এমন মানুষ খুব কম আছেন যারা দূরে কিংবা কাছে বেড়াতে ভালবাসেন না। একটু ফুসরত পেলে সাধ আর সাধ্যের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে ছুটে যান প্রকৃতির কাছে। বিশাল সমুদ্রতট আর সবুজ শ্যামল বাংলার যেমন রয়েছে রূপ তেমনি অতীত ঐতিহ্য। বিত্তবানরা ছোটেন বিদেশে। অথচ এই শ্যামল বাংলার আনাচে কানাচেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক ইতিহাস। ভ্রমণ ও জ্ঞান পিপাসুরা প্রতিনিয়তই ভীড় করছেন। এই করোনা মহামারিকালেও কিছু ছন্দপতন ঘটালেও মানুষের পদচারণায় ফের মুখরিত হয়ে উঠেছে।
বাংলার প্রাচীন ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিশাল একটি অংশকে প্রতিনিধিত্ব করছে রাজশাহী। এ জনপদটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মৌর্য কৃষাণ গুপ্ত, পাল, সেন, সুলতানী ও মোঘল ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আমলের শত শত স্থাপত্য শিল্পকর্ম প্রত্মতাত্তিক নির্দশনসহ বঙ্গীয় শিল্পকলার অনুপম ভাষ্কর্য শিল্পের বিশাল ভান্ডার। বৃহত্তর রাজশাহীর সোমপুর বৌদ্ধবিহার, নাটোরের রাজবাড়ি, নবাবগঞ্জের ছোট সোনামসজিদ, তাহাখানা, দারাস বাড়ি, মসজিদ ও মাদরাসা, খনিয়া দিঘী মসজিদ, রাজশাহীর বাঘা মসজিদ ও নওগার কুসম্বা মসজিদসহ অসংখ্য স্থাপনা দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করেছে। পুঠিয়ার রাজবাড়ি ও বাংলাদেশের বিশাল সুউচ্চ ও বহুগুচ্ছা চূড়া বিশিষ্ট মন্দির ও স্থাপনাগুলো পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। রয়েছে বাংলাদেশের একমাত্র পুলিশ একাডেমী সারদার দৃষ্টিনন্দন চত্বর। গ্রামীণ জনপদেও গড়ে উঠেছে পার্ক ও বিনোদনকেন্দ্র।
সব মওসুমেই ভ্রমণ পিপাসু মানুষ বেড়াতে আসতে পারেন রাজশাহীতে। এক সময় রাজা জমিদার ও মুসলিম সুলতানগণ এলাকাটি শাসন করেছেন বলে এখানকার নামকরণ হয়েছে রাজশাহী। প্রাচীন রাজবাড়ি, জমিদার বাড়ি ও স্থাপনা এর স্বাক্ষ্য দিচ্ছে। রাজশাহীর অনেক নামে পরিচিত। এক সময় ছিল বস্ত্রের রানী সিল্ক তৈরির ভান্ডার। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সিল্কের বাণিজ্যের জন্য ইউরোপের বনিকরা বাংলায় আসতে আকৃষ্ট হন। এখনো তাদের অনেক স্থাপনা আর কুঠি কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে। সে কারণে রাজশাহীর পালকে যোগ হয়েছে সিল্ক সিটি বা রেশম নগরীর তকমা। এখানে বেড়াতে এলে তুতপোকা থেকে কিভাবে সিল্ক সুতা তৈরী হয় তা যেমন প্রত্যক্ষ করা যায়। তেমনি দৃষ্টিনন্দন রেশম বস্ত্র কেনা যায়।
রাজশাহীকে বলা হয় আমের রাজধানী। এখনো ছড়া কেটে বলা হয় রাজা নেই শাহী নেই রাজশাহী নাম। হাতি ঘোড়া কিছু নেই আছে শুধু আম। সত্যি সত্যি রাজশাহী অঞ্চলের মাইলের পরম মাইল জুড়ে আম্র কাননের সবুজতায় ঘেরা বাগান কারো মন আকৃষ্ট না করেই পারে না। আর আমের মওসুমে এলে দেখার মজা আর খাওয়ার মজা দুটো মিলবে এক সাথে।
শীতকালে বরেন্দ্র অঞ্চলের লাল জমিনে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের সমারোহ। সবুজ ধানের ক্ষেত হলুদ সরিষা, দুধসাদা ফুল কপি, নানা ধরনের শাকসবজি আর গোলাপী টমেটোর ক্ষেত অন্য রকম অনুভ‚তি জাগাবে। তাছাড়া এখানে গড়ে ওঠা কমলা, মালটা, ড্রাগন, স্ট্রবেরীর বাগান চমকে দেবে।
শত শত বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য সমৃদ্ধ পদ্মা, মহানন্দা, বারণই ছোট যমুনা বিধৌত অঞ্চল বৃহত্তর রাজশাহী। এই পদ্মা পাড়ে গড়ে উঠেছে রাজশাহী। এক সময় এর তীব্র স্রোতধারা আর বাতাসের সাথে মিতালী করে বড় বড় ঢেউ প্রমত্ত পদ্মা নাম দিয়েছে। বজরা ভাসিয়ে কবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছেন তার জমিদারী দেখতে। লিখেছেন কবিতা। পদ্মার বিশাল স্রোতধারা কবি সাহিত্যিকদের করেছে সঞ্জীবিত। আব্দুল আলিমের দরাজ কন্ঠের গান পদ্মার ঢেউরে..........।
ভারতের পানি জল্লাদরা ১৯৭৪ সালে ফারাক্কা ব্যারেজ দিয়ে সেই প্রমত্ত পদ্মাকে মেরে ফেলেছে। বছরের নয়মাস বালিচরে চাপা পড়ে আর্তনাদ করে। বর্ষার সময় জেগে ওঠে। এই মরা পদ্মা আর ভরা পদ্মার রুপ দেখতে সারা বছর মানুষ ভীড় জমায়। বর্ষায় নৌকায় ভাসে। আর শুকনো মওসুমে বালিচরে ছুটোছুটি। পদ্মার চরে বিভিন্ন ফসল ফলিয়ে বানানো মরুদ্যান মন আকৃষ্ট করে। বর্ষার সময় জেগে ওঠে বিভিন্ন বিল। এসব বিলে মানুষ ভেসে বেড়ায়। নাটোরের বিল হালতি পরিচিতি পেয়েছে মিনি কক্সবাজার হিসাবে। চলনবিলসহ বিভিন্ন বিলগুলো মানুষকে টানছে। গড়ে উঠেছে অসংখ্য পার্ক বিনোদন কেন্দ্র। প্রতিদিন হাজারো মানুষ ভীড় জমায়। দিনভর হৈ-হুল্লোড় করে। মহামারী করোনাকালে কিছুটা ছন্দপতন ঘটালেও ফের শুরু হয়েছে ভ্রমণ পিপাসুদের আনগোনা।
রাজশাহী পরিচ্ছন্ন শিক্ষা নগরীর একটা সুনাম রয়েছে। বহু পীর সাধকের পূণ্যভূমি। বাগদাদ থেকে ইসলাম প্রচারে এসে এখানে শায়িত আছেন হযরত শাহমখদুম রুপোশ (রহ.) বাঘায় শায়িত আছেন হযরত শাহদৌলা। নবাবগঞ্জে হযরত শাহ নেয়ামতুল্লাহ। বিড়ালদহে হযরত শাহ করম আলী। হযরত শাহমখদুম (র.) দরগার পাশে শায়িত রয়েছেন হযরত তুরকান শাহসহ অনেক কামেল দরবেশ। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হলে এসব কামেল দরবেশদের মাজার জিয়ারত করলে মনটা প্রশান্তিতে ভরে যাবে। পঞ্চাশ টাকা দশ টাকার নোটে বাঘা ও কুসম্বা মসজিদের ছবি আছে তা স্বচক্ষে দেখতে পারেন। আবার শুকরিয়া নামাজ আদায় করতে পারেন।
রাজশাহী মহানগরী পরিচ্ছন্ন ও অনেকটা সাজানো শিক্ষা নগরী হিসাবে তার সুনাম ধরে রেখেছে। সাজানোর কাজ অব্যাহত রয়েছে। এখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাইরে থেকে পড়াশোনা করতে আসে লাখ দেড়েক শিক্ষার্থী। তাদের কলকাকলীতে মুখরিত থাকে বছরজুড়ে নগরীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো। প্রতিদিন পদ্মার তীরের বিভিন্ন স্পটে এরা আড্ডা জমায়। পর্যটকরা তাতে সামিল হতে পরে। বাইরে থেকে আসে বিভিন্ন পিকনিক পার্টি। করোনার কারণে পিকনিক পার্টিতে ছন্দপতন ঘটালেও থেমে নেই দলবদ্ধভাবে ঘুরতে আসা ভ্রমণ পিপাসুদের।
রাজশাহী অঞ্চলের সাথে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল। সড়ক পথ, রেলপথ, আকাশ পথে ভাল যোগাযোগ রয়েছে। আবাসনের জন্য রয়েছে সব শ্রেণীর মানুষের হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট। সর্বোপরি রয়েছে এ অঞ্চলের অতিথি পরায়ন সহজ সরল মানুষ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন