রফিকুল ইসলাম সেলিম : দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে এখন অচলদশা। পণ্যবোঝাই ৫০টি বৃহদাকার জাহাজের বিশাল বহর অলস বসে আছে সেখানে। নৌযান শ্রমিকদের টানা কর্মবিরতির কারণে মালামাল খালাস ও পরিবহন বন্ধ হয়ে পড়েছে। এতে করে বহির্নোঙ্গরে অর্ধশত জাহাজ এবং দেশের ৩৬টি ঘাটে ৬১১টি লাইটারেজ জাহাজে প্রায় ১৩ লাখ টন পণ্য আটকা পড়েছে। টানা ৩ দিন কাজ বন্ধ থাকায় বহির্নোঙ্গরে পণ্যবাহী জাহাজের বহর দীর্ঘ হচ্ছে। পণ্য খালাস না হওয়ায় বন্দর ছেড়ে যেতে পারছে না বিদেশী জাহাজ।
এতে করে ফের চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ জটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্যদিকে নৌপথে পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকায় শিল্প-কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বাজারে ভোগ্যপণ্যের সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে। দ্রুত এ অচলাবস্থার অবসান না হলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। চট্টগ্রাম চেম্বার এ অচলাবস্থা নিরসনে গতকাল (বৃহস্পতিবার) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেছে। মজুরি বাড়ানোসহ ৪ দফা দাবিতে নৌশ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে গত সোমবার রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে শ্রমিকেরা কর্মবিরতি পালন শুরু করে। গতকাল তৃতীয় দিনের মতো কর্মবিরতি পালিত হয়। এতে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গর পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে। বন্দরে যত পণ্য খালাস হয়, তার ৭০ শতাংশই হয় বহির্নোঙ্গরে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সেখানে পণ্য খালাসের অপেক্ষায় ছিল ৩৫টি বড় জাহাজ (মাদার ভেসেল)। আরও কয়েকটি জাহাজ গতকাল বহির্নোঙ্গরে ভিড়েছে। একদিকে নতুন জাহাজ আসছে অন্যদিকে পণ্য খালাস না হওয়ায় আগে আসা জাহাজগুলো বহির্নোঙ্গর ছেড়ে যেতে পারছে না। এতে করে সেখানে অচলদশা সৃষ্টি হয়েছে, বাড়ছে জাহাজ জট।
তবে বন্দরের কর্মকর্তারা দাবি করেন, জেটিতে কন্টেইনার ও সাধারণ পণ্য ওঠানো-নামানোর কার্যক্রম সচল আছে। ফলে রপ্তানিমুখী পণ্য পাঠাতে সমস্যা হচ্ছে না। চট্টগ্রাম বন্দরের মুখপাত্র ও সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মোঃ জাফর আলম (যুগ্ম সচিব) গতকাল রাতে ইনকিলাবকে জানান, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গরে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী নিয়ে ৫০টি বড় জাহাজ মালামাল খালাসের অপেক্ষা করছিল। তবে ধর্মঘটের কারণে খালাস বন্ধ রয়েছে। এর প্রভাবে চট্টগ্রাম বন্দরে তেমন কোন সমস্যা হবে না দাবি করে তিনি বলেন, ধর্মঘট শেষ হলে দ্রুত এসব পণ্য খালাস করতে হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর ও লাইটার জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে ৩৫টি বড় জাহাজ এবং সারা দেশের ৩৬টি ঘাট এলাকায় ৬১১টি জাহাজে ১৩ লাখ টনের বেশি পণ্য আটকা পড়েছে। পণ্য আটকা পড়ায় প্রতিদিন ক্ষতিপূরণ গুণতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও আমদানিকারকদের। জাহাজ ভাড়া নেয়ার চুক্তি অনুযায়ী বহির্নোঙরে বড় জাহাজ থেকে প্রতিদিন নির্ধারিত পরিমাণে আমদানি পণ্য খালাস করতে হয়। নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য খালাস করতে না পারলে জাহাজভেদে দৈনিক ১০-১২ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করতে হয় আমদানিকারকদের। ক্ষতিপূরণের এই অর্থ আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে যোগ হয়। এতে খুচরা পর্যায়ে পণ্যের দাম বেশি পড়ে।
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী নেতারা জানান, পণ্য খালাস এবং পরিবহন বন্ধ থাকায় বাজারে ভোগ্যপণ্যের সংকটের আশঙ্কা রয়েছে। অচলাবস্থার কারণে জাহাজ ভাড়াসহ নানারকম খরচে আমদানি ব্যয় বাড়ছে। এর প্রভাব পড়বে পণ্যমূল্যে। যথাসময়ে শিল্প-কারখানাগুলোতে কাঁচামাল পৌঁছাতে না পারলে উৎপাদন বিঘিœত হবে। সামগ্রিকভাবে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। আটকে পড়া পণ্যের মধ্যে শিল্পের কাঁচামালের সাথে রয়েছে চিনি, ডালসহ ভোগ্যপণ্য। আবার কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় সারও আটকা পড়েছে।
বন্দর সূত্রে জানা গেছে, বন্দরের বহির্নোঙ্গরে এখন ৩৫টি জাহাজ থেকে আমদানি করা গম, ডাল, চিনিসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য এবং সিমেন্টশিল্পের কাঁচামাল ক্লিংকার, নির্মাণকাজে ব্যবহৃত পাথর ও সার মিলিয়ে সাড়ে পাঁচ লাখ টন পণ্য খালাস হওয়ার কথা। বন্দরের একজন কর্মকর্তা জানান, এর আগে এক দফায় নৌ পরিবহন শ্রমিকরা এবং এর পরপর মালিকেরা ধর্মঘট পালন করে। ওই পাল্টাপাল্টি ধর্মঘট এবং ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে বন্দরে জাহাজ জটের সৃষ্টি হয়। সেই জট কাটিয়ে উঠার আগে ফের ধর্মঘট শুরু হওয়ায় নতুন করে বন্দরে জাহাজ জটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বহির্নোঙ্গরে পণ্য খালাসে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন শিপ হ্যান্ডেলিং অ্যান্ড বার্থ অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের একজন কর্মকর্তা জানান, কর্মবিরতির কারণে বহির্নোঙ্গর এখন পুরোপুরি অচল। তিনদিন সেখানে কোনো জাহাজ থেকে পণ্য খালাস হয়নি। বহির্নোঙ্গরে বড় জাহাজ থেকে লাইটার জাহাজে পণ্য স্থানান্তর করে দেশের নানা প্রান্তের ৩৬টি ঘাট এলাকায় নিয়ে পণ্য খালাস করা হয়। এ কাজে ৬১১টি জাহাজ নিয়োজিত আছে বলে লাইটার জাহাজ পরিচালনকারীদের সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের একজন কর্মকর্তা জানান। সে অনুযায়ী ঘাট এলাকা ও নদীপথে প্রায় ৭ লাখ ২২ হাজার টন পণ্য আটকা পড়েছে।
নৌশ্রমিকদের ধর্মঘটের ফলে কর্ণফুলী নদীর সদরঘাট, বাংলাবাজারসহ ১৬টি ঘাটে পণ্য ওঠানামার কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। বেকার হয়ে পড়েছে শত শত ঘাট শ্রমিক। কাজ বন্ধ থাকায় আর্থিক সংকটে পড়েছে এসব শ্রমিকেরা। নৌশ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ওয়েজুল ইসলাম জানান, তাদের ৪ দফা দাবি যৌক্তিক। এসব দাবিতে তারা ধর্মঘট ডেকেছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে।
প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা
এদিকে নৌ পরিবহন মন্ত্রীর পর এবার সংকট নিরসনে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছে চট্টগ্রাম চেম্বার। চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম গতকাল এক জরুরী বার্তায় নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘট প্রত্যাহারে প্রধানমন্ত্রীর এ হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এতে তিনি বলেন, ২২ আগস্ট সন্ধ্যা থেকে নৌযান শ্রমিকরা সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেছে এবং সারাদেশে লাইটারেজ জাহাজ চলাচল ও পণ্য পরিবহন বন্ধ রয়েছে। এতে করে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গর থেকে দেশব্যাপী শিল্পের কাঁচামাল ও পণ্য পরিবহন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি জাহাজজট এবং কন্টেইনারজট নতুন সংকট তৈরি করার আশংকা দেখা দিয়েছে। জাহাজের টার্ণ এরাউন্ড টাইম বৃদ্ধি এবং কন্টেইনারের ওভারস্টের কারণে ডেমারেজ চার্জ, পণ্য আমদানি-রপ্তানি ব্যয় বৃদ্ধিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সাধারণ ভোক্তাদের অতিরিক্ত মাশুল গুণতে হবে বলে মনে করেন চেম্বার সভাপতি। গত প্রায় ৪ দিন যাবত পরিবহন খাতের সবচেয়ে সাশ্রয়ী, শিল্প ও উন্নয়নের অপরিহার্য যোগাযোগ খাত হিসাবে নৌপরিবহন সেক্টরে চলমান অচলাবস্থা নিরসনে কোন কর্তৃপক্ষ অদ্যাবধি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় চেম্বার গভীর উদ্বেগ এবং হতাশা প্রকাশ করছে। উক্ত সেক্টরে কর্মরত পেশাজীবীদের কোন যৌক্তিক আবেদন থাকলে উদ্যোক্তা বিনিয়োগকারীদের সাথে আলোচনায় বসে উৎপাদন ও অগ্রগতি সহায়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য চেম্বার সভাপতি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। তিনি পত্রে উল্লেখ করেন, ইতোপূর্বে ২১ এপ্রিল থেকে ২ মে পর্যন্ত প্রথমে শ্রমিক ও পরে মালিকদের ধর্মঘটের ফলে নৌপণ্য পরিবহন বন্ধ থাকার কারণে জাহাজ জট, কন্টেইনার জট এবং যানজটের কারণে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে সৃষ্ট অচলাবস্থা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিগত কয়েক মাসে বন্দরের কন্টেইনার জট কিছুটা হ্রাস পেলেও নতুন করে শ্রমিক ধর্মঘট সার্বিক পরিস্থিতিকে আবারও বিশৃঙ্খলার দিকে ধাবিত করবে। তাই চলমান নৌযান শ্রমিকদের ধর্মঘট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানান মাহবুবুল আলম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন