শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

টেবিলে বসেই ‘সরেজমিন তদন্ত’ সারলেন গুলশান সাবরেজিস্ট্রার

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২৮ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

অফিসের টেবিলে থেকেই আইনমন্ত্রণালয় নির্দেশিত ‘সরেজমিন প্রতিবেদন’ দিয়েছেন ঢাকার জেলা রেজিস্ট্রার দফতর। জেলা রেজিস্ট্রারের নির্দেশনায় তদন্ত প্রতিবেদনটি তৈরি করেন ঢাকার গুলশান সাব-রেজিস্ট্রার। প্রতিবেদনে তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশেনের ২,৫,৬,৭ এবং ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বিস্তর এলাকাকে ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ‘সংলগ্ন ওয়ার্ড’ বলে উল্লেখ করেন। অথচ ৩ নম্বর থেকে অন্য ওয়ার্ডগুলোতে যেতে হয় মাঝে এক বা একাধিক ওয়ার্ড অতিক্রম করে।

দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে মানুষ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সম্প্রসারিত ওয়ার্ডভুক্ত হলেও সেই সীমানা কলমের এক খোঁচায় তছনছ করে দেন এই সাব-রেজিস্ট্রার। ব্যক্তি বিশেষের চাহিদানুগ প্রতিবেদন দিতে গিয়ে স্পটেই যাননি। টেবিলে বসেই সম্পন্ন করেন মন্ত্রণালয় নির্দেশিত ‘সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন’। আর সেই তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় সেই ব্যক্তিকে নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে।

ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রি কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, গতবছর আইনমন্ত্রণালয়ের বিচার শাখা-৭ অনুগমনে জেলা রেজিস্ট্রার ঢাকা’কে (স্মারক নং-বিচার৭/২ এন-২০/৭৬-৮৬) একটি তদন্তের দায়িত্ব দেয়। প্রতিবেদন মাধ্যমে জানতে চাওয়া হয়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কালশী, নতুন রাস্তার উভয় পার্শ্ব, সাগুফতা, মিরপুর ডিওএইচএস, সেকশন-৯, স্বপ্ননগর, হারুনাবাদ, ইস্টার্ণ হাউজিং, গড়ান চটবাড়ি সম্প্রসারিত রূপনগর আবাসিক এলাকাসমূহ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কি-না। এ পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার জেলা রেজিস্ট্রার গত বছর ৯ সেপ্টেম্বর সরেজমিন তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের দায়িত্ব দেন (স্মারক নং-৬৪৯৬) গুলশান সাব-রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ রমজান খানকে। তিনি গত বছর ২৪ নভেম্বর আইন মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদনটি পাঠান।

প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, সূত্রের স্মারকে নির্দেশিত হইয়া সরেজমিন গমন করি। স্থানীয় জনসাধারণসহ জনপ্রতিনিধি, মাননীয় এমপিসহ বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের সহিত বর্ণিত বিষয়টি নিয়ে মতবিনিময় করি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহিত কথা বলিয়া জানা যায় যে, বিষয়ে বর্ণিত অধিক্ষেত্র ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কিছু অংশ অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে এবং কিছু অংশ অন্তর্ভুক্ত হয় নাই। তবে উক্ত এলাকাগুলো কোনো ওয়ার্ডে রূপান্তরিত হয় নাই। ইতোপূর্বে বর্ণিত এলাকাসমূহ হরিরামপুর ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। উক্ত এলাকায় কোনো নিকাহ ও তালাক রেজিস্ট্রার কর্মরত নাই। বর্ণিত এলাকাসমূহ ৩ নং ওয়ার্ডেও সংলগ্ন এলাকা বটে।

এদিকে সূত্র জানাচ্ছে, গুলশান সাব-রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ রমজান খান উল্লেখিত স্থানসমূহের প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র, প্রশাসনিক এলকাভিত্তিক মানচিত্র, জরিপ অধিদফতর প্রণীত ম্যাপ এমনকি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গুগল ম্যাপও খুলে দেখেননি এ সাব-রেজিস্ট্রার। উল্লেখিত স্থানসমূহ পরিদর্শনও করেননি। তদন্ত প্রতিবেদনের সুবিধাভোগী ব্যক্তির ভাষ্য অনুসারে দাখিল করেন ‘সরেজমিন তদন্ত প্রতিবেদন’।

অথচ বহুল ব্যবহৃত সরকারি মানচিত্র বলছে ভিন্ন কথা। মানচিত্র অনুযায়ী, মিরপুর বেনারসী পল্লী এলাকাটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩ নম্বর ওয়ার্ড। ‘সাগুফতা’ এলাকা ২ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত। প্রতিবেদনে এ এলাকাকে ‘৩ নম্বর ওয়ার্ডের সংলগ্ন’ বলে উল্লেখ করেন। অথচ এর মাঝে রয়েছে ৫ নম্বর ওয়ার্ড। মিরপুর ডিওএইচএস এলাকাটি পরিচালিত হয় ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের আওতায়। অথচ এটিকেও চিহ্নিত করা হয় ৩ নম্বর ওয়ার্ডভুক্ত এলাকা হিসেবে।

মিরপুর কালসির বেশিরভাগ অংশই ২ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত। কালশি কবরস্থান ৫ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত। উল্লেখ করা হয় ৩ নম্বর ওয়ার্ডভুক্ত বলে। ৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে রাস্তার উভয় পার্শ্ব ৩ কিলোমিটার দূরে। সেকশন-৯, স্বপ্ননগরের দূরত্ব ৫ কিলোমিটার, এটিও ২ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত। রূপনগর এক্সটেনশনের দূরত্ব ৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে। এটি ২ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত। ৫ নম্বর ওয়ার্ড সংলগ্ন। সুজাতনগর এবং হারুনাবাদের অবস্থান বেনারসী পল্লী ৬ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত। দূরত্ব প্রায় ৬ কিলোমিটার। ইস্টার্ণ হাউজিং ৭ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত। বেনারসী পল্লী থেকে এটির দূরত্ব ৮ কিলোমিটার। গোড়ান চটবাড়ি ৭ এবং ৮ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত। ৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে এটির দূরত্ব ৮ কিলোমিটার। এটি ৭ বেনারসী পল্লী থেকে দূরদূরান্তের এসব স্থানে একাধিক ওয়ার্ড পার হয়ে রিকশা-গাড়ি করে যেতে হয়।

অথচ মোহাম্মদ রমজান খান তার প্রতিবেদনে উল্লেখিত স্থানগুলোকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ‘৩ নং ওয়ার্ডের সংলগ্ন’ এলাকা বলে উল্লেখ করেন। কেন তিনি এ প্রতিবেদন দিলেন? এ প্রশ্নের জবাব রয়েছে ওই প্রতিবেদনেই।
প্রতিবেদনে তিনি বলেন, ‘এলাকাগুলোর আশাপাশের নিয়োগপ্রাপ্ত নিকাহ ও তালাক রেজিস্ট্রারগণের বর্ণিত এলাকায় কোনো নিকাহ ও তালাক রেজিস্ট্রার না থাকায় নিয়মবহিভর্‚তভাবে বিবাহ ও তালাক নিবন্ধন করার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে স্থানীয় এমপি ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা ও ৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী জহিরুল ইসলাম মানিক বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩ নং ওয়ার্ডের সংশ্লিষ্ট এবং পাশাপাশি এলাকা হিসেবে বিষয়ে উল্লেখিত এ এলাকাসমূহ এবং উক্ত নিকাহ রেজিস্ট্রার শূন্য এলাকায় মো. আজিজুর রহমানকে সম্প্রসারিত দায়িত্ব প্রদানে অনুরোধ করিয়াছেন।’

অর্থাৎ এসব এলাকার নিকাহ রেজিস্ট্রার হিসেবে একজন ব্যক্তির নিয়োগ নিশ্চিত করতেই তিনি ফরমায়েশী এ প্রতিবেদন দেন। অভিযোগ রয়েছে, গুলশান সাব-রেজিস্ট্রার মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশেনের ৩ নং ওয়ার্ডের এ চৌহদ্দি আঁকেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গুলশান সাব-রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ রমজান খান এ প্রতিবেদকে বলেন, আমি এমপি মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। ওয়ার্ড কাউন্সিলের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের তথ্যের ভিত্তিতেই এ প্রতিবেদন তৈরি করেছি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন