সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : ফারাক্কার সবক’টি গেট উন্মুক্ত করে দেয়ার যে সিদ্ধান্ত ভারত সরকার নিয়েছে তাতে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে বাংলাদেশে। এতে করে বাংলাদেশে নতুন করে বন্যা দেখা দেবে। গঙ্গানির্ভর সবক’টি নদীর পানি প্রবাহিত হবে বিপদ সীমার উপর দিয়ে। ভেসে যাবে বাড়ী-ঘর, ক্ষেতের ফসল। ডুবে যাবে রাস্তা-ঘাট, সরকারি-বেসরকারি অফিস, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। দেখা দেবে নদী ভাঙন, ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাঁধ, ব্রীজ, কালভার্ট। প্রাণহানির শঙ্কাও দেখা দেবে। বন্যা কবলিত এলাকার বিপদগ্রস্ত মানুষগুলোকে নিয়ে সরকার পড়বে বিপাকে। বিশেষ করে দুর্গত এলাকায় ত্রাণ ও ওষুধ সামগ্রী পৌঁছানো এবং বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের বাড়তি নিরাপত্তা নিয়ে সরকারকে হিমশিম খেতে হবে। এমন একটি পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের প্রস্তুতি কতটুকু তা নিয়েও আলোচনা চলছে। ভারত ফারাক্কার সব গেট উন্মুক্ত করে দিচ্ছেÑ এমন সংবাদের ভিত্তিতে গতকাল (বুধবার) পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় দিনভর এ ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিয়েছে। যৌথ নদী কমিশনের সদস্য মো. জাহাঙ্গীর হোসেন একাধিকবার ফোনে ভারতের যৌথ নদী কমিশনের সদস্যের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছেন। খোদ পানি সম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানার নির্দেশ দিয়েছেন যৌথ নদী কমিশনের সদস্যকে।
জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে প্রকৃত ঘটনা কীÑ তা জানার জন্য।
বাংলাদেশের উজানে ভারত যে কয়টি বাঁধ নির্মাণ করেছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে গঙ্গা নদীর উপর নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ। এছাড়াও তিস্তায় গজলডোবা বাঁধ, মনু নদীতে নলকাথা বাঁধ, যশোরে কোদলা নদীর উপর বাঁধ, খোয়াই নদীর উপর চাকমা ঘাট বাঁধ, বাংলাবন্ধে মহানন্দা নদীর উপর বাঁধ, গোমতী নদীর উপর মহারানি বাঁধ, মুহুরি নদীর উপর কলসী বাঁধ, উমিয়াম ও ধালা নদীর উপর মাওপু ড্যাম এবং সারী ও গোয়াইন নদীর উপর মাইন্ডু ড্যাম নির্মাণ করেছে। আর বরাক নদীর উপরেও ভারত নির্মাণ করছে শক্তিশালী স্থাপনা।
ভারত মূলত শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি আটকাতেই এসব বাঁধ নির্মাণ করে। বর্ষায় এসব বাঁধের অধিকাংশ গেটই উন্মুক্ত রাখা হয়। ফলে এই বাঁধের কারণে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ চরম পানি সঙ্কটের কবলে পড়ে। আর বর্ষায় এদেশের নদ-নদীগুলো উজান থেকে নেমে আসা পানি ধারণ করতে পারে না। ফলে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে বন্যা দেখা দেয়। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় এক দফা এবং অনেক এলাকায় দু’দফা বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যার এসব ক্ষয়ক্ষতি নিরসনে সরকার যখন হিমশিম খাচ্ছে; ঠিক সেই মুহূর্তে ফারাক্কার সব গেট খুলে দিয়ে বাংলাদেশের দিকে পানি ঠেলে দেয়ার ভারতীয় সিদ্ধান্তে সরকারের অভ্যন্তরে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে আরও এক দফা বন্যার।
ভারতের মিডিয়া
এদিকে, ভারতীয় মিডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, বিহারকে বন্যামুক্ত করতে প্রদেশটির মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার ভারতের গঙ্গা নদীর ওপর নির্মিত বিতর্কিত ফারাক্কা বাঁধকে পুরোপুরি সরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করে। এরই আলোকে প্রাথমিকভাবে ফারাক্কার গেটগুলো উন্মুক্ত করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আর বিবিসি জানায়, ফারাক্কার ভয়াবহ প্রভাবে এখন শুধু বাংলাদেশই নয়, একচল্লিশ বছর আগে গঙ্গার উপর যখন ফারাক্কা বাঁধ চালু করা হয়, তার একটা প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পানিপ্রবাহের একটা অংশকে হুগলী নদীতে চালিত করে কলকাতা বন্দরকে পুনরুজ্জীবিত করা।
সে উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল না হলেও ফারাক্কার জেরে গঙ্গার উজানে যে পলি পড়া শুরু হয়েছে, তার জেরে প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে বন্যাকবলিত হয়ে পড়ছে বিহার ও উত্তর প্রদেশের একটা বিস্তীর্ণ অংশ। ফারাক্কা থেকে কোনও সুবিধা উজানের এসব রাজ্য পাচ্ছে না, কিন্তু প্রতি বছরই তাদের ভুগতে হচ্ছে ফারাক্কার জন্য।
ভারতের ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের আপত্তি দীর্ঘদিনের। এই প্রথম ভারতের একজন প্রভাবশালী রাজনীতিক ও মুখ্যমন্ত্রী ফারাক্কা বাঁধ তুলে দেয়ার কথা বললেন। তিনি আরও বলেছেন, বিহারে বন্যার এই হাল গঙ্গায় সিল্ট বা পলি জমার কারণেই। যখন থেকে ফারাক্কা বাঁধ নির্মিত হয়েছে, তখন থেকেই এই পলি জমা শুরু হয়েছে। আগে যেসব পলি নদীর প্রবাহে ভেসে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়তো, এখন ফারাক্কার কারণে সেটাই নদীর বুকে জমা হয়ে বন্যা ডেকে আনছে। আমি তাই গত দশ বছর ধরে বলে আসছি- এই সিল্ট ম্যানেজমেন্ট না করলে বিহার কিছুতেই বন্যা থেকে পরিত্রাণ পাবে না।
এদিকে, ভারতে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির জন্য দেশটির পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ফারাক্কা বাঁধের প্রায় সব গেট খুলে দেবার নির্দেশ দিয়েছে। ভারতের কর্মকর্তারা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গে ফারাক্কা বাঁধের গেটগুলো খুলে পানি ছেড়ে দিলে বিহার রাজ্যে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। দেশটির কেন্দ্রীয় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সমীর সিনহা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, বর্ষাকালে এমনিতেই অন্য সময়ের তুলনায় ফারাক্কায় বেশি গেট খোলা থাকে। কিন্তু বিহার প্রদেশে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় এখন প্রায় ১০০টি গেট খুলে দেবার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
অপরদিকে যৌথ নদী কমিশন সূত্রে জানা যায়, ফারাক্কা বাঁধে মোট গেটের সংখ্যা ১০৯টি। বর্ষায় এসব গেটের অধিকাংশ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। শুধুমাত্র হুগলি নদীতে ৪০ হাজার কিউসেক পানি ধরে রাখতে যে কয়টি গেট বন্ধ রাখার প্রয়োজন হয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ওই কয়টি গেটই বন্ধ করে রাখে। এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের কর্মকর্তারা বলছেন, ফারাক্কার ১শ’টি গেট খুলে দিলে ১১ লাখ কিউসেক পানি সরে যাবে যাতে করে বিহারের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। বিহার রাজ্যে গত এক সপ্তাহে ১০ লাখের বেশি মানুষ বন্যা কবলিত হয়েছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র
তবে বাংলাদেশে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, ১১ লাখ কিউসেক পানির প্রবাহ যদি বাংলাদেশের ভেতরে আসে, তাহলে বাংলাদেশ অংশে পদ্মায় পানি বাড়বে, কিন্তু বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না। এখন ব্রহ্মপুত্র-যমুনায়ও পানি কমছে।
এ ব্যাপারে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ খন্দকার বিবিসি বাংলাকে বলেন, বাংলাদেশের ভেতরে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার ভেতর দিয়ে সবচেয়ে বেশি পানি প্রবাহিত হয়। এখন এই মুহূর্তে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার পানি কমতির দিকে। সুতরাং আমরা যেটা মনে করছি সেটা হলো, একটা নদীর পানি বৃদ্ধিতে বড় বন্যার পরিস্থিতি সৃষ্টি না-ও হতে পারে। ফারাক্কা বাঁধের গেট খোলার তথ্য আমার কাছে নেই। কী পরিমাণ পানি আসবে, বুঝতে পারছি না। বিপদসীমা অতিক্রম করবে কি না, বলতে পারছি না। পানি এলেই বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা হবে, এমনটা আমরা মনে করছি না।
ফারাক্কা বাঁধ
ফারাক্কা গঙ্গা নদীর উপর অবস্থিত একটি বাঁধ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় এই বাঁধটি অবস্থিত। ১৯৬১ সালে এই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। সেই বছর ২১ এপ্রিল থেকে বাঁধ চালু হয়। ফারাক্কা বাঁধ ২,২৪০ মিটার (৭,৩৫০ ফুট) লম্বা। বাঁধ থেকে ভাগীরথী-হুগলি নদী পর্যন্ত ফিডার খালটির দৈর্ঘ্য ২৫ মাইল (৪০ কি.মি.)। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে কলকাতা বন্দরের কাছে হুগলি নদীতে পলি জমা একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এই পলি ধুয়ে পরিষ্কার করার জন্য ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করা হয়। শুষ্ক মৌসুমে (জানুয়ারি থেকে জুন) ফারাক্কা বাঁধ গঙ্গার ৪০,০০০ ঘনফুট/সে পানি হুগলি নদীর অভিমুখে ঠেলে দেয়া হয়। হিন্দুস্তান কনস্ট্রাকশন কোম্পানি বাঁধটি তৈরি করে। বাঁধটিতে মোট ১০৯টি গেট রয়েছে। ফারাক্কা সুপার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের পানি এই বাঁধ থেকেই সরবরাহ করা হয়।
ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব
ফারাক্কা বাঁধ ভারত তৈরি করা হয় কলকাতা বন্দরকে পলি জমা থেকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু এটা ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনে, বিশেষ করে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে। শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি অপসারণের ফলে এই অঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে বাংলাদেশকে কৃষি, মৎস্য, বনজ, শিল্প, নৌ পরিবহন, পানি সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হতে হয়। প্রত্যক্ষভাবে প্রতিবছর বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়; যদি পরোক্ষ হিসাব করা হয়, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হবে।
ফারাক্কা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গঙ্গা নদীর (পদ্মা) প্রবাহে চরম বিপর্যয় ঘটে। প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীর নাব্যতা কমে যায়। ফলে প্রায়ই বড় বন্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বাংলাদেশের গড়াই নদী এখন সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্তপ্রায়। এ বাঁধের ফলে খুলনা অঞ্চলের মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞানীরা খুলনার রূপসা নদীর পানিতে ৫৬৩.৭৫ মিলিগ্রাম/লিটার ক্লোরাইড আয়নের উপস্থিতি পেয়েছেন। তাছাড়া, মিঠা পানির সরবরাহ কমে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে লবণ ভূ-অভ্যন্তরস্থ পানিতে প্রবেশ করছে।
কৃষির অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। পানির স্তÍর অনেক নেমে যাওয়ায় দক্ষিণ অঞ্চলের জি-কে সেচ প্রকল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানি অপসারণের ফলে পদ্মা ও এর শাখা-প্রশাখাগুলোর প্রবাহের ধরণ, পানি প্রবাহের বেগ, মোট দ্রবীভূত পদার্থ এবং লবণাক্ততার পরিবর্তন ঘটেছে। গঙ্গার পানির উপর এই এলাকার প্রায় দুই শতেরও বেশি মাছের প্রজাতি ও ১৮ প্রজাতির চিংড়ী নির্ভর করে। ফারাক্কা বাঁধের জন্য মাছের সরবরাহ কমে যায় এবং কয়েক হাজার জেলে বেকার হয়ে পড়ে। ফারাক্কার কারণে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের বেশির ভাগ নৌপথ নৌ-চলাচলের অযোগ্য হয়ে যায়। আর ভূ-অভ্যন্তরের পানির স্তর নেমে যায়। যার প্রভাব পড়ে কৃষি, শিল্প, পানি সরবরাহ ইত্যাদির উপর। যার ফলে আর্সেনিক সমস্যাও দেখা দিয়েছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে।
ত্রিশ বছর মেয়াদি চুক্তি
শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গা নির্ভর নদীগুলোকে রক্ষায় ১৯৯৬ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সাথে এই নদীর পানি ভাগাভাগি চুক্তি করেন। ঐতিহাসিক এই চুক্তির ফলে আন্তর্জাতিক এই নদীর পানির উপর বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ এই নদী থেকে সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন