বিশেষ সংবাদদাতা : অহেতুক খরচ না বাড়িয়ে টেকসই, সাশ্রয়ী ও যুগোপযোগী উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করতে প্রকৌশলীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমাদের উন্নয়ন কাজ পরিকল্পিতভাবে হওয়া প্রয়োজন। পরিকল্পনার সময় খরচ বাড়ানোর কথা ভাববেন না। অহেতুক খরচ না বাড়িয়ে টেকসই, সাশ্রয়ী ও যুগোপযোগী পরিকল্পনা নিতে হবে।
গতকাল শনিবার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) ৫৬তম কনভেনশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী তার নিজের এলাকার একটি খালের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ছোট বেলা থেকে এ খাল দেখে আসছি। এখানে জোয়ার-ভাটার পানি আসে যায়। খালের দুই মুখ নদীর সঙ্গে যুক্ত। এই খালের দুই মুখ বন্ধ করে কেন স্লুইস গেট দিতে হবে। প্রতিটি উপজেলাকে কেন্দ্র করে উন্নয়নের মাস্টার প্ল্যান করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। ফসলী জমি রক্ষার পাশাপাশি ভূমিকম্প প্রতিরোধ ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন প্রকল্পের পরিকল্পনা করার আহ্বান জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর এলাকায় কোনো কাজে ‘বেশি বেশি’ করার আদিখ্যেতা না দেখাতে প্রকৌশলীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন শেখ হাসিনা। এই আদিখ্যেতাটা ভালো না যে প্রধানমন্ত্রীর জায়গা বলে বেশি করে ঢেলে দাও।
শেখ হাসিনা বলেন, এক সময় কিছুই পেতাম না। সারাজীবন বঞ্চিত ছিলাম। আর এখন পাওয়ার ধাক্কা সামাল দিতে আমার কষ্ট হচ্ছে। আমি সবাইকে মানা করছি। আপনাদের এত লাগবে না, যেটুকু লাগবে, সেটুকু করতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এলাকায় যা কিছু করতে হবে একটু বেশি বেশি করতে হবে-এই চিন্তাটা পরিহার করতে হবে। বেশি বেশি করতে গিয়ে সবকিছু নষ্ট করে দেবেন না দয়া করে। আমার এলাকার পরিবেশটা যেন নষ্ট না হয়। গোপালগঞ্জের জলাভূমিতে স্লুইস গেইট নির্মাণে পরিকল্পনাহীনতার ‘তিক্ত অভিজ্ঞতার’ বিষয়টি উঠে আসে তার কথায়। আমার এলাকা, বিল, হাওর-বাঁওড় এলাকা। সেখানে একটা বিল বা খালের পাড়ে বাঁধ কত ফুট উঁচু লাগে? চার, পাঁচ ফুট বা তিন ফুট উঁচু হলেই তো যথেষ্ট। সেখানে তো সাত ফিট, আট ফিট বা চৌদ্দ ফিট উঁচু বাঁধের কোনো প্রয়োজন হয় না। অহেতুক এই খরচ কেন?
নিজের শৈশব স্মৃতি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, যে খালটা যুগ যুগ ধরে আমি দেখছি, জোয়ার-ভাটা হয়। সেই খালের দুই মাথায় স্লুইচ গেইট লাগানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। ওই খাল তো কখনও কোনো ক্ষতি করে না।হঠাৎ দেখলাম সেখানে বিরাট প্রকল্প নেওয়া হলো। এই ধরনের পরিকল্পনা কেন নেওয়া হবে? এই ধরনের পরিকল্পনা পরিহার করতে হবে। সারাদেশে এ পর্যন্ত কতগুলো স্লইস গেইট ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে এবং তার ফলাফলটা কীÑ সে মূল্যায়ন করতে প্রকৌশলীদের পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী।
ওই বেড়িবাঁধ দিয়ে কতটুকু আমি ধান উঠাচ্ছি আর বিনিময়ে ওটার মেরামতে প্রতিবছর কত খরচ হচ্ছে এবং ওইটার কারণে অন্য জায়গার জলাবদ্ধতা, জমি নষ্ট এবং নদী ভাঙন সৃষ্টি (হচ্ছে)। এভাবে প্রকল্প নেওয়ার সময় অর্থ অপচয় বন্ধ করে সেবার মান বাড়ানোর উপর গুরুত্ব দেন সরকার প্রধান।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকা- চালানোর সময় পরিবেশের ক্ষতি যেন না হয়, সে দিকে নজর রাখতে সবার প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। সারাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করার পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে বলেন, ইতোমধ্যে ১৬টা জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে অর্থনৈতিক অঞ্চল করতে গিয়ে মানুষকে ‘বেশি’ না সরানো এবং পরিবেশ রক্ষার দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। শিল্প স্থাপন বা আবাসন করতে গিয়ে প্রতিটি এলাকাই যেন জলাধার থাকে, সেদিকেও লক্ষ্য রাখার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। যত্রতত্র যে কেউ যেখানে সেখানে একটা জমি কিনেই ইন্ডাস্ট্রি করবে, সেটা করতে পারবে না। পরিকল্পনা করার সময় প্রতিটি শিল্প কারখানা বা হাসপাতালে বর্জ্য নিষ্কাশণ ব্যবস্থা নিশ্চিত এবং হাঁটাচলা বা খেলাধুলার জন্য প্রতিটি এলাকায় খোলা জায়গা রাখতেও বলেন তিনি।
যে কোনো প্রকল্প ‘আধুনিক, দৃষ্টিনন্দন ও পরিবেশসম্মত’ভাবে বাস্তবায়নের উপরও গুরুত্ব দেন শেখ হাসিনা। আমি চাচ্ছি আমাদের উন্নয়নের কাজটা খুব প্ল্যানওয়েতে হওয়া উচিৎ। বিদ্যুৎ, রাস্তা, পয়ঃনিষ্কাশন সবকিছু এমন পরিকল্পিতভাবে করা উচিৎ জমি যেন নষ্ট না হয়, আর অল্প খরচে যেন করা যায়।শুধু খরচ বাড়াবার জন্য পরিকল্পনা যেন না হয়। সাশ্রয়ী ও পরিকল্পিতভাবে অধিক সেবা মানুষকে দিতে পারব সেভাবেই পরিকল্পনা করবেন-এটাই আপনাদের কাছে আমার দাবি থাকলো।
বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো এবং ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে প্রতিবেশী দেশ থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় শুরু করেছি। প্রায় ১২শ মেগাওয়াট আমরা ওখান থেকে আনার ব্যবস্থা করেছি। ট্রান্সবর্ডার পাওয়ার সাপাইয়ে আমরা নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। ভারত থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল কেনার কাজ শুরু হয়েছে বলেও জানান তিনি। যেটা আসাম রিফাইনারি থেকে সোজা পার্বতীপুর পর্যন্ত চলে আসবে। ফিজিবিলিটি স্টাডি তৈরি করা হয়ে গেছে। পাইপলাইন হবে। বাংলাদেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে ভারত-নেপাল-ভুটান এবং মিয়ানমার-চায়না-ভারতের সঙ্গে আঞ্চলিক জোট গড়ার কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। সারা দেশে রেল নেটওর্য়াক তৈরির পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, পায়রা বন্দর, মংলাবন্দর পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করা হবে। এ সময় প্রকৌশলীদের যেকোনো প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করার তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে চাই। আর এই উন্নয়নের চাবিকাঠি প্রকৌশলীদের হাতে। প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনাদের অবদান রয়েছে, আপনাদের ওপর নির্ভর করে উন্নয়ন। আপনাদের ওপর নির্ভর করে একটা প্রকল্প কত দ্রুত শেষ হবে।
নিজস্ব কন্সালট্যান্সির ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, দেশ আমাদের। এদেশের নদী-নালা, খাল-বিল সব আমাদের চেনা। বাইরে থেকে লোক এসে আমাদের সমস্যা কতটুকু বুঝবে? অবহেলিত মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে আমরা কাজ করছি। দেশের অর্থনীতি গতিশীল ও শক্তিশালী করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি, যোগ করেন শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক সময় বাংলাদেশ শোষিত ছিল, বঞ্চিত ছিল। আমরা সে স্থান থেকে দেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে এসেছি। দেশের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশে উন্নীত করা সহজ কথা নয়। আমাদের লক্ষ্য, প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশে উন্নীত করা। নির্ধারিত সময়েই তা অর্জন করব,’ বেশ প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, শূন্যের ওপর দাঁড়িয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন জাতির পিতা। ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ার কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, ১৫ আগস্টে তাকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বেঁচে থাকলে দেশ অনেক আগেই উন্নত হতো, সমৃদ্ধ হতো। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়েছে। ওই সময় রাস্তা-ঘাট, পুল-কালভার্ট নির্মাণ করেছি, বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়েছি। ১১টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৯৬ সালে আইন করেছিলাম। যমুনা নদীর ওপর প্রথমে রেললাইন প্রকল্প ছিল না। আমরা ক্ষমতায় আসার পর সেখানে রেললাইন, গ্যাসলাইন স্থাপন করেছি। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য স্বর্ণ যুগ ছিল বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপরের সরকার দেশকে পিছিয়ে নিয়ে গেছে। অবশ্য আমরা যে কাজ শুরু করেছিলাম, অন্যদের সময়ে তার কিছু কিছু শেষ হওয়ায় আমাদের কাজের ফিতা কেটে অন্যরা বাহবা নিয়েছেন।২০০৯ সালে আমরা ক্ষমতায় এসে ফের উন্নয়নের কাজ করছি। নিজেদের অর্থায়নেই আমরা পদ্মসেতুর কাজ করে চলেছি। প্রতিটি জেলায় যাতে বিশ্ববিদ্যালয় হয়, আমরা সেই পদক্ষেপ নিয়েছি। প্রায় ১১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ভারত থেকে আনার ব্যবস্থা করেছি। ঢাকা শহরকে যানজটমুক্ত করার জন্য আমরা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শুরু করেছি। দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের কোনো অঞ্চল যেন বঞ্চিত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখেছি।
প্রতিটি নদী সচল করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, প্রত্যেকটি নদী ড্রেজিং করতে হবে। এই নদীকে আমরা আমাদের উন্নয়নে ব্যাপকভাবে কাজে লাগাতে পারি। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা যেকোনো অসাধ্য সাধন করতে পারি। কেউ দেশের বদনাম করুক, আমরা সেটা চাই না। চলুন সবাই মিলে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলি। ২০২১ সালে মধ্যম আয় ও ২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ গড়তে সবার সহযোগিতা চাই।
নিজেকে প্রকৌশলী পরিবারের একজন হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমিও তো আপনাদেরই একজন। কারণ আমি একজন ইঞ্জিনিয়ারের মা। কাজেই আমার কাছে কোনো দাবি করতে হবে না। প্রয়োজন ও দেশের মানুষের চাহিদা অনুসারে সব পূরণ করব।
আইইবি সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার কবির আহমেদ ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সবুর বক্তব্য দেন। এ সময় তারা প্রকৌশলীদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে প্রকৌশলী আ আ ম শফিউল্ল্যাহ ও প্রকৌশলী নুরুল হুদাকে আইইবি স্বর্ণ পদক দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব পদক তুলে দেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন