হিমালয়কন্যা হিসেবে পরিচিত দেশের সর্ব-উত্তরের জেলা পঞ্চগড়। শুধু ইতিহাস আর ঐতিহ্যেই নয়, অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জনপদের নাম পঞ্চগড়। শীতপ্রবণ এ জেলার তেঁতুলিয়া থেকে দেখা যায় বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতমালা হিমালয় ও কাঞ্চনজঙ্ঘা। চোখের কাছে ভেসে থাকা হিমালয় পর্বত ও কাঞ্চনজঙ্ঘার দুর্লভ মায়াবী দৃশ্য যে কারোরই মন কেড়ে নেয়। আকাশ মেঘমুক্ত থাকায় এবং বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ কমে যাওয়ায় পরিষ্কার দেখা মিলছে কাঞ্চনজঙ্ঘার নয়নাভিরাম নৈসর্গিক রূপ। প্রথম সকালে একটু কালছে দেখায় কাঞ্চনজঙ্ঘা। সূর্যকিরণের তেজ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘা আরো বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সকাল ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত বেশ ভালোভাবেই দেখা যায়। তারপর ক্রমান্বয়ে আবার ঝাপসা হয়ে হারিয়ে যায়। তবে শেষ বিকেলে সূর্যকিরণ যখন তীর্যকভাবে বরফাচ্ছাদিত পাহাড়ে পড়ে তখন অনিন্দ্যসুন্দর হয়ে আবারো ধরা দেয় কাঞ্চনজঙ্ঘা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দেশের সর্ব-উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা ইউনিয়ন (স্থলবন্দর) থেকে নেপালের দূরত্ব ৬১ কিলোমিটার, ভুটানের ৬৪ কিলোমিটার, চীনের ২০০ কিলোমিটার, ভারতের দার্জিলিংয়ের ৫৮ কিলোমিটার এবং শিলিগুড়ির ৮ কিলোমিটার। অন্যদিকে হিমালয়ের এভারেস্ট শৃঙ্গের দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার আর কাঞ্চনজঙ্ঘার ১১ কিলোমিটার। কিন্তু মেঘ-কুয়াশামুক্ত আকাশের উত্তর-পশ্চিমে তাকালেই দেখা মেলে বরফ আচ্ছাদিত সাদা পাহাড়, মনে হয় এইতো চোখের সামনেই কাঞ্চনজঙ্ঘা।
জানা গেছে, কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতশৃঙ্গ নেপাল ও ভারতের সিকিম সীমান্তে অবস্থিত। কাঞ্চনজঙ্ঘার উচ্চতা ৮ হাজার ৫৮৬ মিটার বা ২৮ হাজার ১৬৯ ফিট। যদিও ১৮৫২ সালের আগে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে পৃথিবীর সবোর্চ্চ শৃঙ্গ বলে মনে করা হতো। ১৯৫৫ সালের ২৫ মে মাসে ব্রিটিশ পবর্তারোহী দলের সদস্য জোয়ে ব্রাউন এবং জর্জ ব্যান্ড সর্বপ্রথম কাঞ্চনজঙ্ঘায় আরোহণ করেন।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে জানতে পেরে ভ্রমণ পিপাসিরা কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য দেখার খবরে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যেও দলে দলে পর্যটকরা ভিড় করছেন পঞ্চগড় ও তেঁতুলিয়ায়। রংপুর থেকে আসা পর্যটক দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘা সিকিম ও দার্জিলিং থেকে দেখেছি, তবে বাংলাদেশ থেকে দেখাটা ব্যতিক্রম, -বললেন মিরাজুল ইসলাম দম্পতি। তাদের মতে, কাঞ্চনজঙ্ঘাটা গ্রামীণ অবয়বের পাশাপাশি চতুর্দিকে ধানক্ষেত লোকজন সেখানে কাজ করছে তার উপরে কাঞ্চনজঙ্ঘাটা। একেক জায়গায় কাঞ্চনজঙ্ঘার একেক রূপ। তবে বাংলাদেশের এ রূপটা আমাদের ভালো লাগে।
ঢাকা থেকে আসা পর্যটক আবুল খায়ের দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, গত কয়েক বছর কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে এসে আমাকে নিরাশ হয়ে ফিরে যেতে হয়েছে। এবার সেই আশা পূরণ হয়েছে। সারাদিন তেঁতুলিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য উপভোগ করেছি। চট্টগ্রাম থেকে তেঁতুলিয়ায় বনভোজনে আসা আমির হোসেন বলেন, ঘুরতে এসে তেঁতুলিয়া থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাব আশা করিনি। হিমালয়ের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে আমি মুগ্ধ। কুমিল্লার থেকে আসা বখতিয়ার মোর্শেদ নামের এক পর্যটক ইনকিলাবকে বলেন, ভারতের দার্জিলিং গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার যে দৃশ্য দেখা যায়, এর চেয়ে তেঁতুলিয়া থেকে ভালো দেখা যায়। এখানকার প্রকৃতির সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘার পুরো অবয়ব এক সঙ্গে ধরা দেয়।
পঞ্চগড় পরিবেশ পরিষদের সভাপতি তৌহিদুল বারী বাবু বলেন, আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছিল পাহাড়েও। দ্রæত বরফ গলে যাচ্ছিল। তাই পর্বত চ‚ড়ার চারপাশ কুয়াশাচ্ছন্ন থাকতো। এ কারণে কাঞ্চনজঙ্ঘা অল্প কয়েকদিন ছাড়া বেশিরভাগ সময় দেখা যেত না। এবার করোনায় পরিবেশ দূষণ অনেকটা কমেছে, তাই কাঞ্চনজঙ্ঘা পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, অন্যান্য বছর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেখা গেলেও এবার জানুয়ারি মাসেও দেখা যাচ্ছে।
তবে এবার জেলার করতোয়া ব্রিজ, অমরখানা মাগুরমারী চৌরাস্তা, মাঝিপাড়া, বাংলা টি কারখানা, তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো, রনচন্ডি, তীরনইহাট, কাশিমগঞ্জ, শালবাহান, আনন্দধারা, বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টসহ বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য অবলোকন করেছেন। তবে বাংলাদেশ আর ভারত সীমান্তের বুক চিরে বয়ে যাওয়া মহানন্দা নদীর পাড় বা ডাকবাংলো এলাকা থেকে কাঞ্চজঙ্ঘার অপূর্ব দুর্লভ মায়াবী দৃশ্য সবচেয়ে সুন্দরভাবে দেখা যাচ্ছে। আর এখানেই সবচেয়ে বেশি ভিড় করছেন পর্যটকরা।
সূর্যোদয়ের পর কাঞ্চনজঙ্ঘার চ‚ড়াটি প্রথমে লালচে দৃশ্যমান হয়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ পরিবর্তন হতে থাকে। সোনালি, রূপোলির পর তুষারশুভ্র বরফে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যমান হয় পর্যটকদের সামনে। আর বিকালের সূর্যকিরণে তা ধরা দেয় অনিন্দ্য সুন্দর হয়ে।
তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রাসেল শাহ্ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, নেপাল ও ভারত কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার সবচেয়ে আদর্শ জায়গা। নেপাল, ভুটান, ভারত ও চীন তেঁতুলিয়ার কাছাকাছি হওয়ায় দেশের এ এলাকা থেকেই সাধারণত কাঞ্চনজঙ্ঘা স্পষ্ট দেখা যায়। বরফ আচ্ছাদিত নয়নাভিরাম কাঞ্চনজঙ্ঘা ও এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে দলে দলে পর্যটকরা এখানে আসতে শুরু করেছেন। ভোরের সূর্য ওঠার আগেই পর্যটকরা মহানন্দা নদীর পাড় ও তেঁতুলিয়া ডাক-বাংলো এলাকায় জড়ো হন। করোনার কারণে দীর্ঘদিন লকডাউনের কারণে বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ কম থাকায় বৃষ্টি হওয়া ও আকাশে মেঘ না থাকায় পঞ্চগড়সহ আশপাশের জেলাগুলো থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্পস্ট ও দীর্ঘক্ষণ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহাগ চন্দ্র সাহা দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে নতুন রূপে ঢেলে সাজানো শুরু হয়েছে তেঁতুলিয়াকে। দৃষ্টিনন্দন করা হচ্ছে পিকনিক কর্নার ও জেলা পরিষদ ডাকবাংলো। এছাড়াও পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে মাঝিপাড়া বাইপাসে সারস পাখি, কালান্দিগঞ্জ বাজারে বাংলাদেশের প্রথম এক টাকার নোট, ভজনপুরে শাপলা এবং তিরনইহাটে মাছসহ নানান ইতিহাস নির্ভর ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে।
পিকনিক স্পট ডাকবাংলোসহ উপজেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ভাস্কর্য স্থাপনের মাধ্যমে সৌন্দর্যবর্ধন করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার সুবিধার্থে নির্মাণ করা হয়েছে সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং নদীর ওপারে বিস্তৃত সবুজ চা বাগানসহ দার্জিলিং শহরের নানান দৃশ্য। এছাড়া মহানন্দার পাড়ে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শনের পর মনোমুগ্ধকর সন্ধ্যা উপভোগ করতে পারছেন পর্যটকরা। মধ্য দুপুরের মাথার উপর সূর্যের কিরণে হীরের মতো জ্বলজ্বল করে হাসতে দেখা যাবে মহানন্দার চরের একেকটি বালুকণা। চলতি মৌসুমে কাঞ্চনজঙ্ঘা কয়েক বছরের তুলনায় ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে। তাই পর্যটকের ভিড়ও বেড়েছে কয়েক গুণ। পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক ড. সাবিনা ইয়াসমিন জানান, পর্যটকদের সুবিধার্থে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পর্যটন বান্ধব স্থাপনা নির্মাণসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। পর্যটন এলাকায় উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চলছে বলে জানান। ট্যুরিস্ট পুলিশ পঞ্চগড় জোনের ইনচার্জ আমিনুল ইসলাম জানান, তেঁতুলিয়া শান্তিপূর্ণ উপজেলা তবুও পর্যটকদের বাড়তি নিরাপত্তায় পর্যটকেরা যেন নির্বিঘ্নে ঘোরাফেরা করতে পারেন এ জন্য এখানে ট্যুরিস্ট পুলিশ কাজ করছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন