মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

ধর্মের অনুসরণেই জীবনের প্রশান্তি

প্রকাশের সময় : ২৮ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

॥ শেষ কিস্তি ॥
বিভিন্ন জিনিসের জন্য কর প্রদান করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে সঞ্চিত সম্পদ, ব্যবসাসামগ্রী, সরকারি চারণ ভূমিতে পালিত গবাদিপশু, খনিজসম্পদ, পানিতে উৎপন্ন দ্রব্যাদি প্রভৃতি।
এ সমস্ত দ্রব্যাদির উপর আরোপিত কর বা শুল্কের পরিমাণের মধ্যে তারতম্য থাকতে পারে।
রাসূলে করীম (সা.)-এর আমলে শুল্ক বা করের নিয়মনীতিগুলো অতটা কঠোর ছিল না। অথবা এটা এমনও কোনো বিষয় ছিল না যেখানে কোনোরকম পরিবর্তন বা সংশোধনের সুযোগ নেই। ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি যে, রাসূল (সা.) নিজে তায়েফবাসীদের যাকাত প্রদানের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীদের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণের নজির রয়েছে। আবু উবায়েদের সূত্রে বর্ণিত আছে যে, মহান খলীফা হজরত উমর (রা.) মদীনায় আমদানিকৃত খাদ্যসামগ্রীর উপর থেকে কর বা শুল্কের পরিমাণ হ্রাস করেছিলেন। রাসূল (সা.)-এর জীবদ্দশায় কখনো এমন ঘটনা ঘটেছে যে, তিনি মুসলমানদের নিকট থেকে বিশেষ ধরনের কর প্রদানের জন্য আবেদন করেছেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে যে, বহিঃশত্রুর আগ্রাসনের মুখে তিনি দেশের প্রতিরক্ষার জন্য এধরনের করের জন্য আবেদন জানাতেন। বস্তুতপক্ষে এ ঘটনাবলী থেকে আইনবেত্তাগণ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, প্রয়োজনবোধে সরকার নতুন নতুন শুল্ক আরোপ করতে পারে। আরবি পরিভাষায় এটাকে বলে নাবায়িব। তা ছাড়া কোন কোন বিষয়ের উপর কর আরোপ করা যাবে, অথবা করের হার কত হবে কুরআন মজীদে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই।
তবে সরকারি বাজেটের প্রধান প্রধান খাত এবং রাষ্ট্রীয় খরচ সম্পর্কে কুরআন মজীদে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। “সাদাকা তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাস মুক্তির জন্য, ঋণ ভারাক্রান্তদের জন্য, আল্লাহর পথে সংগ্রামকারী ও মুসাফিরদের জন্য” (৯ : ৬০)। সাদাকা এবং যাকাত মোটামুটিভাবে সমঅর্থবোধক শব্দ। এটা কেবলমাত্র মুসলমান নাগরিকদের নিকট থেকে আদায় করা হয়। আবার অমুসলিম নাগরিকদের নিকট থেকে আদায়যোগ্য পাওনাকে বলা হয় খারাজ,
জিযিয়া, গনীমাহ প্রভৃতি। এগুলো সাদাকা বা যাকাতের অন্তর্ভুক্ত নয়। আবার এ দু’ধরনের অর্থ বা সম্পদ থেকে যারা সুবিধা ভোগ করবে, তাদের মধ্যেও প্রচুর প্রভেদ রয়েছে। রাজস্ব আয় সম্পর্কে নিয়মনীতি ও বিধি-বিধান প্রণয়ন করা আইনবিদগণের দায়িত্ব। অপরদিকে রাষ্ট্রীয় খরচের নিয়মনীতিগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে কুরআন মজীদে। যাকাতের অর্থ যারা ভোগ করতে পারেন তাদেরকে আটটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। উপরের আয়াতে তাদের বিবরণ রয়েছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে, এই আটটি শ্রেণীর মধ্যে রাসূলে করীম (সা.)-এর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। নিম্নে উপরোক্ত আয়াতের উপর কিছুটা আলোকপাত করা হলো। আয়াতের ব্যাপকতা ও মর্মকথা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে এটা সহায়ক হবে।
খলীফা হজরত উমর (রা.) ছিলেন নবী করীম (সা.)-এর আদর্শের একজন অন্যতম ব্যাখ্যাতা। তাঁর বর্ণনা মতে নিঃস্ব বলে দরিদ্র বা মিসকীনকে। আর অভাবী মুসলমানকে বলে ফকীর। অবশ্য অভাবীও মিসকীন উভয়ের সাহায্যের প্রয়োজন। এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, অমুসলিমদের নিকট থেকে রাজস্ব হিসাবে যে অর্থ পাওয়া যায়, তা সাদাকার অন্তর্ভুক্ত নয়। তবু ইসলাম মুসলমানদের নিকট থেকে আদায়কৃত রাজস্ব থেকে অমুসলিমদের সুবিধা লাভের সুযোগ দিয়েছে।
রাষ্ট্রের রাজস্ব আদায়ের কাজে যারা নিয়োজিত রয়েছে তাদেরকে কালেক্টর বলে। অপরদিকে যারা রাজস্ব খরচের দায়িত্বে নিয়োজিত, তাদেরকে বলে কন্ট্রোলার এবং অডিটর। বস্তুতপক্ষে বেসামরিক কর্মকা- থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা পর্যন্ত গোটা প্রশাসনই কোনো না কোনোভাবে রাজস্ব সংগ্রহ বা ব্যয়ের সাথে জড়িত। এদিক থেকে বিবেচনা করলে প্রশাসনের সমস্ত বিভাগই রাজস্ব সুবিধাপ্রাপ্তদের তালিকার মধ্যে এসে যায়।
মুসলমানদেরকে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর লোকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। প্রখ্যাত ফকীহ আবু ইয়ালা আল ফাররা (আল আহকাসুস সুলতানিয়াহ, পৃ. ১১৬)-এর মতে, এদেরকে ৪টি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। প্রথমত যারা মুসলমানদের উপকারে আসতে পারে। দ্বিতীয় যারা ইসলামের প্রতি
আকৃষ্ট হয়েছে। তৃতীয়ত এমন কিছু লোক যারা মুসলমানদের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকবে। চতুর্থত যাদের মাধ্যমে তাদের গোত্র বা গোষ্ঠীর লোকজনকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা সম্ভব হবে।
সাধারণ অর্থে বন্দিমুক্তি শব্দটি দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়। প্রথমত দাসত্বের শৃঙ্খলা থেকে ক্রীতদাসদের অব্যাহতি প্রদান, দ্বিতীয়ত যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিপণ প্রদান। এখানে ক্রীতদাস সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত করা যেতে পারে। ইসলামের পূর্বে বিশ্বের অন্য কোনো ধর্মই দাসত্বের দুরাবস্থা দূরীকরণের প্রতি নজর দেয়নি। ঐতিহাসিক সারাকসীর বর্ণনায় উল্লেখ আছে যে, প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সর্বপ্রথম দাস প্রথাকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন। কুরআন মজীদে এরূপ বিধান রয়েছে যে, দাস-দাসীদের মধ্যে কেউ মুক্তি বাবদ অর্থ পরিশোধ করার প্রস্তাব দিলে মালিক তা প্রত্যাখ্যান করতে পারে না। এমন কি দাসকে অর্থ উপার্জন এবং মুক্তি বাবদ প্রয়োজনীয় অর্থ জমা করার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ দেয়ার জন্য আদালত মালিককে বাধ্য করতে পারে। উপরন্তু মুসলিম সরকার মুক্তি প্রত্যাশী দাসদের সাহায্যে বাৎসরিক বাজেট অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা রাখে।
উপরের আলোচনার সূত্র ধরে কেউ বলতে পারে যে, ইসলামে দাস প্রথার অনুমোদন ছিল। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে যে এরও কতগুলো উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমত যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে যারা সর্বস্ব হারায়, নিঃস্ব হয় এবং যারা স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেনিÑ তাদের আশ্রয় দানের ব্যবস্থা করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। দ্বিতীয়ত তাদেরকে ইসলামী পরিম-লের মধ্যে রেখে ইসলামী আচরণ ও ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে জ্ঞান দিতে হতো। উল্লেখ্য যে, এখানে জুলুম বা শোষণের কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া ইসলামে একজন মানুষ আরেকজন মানুষের উপর শোষণ চালাতে পারে না। উপরন্তু এখানে যে দাসের কথা বলা হয়েছে তারা ছিল ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধের মাধ্যমে আটক বন্দী। লণ্ঠন বা অপহরণের মাধ্যমে কেউ কাউকে দাসত্বে আবদ্ধ করতে পারে না। এমনকি ইসলামে পিতা-মাতা স্বেচ্ছায় সন্তানকে দাস হিসাবে বেচা-বিক্রী করতে পারে না।
আবার যারা ঋণভারে নিমজ্জিত, তাদেরকে সাহায্য প্রদান করা যেতে পারে। ঋণগ্রস্তদের সাহায্যার্থে খলীফা হজরত উমর (রা.) সুদমুক্ত ঋণ প্রদানের কর্মসূচি চালু করেছিলেন। দয়াপরবশ ও সদিচ্ছা নিয়ে যে কাজ করা হয় তা সবই ফী সাবিলিল্লাহর অন্তর্ভুক্তি। দুনিয়ার বুকে আল্লাহর শাসন কায়েম করাই ইসলামের উদ্দেশ্য। সে কারণেই ফকীহগণ ইসলামের প্রতিরক্ষার্থে সমরাস্ত্র ক্রয়করাকে দানশীল কাজ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।
মুসাফিরদেরকে আতিথেয়তা করা ছাড়াও আরো অনেকভাবে সাহায্য করা যেতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে মুসাফিরদের যাতায়াতের পথে স্বাস্থ্য ও আরামের নিশ্চয়তা দেয়া, সফরকালীন নিরাপত্তা বিধান করা, তাদের সুখও কল্যাণের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। এ স্থলে মুসাফির স্বদেশী কি বিদেশী, মুসলিম কি অমুসলিম তা বিবেচ্য বিষয়।
উপসংহার : এ পর্যন্ত ইসলামের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে একটি বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হলো। এ স্থলে একথা পুনরায় উল্লেখ করাটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, উল্লিখিত আচার-অনুষ্ঠানসমূহের যথাযথ প্রতিপালন এবং বিভিন্ন বিধানসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধনই হলো ইসলামী জীবন ব্যবস্থার মূলনীতি। কুরআন মজীদে এ নির্দেশের মধ্য দিয়ে মূলত, একইসঙ্গে এবং একইসময়ে এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করার কথা বলা হয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন