ঢাকার ইন্দিরা রোডের এক ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান জুয়েল। ব্যবসায়িক সুবিধার কারণে পরিবারের সঙ্গে থাকেন উত্তরা। সেখানে গাড়ির ব্যবসা রয়েছে তার। প্রায়ই ছুটে যান বিভিন্ন দেশে। এই ব্যস্ততার মধ্যেই যত্ম করে সময় দেন সদ্য এমবিবিএস পাস করা এক তরুণীকে। তরুণী যখন ধানমন্ডি এলাকার একটি প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত, তখনই পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। তারপর প্রেম। চুটিয়ে প্রেম বা লং ড্রাইভ.. সবকিছুতেই দু’জনের প্রচন্ড আগ্রহ। কিন্তু শর্ত দিয়ে দেন জুয়েল। প্রথম দেখাতেই স্বামী-স্ত্রীর মতো সময় কাটাবেন। একদম হানিমুন বলা যায়। সেটা ঢাকার বাইরে কোথাও। প্রথম দেখাতেই সিলেটে বেড়াতে গিয়েছিলেন দু’জন। শাহজালাল উপ-শহর এলাকার একটি তারকা হোটেলে ওঠেন তারা। তিন রাত ছিলেন ওই তারকা হোটেলে। সেখানেই পর্নো স্টাইলে বিভিন্ন ভিডিও ধারণ করা হয়। ভিডিওগুলোর বেশিরভাগই গোপন ক্যামেরায় ধারণকৃত। অবশ্য দু’জনের দেখা হওয়ার আগেই পর্নো বিষয়ে জুয়েল বেশ শিখিয়েছে ওই তরুণীকে। ভার্চুয়াল শিক্ষা। চ্যাট করতো রাতভর। কথা হতো অডিও, ভিডিও কলে। তারপর দুপুর পর্যন্ত ঘুম। হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারে পর্নোভিডিও পাঠাতো জুয়েল। পাঠাতো এ ধরণের ছবি। শুরুতে তরুণী বকা দিতেন খুব। তবুও থামতো না জুয়েল। যদিও কৌতূহল ছিলো তরুণীরও। এভাবেই প্রশিক্ষিত হয়ে ওঠেন তরুণী ডাক্তার। দেখা না হলেও ততদিনে তাদের সম্পর্ক বেশ গভীর। কথায় কথায় উত্তেজনা সৃষ্টি করতো জুয়েল। পরিচয়টা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বেশ কয়েক বছর আগে। ফেসবুকের ছবি দেখইে একে-অন্যকে পছন্দ করেন। সিলেটে হোটেল কক্ষে যাওয়ার পর ফ্রেশ হওয়ার আগেই শুরু হয় জুয়েলের ভালোবাসার অত্যাচার। অবশ্য তার আগেই মাথায় হাত রেখে জুয়েলের প্রতিশ্রুতি নেন তাহমিনা। শিগরিই বিয়ে করবেন তারা। কখনও একে-অন্যকে ছেড়ে যাবেন না ইত্যাদি। তরুণী যেনো স্বপ্নের রাজ্যে। উদার মনে নিজেকে উজাড় করে দেন। এভাবে একে একে তিন রাত। ফিরে যাবেন তারা।
এরমধ্যেই ঘটে ঘটনাটি। একটা ফোন কল রিসিভ করে তরুণী ওই ডাক্তার বুঝতে পারেন জুয়েল বিবাহিত। এরপর ক্ষোভে দুঃখে জুয়েলের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। কিন্তু জুয়েল নাছোড় বান্দা। তরুণী ডাক্তারের নগ্ন-অর্ধনগ্ন ছবি ম্যাসেঞ্জারে দিয়ে মেয়েটিকে বøাক মেইল করতে থাকে। এক পর্যায়ে তরুণী পুলিশের শরনাপন্ন হন। পুলিশ জুয়েলকে গ্রেফতার করে। গত ৭ জানুয়ারি রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ও লেভেলের এক ছাত্রী তার ছেলে বন্ধু ইফতেখার ফারদিন দিহানের বাসায় যান। পরে ওই বাসায় তার সাথে মেলামেশা করেন। এক পর্যায়ে এই ছাত্রীকে অচেতন অবস্থায় ধানমন্ডির আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে নিয়ে যান দিহান। তবে তার আগেই মেয়েটির মৃত্যু হয়। পরদিন ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, তার শরীরের কোথাও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া না গেলেও যৌনাঙ্গ ও পায়ুপথে ক্ষত চিহ্ন পাওয়া গেছে। বিকৃত যৌনাচারের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে দিহানের দেয়া তথ্যের বরাত দিয়ে পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার সাজ্জাদুর রহমান বলেছিলেন, দুইজনের সম্মতিতে তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক হয়। তবে মেয়েটির বাবা মামলায় অভিযোগ করেছেন, তার মেয়েকে কলাবাগান ডলফিন গলির বাসায় ডেকে নিয়ে ‘ধর্ষণ করেন’ দিহান। প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে অচেতন হয়ে পড়লে বিষয়টি ভিন্নখাতে নেয়ার জন্য আসামি নিজেই তাকে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে নিয়ে যান।
সামাজিক অবক্ষয়ের এরকম ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। তরুণী ডাক্তার প্রতারিত হয়ে পুলিশের শরনাপন্ন না হলে জুয়েল অধরাই থেকে যেতো। কলাবাগানে স্কুল শিক্ষার্থীর মৃত্যু না হলে এই ঘটনাও কেউ জানতো না। বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের সমাজ ব্যবস্থা ও অবিভাবকদের উদাসীনতার কারণেই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে যুব সমাজ। এতে দিন দিন বেড়েই চলেছে অবাধ মেলামেশা। উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েরা নিজেদের মত করে যৌনতায় জড়িয়ে পড়ছে। এতে মৃত্যুর মত ঘটনাও ঘটছে। মানবিকতা, নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ধর্মীয় শিক্ষা, পারিবারিক শিক্ষার অভাবে এমন অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম ইনকিলাবকে বলেন, সব বয়সের একটি ধর্ম আছে। কলাবাগানে যে ঘটনা ঘটেছে, এটা অস্বাভাবিক বা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা মনে করি না। সময় ও পরিবেশের কারণে এই ঘটনা ঘটেছে। কলাবাগানের ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক জানিয়ে তিনি বলেন, এ রকম ঘটনা আরো হচ্ছে। তিনি বলেন, যেসব বাবা-মা’রা চাকরি করে। সেই বাসাগুলোতে তাদের সন্তানরা একা থাকছে। এক্ষেত্রে এমন ঘটনা আরো ঘটছে। হয়তো এসব বিষয় আমরা জানি না। তবে মূল্যবোধ ও নীতি নৈতিকতার অভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশে মূল্যবোধ চর্চার কোনো ব্যবস্থা নেই। স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কোথাও মূল্যবোধ চর্চার কোনো ব্যবস্থা নেই। ধর্মের পাশাপাশি মূল্যবোধ জাগ্রত করার জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মূল্যবোধ শিক্ষা দিতে হবে। তা হলে এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে।
এদিকে, অবাধ মেলামেশা থেকে যুব সমাজ বিকৃত যৌনাচারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক ইন্টারনেট ব্যবস্থা তাদেরকে ভিন্ন পথে ধাবিত করছে। কলাবাগানের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত দিহানের বিকৃত যৌনাচারের আলামত পেয়েছে পুলিশ। সেজন্য সে যৌন উত্তেজক কিছু একটা ব্যবহার করেছে বলে পুলিশের ধারনা। দেশে বিকৃত যৌনরুচির কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন পণ্যের প্রসার ক্রমেই বাড়ছে। একটি কল করেই যে কেউ অনলাইনের বিভিন্ন নামি-বেনামি প্রতিষ্ঠান থেকে মারাত্মক ক্ষতিকর এসব পণ্য হাতে পেয়ে যাচ্ছেন। এসব পণ্যের ভেতর রয়েছে যৌন উত্তেজক ভায়াগ্রা ট্যাবলেটও। এই ট্যাবলেট কিনতে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র বাধ্যতামূলক হলেও যে কেউ ফার্মেসিতে বা অনলাইনে অর্ডার দিয়ে কিনতে পারছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই ধরনের পণ্য আমাদের তরুণ সমাজকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
কলাবাগানের ঘটনা ছাড়াও রাজধানীতে এর আগে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাতেও এসব পণ্য ব্যবহারের আলামত পাওয়া গেছে। মাদকের ভয়াল ছোবলের মতোই বিকৃত যৌনরুচির এসব উপাদান বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। প্রশ্নের মুখে পড়েছে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক সালমা আক্তার ইনকিলাবকে বলেন, আমরা বাচ্চাদের কোথাও শিখতে দিচ্ছি না। বাচ্চারা স্কুল ও কোচিং সেন্টারে থাকে, বাড়িতে আসলেও শুধু লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বর্তমানে খুব অল্প বয়সে স্কুল জীবনে চলে যাচ্ছে। বাবা-মারাও চাকরি বা অন্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আগে তো যৌথ পরিবার ছিল। সেখানে অনেক আত্মীয়-স্বজন ছিল। তাই সেই সময় শিশু-কিশোররা অনেক কিছু শিখতে পারত। বড়দের কাছে সব কিছু শেয়ার করতে পারত। কিন্তু বর্তমানে কিশোর-কিশোরীরা কিছু শেয়ার করে না। এক্ষেত্রে তারা তাদের বন্ধু-বান্ধবের কাছে বিষয়টি শেয়ার করে। তাই বন্ধু-বান্ধব তাদের অভিজ্ঞতা থেকে বিষয়টি সমাধান দেয়ার চেষ্টা করে। এতে অপরাধ প্রবণতায় জড়িয়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা থাকে। তবে স্কুল-কলেজে যদি কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা থাকত তা হলে এ ধরনের অপরাধ কম হত।
তিনি বলেন, বর্তমান সময়ের ছেলে-মেয়েরা ইন্টারনেটে প্রচুর সময় ব্যয় করছে। এগুলো আমরা দেখছি না। বর্তমানে গ্রাম ও বস্তির ছেলে-মেয়েরা সম্পর্ক করে পালিয়ে যাচ্ছে। বাবা-মায়েরা বিষয়টি জানতেও পারছে না। এছাড়াও অনলাইনে শিক্ষা ব্যবস্থা চলে যাওয়ার কারণেই বাবা-মায়েরা সন্তানের পাশে বসেই বুঝতে পারছে না তারা কি করছে। বাচ্চারা যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সরাসরি ক্লাসে অংশ নিচ্ছে, তখন শিক্ষকরাও তাদের অস্বাভাবিক অবস্থা বুঝতে পারে।
তিনি বলেন, আমাদের ছোট বেলায় শিখানো হতো, ‘সকালে উঠে আমি মনে মনে বলি, সারা দিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি’। আমাদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। বাবা-মাকে দেখতে হবে। আত্মীয়দের দেখতে হবে। এখনকার বাচ্চারা সামাজিক দায় একটুও শিখে না। তাদের কাছে এখন নিজের চাওয়া, নিজের পছন্দ এসব বিষয় বেশি গুরুত্ব পায়। বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা চলে আসছে। ব্যক্তিগত চাওয়া বেড়ে গেছে। ধর্মীয় ও সামাজিক শিক্ষার অভাবের কারণে এমন হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। বলেন, সামাজিক দায়বদ্ধতা শিখালে মন ও সময় ভালোভাবে কাটবে। আগে আমরা যখন কোথায় গেছি, কি করছি, সেটা বাবা-মাকে বলে গেছি। আমরাও তো এই বয়স ছিল। আমাদের সময় এইসব বিষয় ছিল না। আমাদের সময়ও এক সাথে তরুণ-তরুণী লেখাপড়া করেছি। কিন্তু এসব বিষয় করার চিন্তাও মাথায় আসেনি। সামাজিক ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া তারা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে।
এদিকে, সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, ছেলে বা মেয়ে কোথায় যায়, কী করে সেই খোঁজ অভিভাবকদের রাখতে হবে। তা হলে এ ধরনের অপরাধ ঘটবে না। সন্তান জন্ম দিয়েছেন, দায়দায়িত্ব নিতে হবে। এটা পরিবারের সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব। সন্তানদের মধ্যে নৈতিকতা, মূল্যবোধের সঞ্চার করার দায়িত্ব পরিবারের, সমাজের। পুরান ঢাকার ইসলামবাগ বড় মসজিদের খতিব ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব শাইখুল হাদিস মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী বলেছেন, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে বাংলাদেশে মুসলিম তরুণ-তরুণীদের আজ ধর্মীয় বিধি-নিষেধ যেভাবে মানার কথা ছিল সে ভাবে মানছে না। উল্টো বিজাতীয় কৃষ্টি-সভ্যতার উন্মাদনায় তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। ধর্মীয় অনুশাসন নেই বলেই আজ নারী ধর্ষণ ও নির্যাতন ভীষণ ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, নির্লজ্জতা ও বেহায়াপনা এখন মহামারির রূপ ধারণ করায় বর্তমানে সন্তানেরা পিতা-মাতার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। পরিত্রাণ চাইলে সর্বক্ষেত্রে ধর্মশিক্ষা ও ধর্মচর্চা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমীরে শরীয়ত মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী বলেছেন, ঢাকার কলাবাগানে স্কুলছাত্রী নিহতের ঘটনা গোট জাতির জন্য লজ্জাজনক। ধর্মীয় অনুশাসন না মানার কারণেই দেশে ধর্ষণ ও যিনা-ব্যভিচার বেড়ে চলেছে। বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক ইসলাম কখনো সমর্থন করে না। নারী-পুরুষদের অবাধ মেলামেশা বন্ধ না হলে ধর্ষণের মত অনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ করা সম্ভব হবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন