পর্যটন শিল্পের প্রসার বাড়ছে সিলেটে। এখানকার নৈসর্গিক সৌন্দর্য ঘিরে বিকাশমান হচ্ছে পর্যটন শিল্প। সরকারি-বেসরকারিভাবে এ শিল্পকে গতিশীল করতে নেয়া হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোগ। তবে চলমান এ ধারায় আড়াল হয়ে যাচ্ছে অর্থনীতির আদিখাত পাথরসম্পদ। এতে করে বিপুল জনগোষ্ঠিই নয়, অর্থনীতির টেকসই ব্যবস্থা এখন হুমকিতে। পর্যটন স্থান হিসেবে ভোলাগঞ্জকে নতুন আদলে গড়ার মধ্যদিয়ে উপেক্ষিত হচ্ছে পাথরসম্পদসহ এ এলাকার লাখ লাখ মানুষের জীবন জীবিকা। অথচ সিলেটের পাথর সারা দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের অন্যতম উপকরণ।
পাথরসম্পদের কারণে সিলেটের জাফলং, শ্রীপুর, বিছানাকান্দি, ভোলাগঞ্জের পরিচিতি সর্বত্র। পাথরের প্রাচুর্যে এ এলাকার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের রয়েছে ভিন্ন আবেদন। অভিযোগ রয়েছে, বছরের পর বছর ক্রমাগত খুবলে খাওয়া হয়েছে পাথর সম্পদ। প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে ধ্বংস হয়েছে পরিবেশ। কোয়ারী ছাড়াও ফসলি জমির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল পাথরখেকোরা।
একপর্যায়ে তাদের দৌরাত্ম্যে জাফলংকে পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন (ইসিএ) এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপরও কোয়ারি থেকে পাথর-বালু উত্তোলন বন্ধ করা যায়নি। সীমান্তের ওপারের পাহাড় থেকে প্রবাহমান পানির স্রোতের সাথে আসে ছোট-বড় পাথর। যুগ যুগ ধরে পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ শীতল পানি আর পাথরের মিতালি পর্যটকদের আকর্ষণ করে আসছে। সৌন্দর্যের সেই লীলাভ‚মিতে অবৈধ বোমা মেশিন, শ্যালো মেশিন ও পেলোডারের মাধ্যমে চলেছে তান্ডব। এই ধ্বংসযজ্ঞ পিয়াইন নদীর সীমানা ছাড়িয়ে আশপাশের লোকালয় পর্যন্ত ছড়িয়েছে।
গত বছরের মার্চে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সংবাদ সম্মেলন করে ইসিএ ঘোষিত জাফলংয়ের প্রায় ১৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষার দাবি জানায়। এর আগে বেলার পক্ষ থেকে আইনি লড়াইয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশে সরকার ২০১৫ সালে জাফলংকে ইসিএ ঘোষণা করে। একই সঙ্গে ডাউকি নদীর পূর্ব পাড়ে চুনাপাথর টিলাকে ভূ-তাত্তি¡ক ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এদিকে বিছনাকান্দি, শ্রীপুর ও ভোলাগঞ্জ পাথুরে সম্পদে ভরপুর।
এ সম্পদ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় উত্তোলন ও আর্থিক ফায়দা হাসিলের পরিবর্তে বন্ধ রাখা হয়েছে। এর পরিবর্তে বিছানাকান্দি ও ভোলগঞ্জের পর্যটন স্পট হিসেবে খ্যাতি ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে নানাভাবে। একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, এর পেছনে রয়েছে কর্পোরেট এজেন্টদের মনোপলি মিশন। তারা সিলেটের পাথরসম্পদকে চাপিয়ে আমদানিতে ব্যস্ত। পরিবেশ বিপর্যয়ের জু-জু তুলে সিলেটের পাথরসম্পদকে এড়িয়ে যাচ্ছে। এড়িয়ে যাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে পাথরসম্পদে পর্যটনের প্রলেপ লাগিয়ে দিচ্ছে।
এমনকি ভোলাগঞ্জের সাদা পাথরের পথ সহজ করতে বাস সার্ভিসসহ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। নৌকা ঘাট ইজারা দেয়া হয়েছে। অথচ বাস্তবিক চরিত্র ভিন্ন। পাথরের স্তূপে পানির প্রবাহ হারিয়ে যাচ্ছে। সাদা পাথর ও বিছানাকান্দিতে বেড়াতে যাচ্ছে সৌন্দর্য উপভোগে। কিন্তু একবার যাওয়ার পর পুনরায় যাওয়ার ইচ্ছে হারাচ্ছে পর্যটকরা। এ এলাকাকে পর্যটন স্পট হিসেবে জিইয়ে রাখতে কর্তৃপক্ষের যে ব্যস্ততা তার উল্টো চিত্র পাথরসম্পদের ক্ষেত্রে। টেকসই অর্থনীতি শক্ত করার পরিবর্তে নামকাওয়াস্তে বিনোদনের পরিবেশ গড়ে পাথরসম্পদকে আড়াল করাই মতলব বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
সাদা পাথর এলাকার ভোলাগঞ্জ গ্রামের মোবারক হোসেন বলেন, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সৌন্দর্য উপভোগে দর্শনার্থী ও পর্যটকদের ব্যবস্থা হলেও স্থানীয়দের নিয়ে কারো ভাবনা নেই। খুশির মেজাজে বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন কেবল সৌন্দর্য দর্শনে অর্থের খরচ করছে ভোলাগঞ্জে এসে। তবে সে এলাকার মানুষই ভাতের অভাবে হাহাকার করছে। সঙ্কটাপন্ন তাদের জীবন জীবিকা।
সিলেট ট্যুর গাইড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হুমায়ুন কবির লিটন বলেন, সাদা পাথর ও বিছানাকান্দির সৌন্দর্য উপভোগে দর্শনার্থী ও পর্যটকদের মনোযোগ রয়েছে। বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় সাদা পাথর মুখী রয়েছে মানুষের ভিড়। তবে পাথরের স্তূপ বাড়ছে নদী পথ সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ছে বালু পাহাড়ে। ধলাই নদীর তলদেশের পরিবর্তে উপরিভাগে এখন পাথরের সমারোহ। পাথর সুষ্ঠুভাবে আহরণ করলে এখানকার সৌন্দর্যসহ পারিপাশির্^ক চিত্র আরো উপভোগ্য হতো।
সিলেট চেম্বার অব কমার্স সভাপতি আবু তাহের মো. শোয়েব বলেন, পাথর সম্পদের সুষ্ঠু আহরণ ও অর্থনৈতিক ফায়দা অর্জন জরুরি। সেই সাথে স্থানীয় মানুষের জীবিকার পথ স্বাভাবিক রাখার প্রতি মনযোগী হতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন