভূকম্পনের কারণে এ অঞ্চলের ভূ-ফাটল লাইনগুলো নাজুক ও শিথিল হয়ে পড়ছে। এর ফলে জোরালো ভূমিকম্পের কারণ তৈরি হচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের হিসাবমতে, গত ১৪ বছরে বাংলাদেশে ৪৮২ বার ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে।
আশঙ্কার আরো কারণ
আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর্থ-অবজারভেটরির একটি যৌথ গবেষণায় জানানো হয়েছে, ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং বার্মার গতিশীল ভূ-পাটাতনের (টেকটোনিক প্লেট) সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। এখানে বাংলাদেশ অঞ্চলে দুই দিক থেকেই শক্তিশালী ভূমিকম্পের উপযোগী শক্তি ভূস্তরে অবিরাম জমা হয়েছে। এতে করে দুটি বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কার মধ্যেই রয়েছে বাংলাদেশ। এর মাত্রা হতে পারে রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৫ থেকে ৮ পর্যন্ত। তাছাড়া বাংলাদেশের ভেতরে ও কিনারের দিকে ১৩টি ভূ-ফাটল (ফল্ট) লাইন রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ভূমিকম্প জোন বা বলয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। বিশ্বের অন্যতম সক্রিয় ভূকম্পন বলয়ের মধ্যে বাংলাদেশ ও এর আশপাশ অঞ্চল (বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারত) রয়েছে উচ্চ ঝুঁকিতে। বাংলাদেশ এবং সংলগ্ন ভারতীয়, ইউরোশীয় ও মিয়ানমারের ভূ-পাটাতন কয়েক সেন্টিমিটার করে ধীরে ধীরে গতিশীল হচ্ছে। এর ফলে শক্তিশালী মাত্রায় ভূমিকম্পের ভূতাত্ত্বিক অবস্থা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ভূ-কম্পনমাত্রা অত্যধিক হলে এবং ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল যদি বাংলাদেশের ভেতরে অথবা কাছাকাছি এলাকায় হয়, সেক্ষেত্রে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের জনবহুল এলাকায় জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে।
কক্সবাজারে আহত ১৫
জেলার সর্বত্র ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। এ সময় কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন বহুতল ভবন থেকে লোকজনকে বের হয়ে যেতে দেখা গেছে। এভাবে বের হতে গিয়ে ১৫ জন নারী-শিশু আহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
রাজশাহীতে আতঙ্ক
রাজশাহী ব্যুরো : রাজশাহী অঞ্চলে ভূমিকম্পে তীব্র ঝাঁকুনি অনুভূত হয়েছে। ভূকম্পনটি প্রায় ২০ সেকেন্ড স্থায়ী ছিল। তবে এ ঘটনায় কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। ভূমিকম্পের সময় মহানগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মানুষজন যথারীতি ঘর থেকে আতঙ্কে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। উঁচু ভবন থেকে মানুষ দ্রুত নিচে নামতে গিয়ে অনেকে পড়েও যান।
পাবনায় রাস্তায় মানুষ
পাবনা জেলা সংবাদদাতা : পাবনায় প্রায় ৫০ সে: সময় এই কম্পন স্থায়ী ছিল। যারা বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তারা শহরের রাস্তায় নেমে আসেন। চলমান মানুষ থমকে দাঁড়ায়। শহরের জুবলী ট্যাংক পুকুর, শিবরামপুরের নতুন বাঁশ বাজার এলাকার পুকুরের পানি উত্তাল হয়ে উঠে। ভেসে উঠে মাছ ।
গফরগাঁওয়ে ছোটাছুটি
গফরগাঁও উপজেলা সংবাদদাতা : গফরগাঁও পৌরসভাসহ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বুধবার বিকেল ৪টা ৩৪ মিনিটের দিকে ভূমিকম্পে বহু কাঁচা ঘরবাড়ি ফেটে গেছে। আতঙ্কে লোকজনকে ঘর থেকে বের হয়ে ছোটাছুটি করতে দেখা গেছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
সুমন ২৫ আগস্ট, ২০১৬, ১:৫২ পিএম says : 0
হে আল্লাহ তুমি আমাদের প্রতি রহমত নায়িল করো।
Total Reply(0)
আবির ২৫ আগস্ট, ২০১৬, ১:৫৬ পিএম says : 2
ভুমিকম্পের সময় কি করা উচিত আর কি উচিত না সে বিষয়গুলো সকলের জানা দরকার।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন