সরকারি সিদ্ধান্তের তোয়াক্কা না করে নামমাত্র মূল্যে ঢাকার ২শ’ ৬৭ বিঘা সরকারি জমি লিজ বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতির নামে। কিন্তু ৩০ বছরে হাত বদল হয়ে অধিকাংশ প্লটই অন্যের দখলে। সরকারি খাস জমিতে এখন গগণচুম্বি ভবন। বড় এই দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগের অনুসন্ধান করছিল দুদক। বছর চারেক আগে ধামাচাপা দেয়া হয়েছে সেই অনুসন্ধানটিও। ফলে দুর্নীতি সংঘটিত হলেও মামলা হয়নি এ ঘটনায়। ১৩ বছরেও বাস্তবায়ন করা হয়নি টাস্কফোর্সের সুপারিশ।
জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ (জাগৃক) সূত্র জানায়, সমবায় সমিতির নামে আর কোনো খাস জমি বরাদ্দ দেয়া হবে না- এই মর্মে সিদ্ধান্ত ছিল সরকারের। এ সিদ্ধান্ত কোনো আদালত দ্বারা বাতিল কিংবা স্থগিত হয়নি। এ সিদ্ধান্তের মধ্যেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ঢাকা জেলাধীন বিভিন্ন সমিতিকে লিজ বরাদ্দ দেয়া হয়। এতে সেময়কার বাজারদর অনুযায়ী ১৩৭ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয় সরকারের। বর্তমান হিসেবে যা হাজার কোটি টাকার বেশি।
১৭টি শর্তে বরাদ্দ দেয়া এসব প্লটের বর্তমান ব্যবহারকারিরা শর্ত ভঙ্গ করলেও বাতিল হয়নি কোনো বরাদ্দ। বরং জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ও সমবায় অধিদপ্তরে অর্থ ঢেলে চলছে যথেচ্ছ ব্যবহার। অধিকাংশই প্লটেই নির্মাণ করা হয়েছে বহুতল ভবন। ২০০৮ সালে গুরুতর অপরাধ ও দুর্নীতি দমন সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটি (এনসিসি) পরিচালিত টাস্কফোর্স সরকারি জমি বরাদ্দকারী ও গ্রহণকারি সমিতিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিল। কিন্তু পরবর্তী সরকার এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
এদিকে দুদক সূত্র জানায়, ১৯৮৪ সালের ২৫ জানুয়ারি তৎকালিন সামরিক আইন প্রশাসক এই মর্মে একটি আদেশ (পত্র নং-৬৫০১/৩/হাউজিং/এস.এল-২/১১১২) জারি করেন যে, ‘Government shall not acquire any land for any Cooparative
Society nor shall it lease any khas land to any such society’. অর্থাৎ- সরকার কোনো সমবায় সমিতির জন্য জমি অধিগ্রহণ করবে না কিংবা কোনো সংঘকে লিজ প্রদান করবে না। এ সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯৮৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন সমবায় মন্ত্রণালয় তার অধীনস্থ সমবায় সমিতি নিবন্ধককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চিঠি (স্মারক নং-এস-১/১২৫-৩২/৮৫/৫৫) দেয়।
সরকারি আদেশ অনুসারে কয়েকবছর সমবায় সমিতিকে সরকারি জমি লিজ বরাদ্দ বন্ধও ছিল। কিন্তু ১৯৯২ সালের ২৮ জুলাই কুমিল্লা সমবায় সমিতিকে ৩১৬ বর্গফুট সরকারি জমি লিজ বরাদ্দ (নং-৩৭৪৯) দিয়ে এ আদেশ অগ্রাহ্য করে তৎকালিন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। পরে ১৯৯৩ সালে ‘জাতীয় গৃহায়ণ নীতিমালা’ প্রণয়ন করে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ।
নীতিমালার ৫, ৭ ও ১২ বিধিতে বলা হয়, সমাজের নিম্নমধ্য এবং উচ্চ আয়ভুক্ত সকল শ্রেণির মানুষের গৃহ নির্মাণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে বেসরকারি গৃহ নির্মাণ সংস্থা এবং সমবায় সমিতিগুলোর কর্মকান্ডকে উৎসাহিত করতে হবে। তাদেরকে ‘বাজার দর’ অনুযায়ী বিভিন্ন সুবিধাজনক স্থান/শহরের কেন্দ্রস্থলে সরকারি জমি বরাদ্দ করতে হবে, যাতে তারা আগ্রহী ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়।
১৯৮৪ সালের সরকারি সিদ্ধান্ত ও আদেশের পরিপন্থী এ নীতিমালার আওতায় ১৯৯৩ সাল থেকে পুরোদমে সমবায় সমিতিকে কম মূল্যে সরকারি জমি লিজ বরাদ্দ শুরু হয়। নামমাত্র মূল্যে তুলে দেয়া হয় বেসরকারি ব্যক্তিবর্গের হাতে।
সূত্রমতে, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কথা বলে বিঘা প্রতি মাত্র ১৬ লাখ টাকা দরে সমবায় সমিতিগুলোকে বরাদ্দ দেযা শুরু করে গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। পরে ২০ লাখ টাকা বিঘা দরে কয়েকটি সমিতিকে বরাদ্দ দেয়। অথচ সে সময় সাব-রেজিস্ট্রি অফিস নির্ধারিত জমির মূল্য (বাজার দর) ছিল প্রতি বিঘা ৬০ লাখ টাকা। এ হারে ১৯৯২ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ১৪০ দশমিক ১০১১ বিঘা জমি লিজ বরাদ্দ দেয়া হয় বিভিন্ন সমবায় সমিতিকে।
২০০১ সালে ২৬ দশমিক ৪০৮৪ বিঘা জমি লিজ বরাদ্দ দেয়া হয় কয়েকটি সমবায়কে। দলিলে এসব জমির মূল্য ধরা হয় বিঘা প্রতি ২ কোটি টাকা। যা ওই সময়ের বাজার দরের চেয়ে অনেক কম। তৎকালিন সরকারের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অসদুদ্দেশ্য হাসিল, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যক্তিস্বার্থ এবং সমিতির নামে সরকারি জমি স্থানীয় প্রভাবশালীদেরকে দিয়ে দেয়াই ছিল এসব লিজ বরাদ্দের উদ্দেশ্য।
সরকারি জমির জন্য আবেদনকারী সমিতিগুলোর অধিকাংশই ছিল নামসর্বস্ব। শুধুমাত্র সরকারি জমি গ্রাস করার লক্ষ্যেই এগুলোর জন্ম। কোনো যাচাই-বাছাই কিংবা মানদন্ড বিচার না করেই গণহারে দেয়া হয়েছে লিজ বরাদ্দ। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত নিম্ন আয়ের মানুষ এগুলোর কোনো কার্যক্রমই নেই। সমিতির কার্যকরি কমিটিতে দরিদ্র নিম্নআয়ের ব্যক্তিদের রাখা হলেও প্রকৃত পরিচয় গোপন করে সদস্য হিসেবে রয়েছেন রাজনৈতিক, পেশাজীবী নেতা, স্থানীয় প্রভাবশালী ও বিত্তবানেরা। দলিলে এক ধরনের মূল্য উল্লেখ করা হলেও প্রকৃত লেনদেন হয়েছে অনেক বেশি অর্থ।
২০০৮ সালে গুররুতর অপরাধ ও দুর্নীতি দমন সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটি (এনসিসি) এবং দুদক কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে পরিচালিত টাস্কফোর্সের অনুসন্ধানে সরকারি জমি হরিলুটের এ বিষয়টি সর্বপ্রথম আলোতে আসে। সংস্থার তৎকালিন সহকারী পরিচালক যতন কুমারের নেতৃত্বে গঠিত চার সদস্যের এ টাস্কফোর্সে ছিলেন মেজর মাসুম এবং সহকারী পুলিশ সুপার মুনির। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, ১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিধি বহির্ভুতভাবে, নামমাত্র মূল্যে অন্তত ২৯টি সমবায় সমিতিকে সরকারি জমি লিজ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
জমিপ্রাপ্ত সমিতিগুলোর মধ্যে রয়েছে, মোহাম্মদীয়া মার্কেট ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লি:, রূপনগর গভ: হাউজিং এস্টেট বহুমুখি সমবায় সমিতি, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কল্যাণ সমিতি, পল্লবী থানা মুক্তিযোদ্ধা বহুমুখি সমবায় সমিতি লি:, ঝালাই ও কর্মকার বহুমুখি সমবায় সমিতি লি:, কুমিল্লা সমবায় সমিতি, বৃহত্তম ময়মনসিংহ সমিতি লি:, রূপসী বাংলা সমবায় সমিতি, যমুনা বহুমুখি সমবায় সমিতি, মুক্ত বাংলা বহুমুখি কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি:, রূপনগর ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লি:, মুসলিম বাজার বহুমুখি সমবায় সমিতি লি:, গরিবে নেওয়াজ বহুমুখি সমবায় সমিতি লি:।
নিউ ঢাকা বহুমুখি সমবায় সমিতি লি:, সেক্রেটারি ১ নং মুক্তিযোদ্ধা বহুমুখি সমবায় সমিতি লি:, ছিন্নমূল বণিক সমবায় সমিতি লি:, রজনীগন্ধা বহুমুখি সমবায় সমিতি লি:, আমানত বহুমুখি সমবায় সমিতি লি:, উত্তরণ বহুমুখি সমবায় সমিতি লি:, রূপসী বাংলা সমবায় সমিতি লি:, মিরপুর ভাই ভাই ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি, সোনার বাংলা বহুমুখি সমবায় সমিতি লি:, রূপনগর মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবার পুনর্বাসন বহুমুখি সমবায় সমিতি লি:, পল্লবী থানা মহিলা পূনর্বাসন বহুমুখি সমবায় সমিতি লি:, মিরপুর ৪নং ওয়ার্ড মৎস্য ব্যবসায়ী বহুমুখি সমবায় সমিতি লি:, চাকরিজীবী সিরাজগঞ্জ বহুমুখি সমবায় সমিতি লি: এবং গৃহসংস্থা পরিদপ্তর কল্যাণ সমিতি। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এখন এসব সমিতির কমিটিতে রয়েছেন।
সূত্রমতে, টাস্কফোর্স এসব সমিতির নামে স্বল্প মূল্যে বরাদ্দ প্রদানকে ১৯৮৪ সালের সরকারি আদেশ ও ১৯৯৩ সালে প্রণীত জাতীয় গৃহায়ণ নীতিমালা পরিপন্থি হিসেবে চিহ্নিত করে। এসব লিজ বরাদ্দ বাতিল এবং আইনগত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশসহ গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে কোনো সরকারই এ সুপারিশ বাস্তবায়ন করেনি। দুদকও এ নিয়ে আর এগোয়নি। এর ফলে ধামাচাপা পড়ে যায় মিরপুর এলাকায় আত্মসাতকৃত সরকারি সম্পত্তি পুন:উদ্ধারের উদ্যোগ।
বেআইনিভাবে বরাদ্দকৃত হাজার কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি দখলদারদের কব্জা থেকে উদ্ধারে কোনো পরিকল্পনা আছে কি-না জানতে চাওয়া হয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদের কাছে। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন