মতিঝিলের একটি ব্যাংকের চাকরিজীবী আনোয়ার হোসেন প্রতিদিনই দুপুরে পথের খাবার (স্ট্রিট ফুড) খান। তার খাদ্য তালিকায় রয়েছে ভাজি পরোটা, পিঠা, বিরিয়ানী, ভাত-সবজি কিংবা ভাজাপোড়া। এসব খাবার স্বাস্থ্যকর কিনা তিনি তা জানেন না। রাস্তায় বসে এসব খাবার তৈরি করা হয়। দীর্ঘদিন থেকে খেয়ে খেয়ে অভ্যাস হয়ে গেছে। পল্টন মোড়ের ফুটপাথে ব্যবসা করেন উত্তম কুমার। তার খাদ্য তালিকায় রয়েছে বিরিয়ানি, পিঠা। আনোয়ার হোসেন ও উত্তম কুমারের মতো হাজার হাজার কর্মজীবী রয়েছেন যারা প্রতিনিয়ত পথের খাবারের প্রতি বেশি নির্ভরশীল। অথচ করোনাভাইরাসের মধ্যেও তাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা নেই। এসব খাবারের বিক্রেতাদের মধ্যেও নেই স্বাস্থ্য সচেতনতার কোনও লক্ষণ। ফলে পথের খাবারে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।
গত ২ ফেব্রুয়ারি ছিল ‘নিরাপদ খাদ্য দিবস’। দিবসটি উপলক্ষ্যে প্রতিদিন পথের খাবার খান এমন বেশ কয়েকজন স্বল্প আয়ের মানুষকে প্রশ্ন করা হয়। কিন্তু তারা জানান, খাদ্যের মান বা ঝুঁকি নিয়ে তাদের ভাববার পরিস্থিতি নেই। অথচ খাদ্য বিশারদরা বলছেন, পথের খাবার নিরাপদ নয়।
রাজধানী ঢাকার চাকরিজীবী কিংবা নিম্ন আয়ের মানুষকে দুপুরে কর্মস্থলে থাকতে হয়। ফলে বাধ্য হয়েই দুপুরের ক্ষুধা নিবারণে বেশি ঝোঁক থাকে পথের খাবারের দিকে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়, এমনকি, গুলিস্তান, মতিঝিলের ব্যাংক পাড়ায় এসব খাবারের দোকান অহরহ দেখতে পাওয়া যায়। পোড়া তেলে কিংবা বাসি তেল ব্যবহার করে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এসব খাবার প্রস্তুত করা হয়। এ নিয়ে ভাবনা নেই কারোই। খোদ সরকারি প্রতিষ্ঠান নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে উদ্যোগ নিলেও সেটি আলোর মুখ দেখেনি।
২০২০ সালের ডব্লিউএইচও’র তথ্য অনুযায়ী খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের কারণে বাংলাদেশে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বছরে ৫ হাজার ৭৭৬ জন মানুষ মারা যায়। খাদ্যে ট্রান্সফ্যাটের প্রধান উৎস পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল (পিএইচও) যা ডালডা বা (বনস্পতি ঘি) নামে সুপরিচিত। ডালডা সাধারণত বেকারি পণ্য, প্রক্রিয়াজাত ও ভাজা পোড়া স্ন্যাকস এবং হোটেল-রেস্তোরাঁ ও সড়কসংলগ্ন দোকানে খাবার তৈরিতে ব্যবহার হয়ে থাকে। স¤প্রতি এক গবেষণায় ঢাকার ডালডা নমুনার ৯২ শতাংশে ডব্লিউএইচও’র সুপারিশ করা ২ শতাংশ মাত্রার চেয়ে বেশি ট্রান্সফ্যাট (ট্রান্স ফ্যাটি এসিড) পাওয়া গেছে। প্রতি ১০০ গ্রাম ডালডার নমুনায় সর্বোচ্চ ২০.৯ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাট এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। এটা ডব্লিউএইচও’র সুপারিশকৃত মাত্রার তুলনায় ১০ গুণেরও বেশি।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) এরইমধ্যে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা বিবেচনায় ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে নীতি প্রণয়নে কাজ শুরু করেছে। প্রাথমিক খসড়া নীতিমালাও প্রায় প্রস্তুত। কিন্তু চূড়ান্ত নীতিমালা প্রণয়নের কাজ চলছে একেবারেই ঢিমেতালে।
‘জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস-২০২১’ উপলক্ষে এক প্রতিক্রিয়ায় গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা’র (প্রগতির জন্য জ্ঞান) নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেছেন, নিরাপদ খাদ্য সকলের অধিকার। আমরা জেনেছি, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণ নীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই নীতি চূড়ান্ত এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।
জানতে চাইলে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মঞ্জুর মোর্শেদ আহমেদ বলেন, পথের খাবার নিরাপদ করার জন্য আমাদের পরিকল্পনা আছে। এ মুহূর্তে করোনার কারণে আমরা কোনও কার্যক্রম চালাতে পারছি না। তবে করোনার আগে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে স্ট্রিট ফুড যারা বিক্রি করেন, তাদের কীভাবে ট্রেনিং দেওয়া যায়, তাদের কী কী সুবিধা অসুবিধা আছে, এ বিষয়ে আমরা একটা খসড়া তৈরি করেছিলাম গাইডলাইন করার জন্য। সেটা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। করোনা পরিস্থিতির পর হয়তো আমরা এ বিষয়ে আরও ভালোভাবে পরিকল্পনা করে আগাবো।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ করোনা মহামারির কারণে তাদের তদারকি কার্যক্রম বন্ধ রাখলেও গত ৪ মাস ধরে ফের অভিযান চালাচ্ছে বিভিন্ন রেস্তোরাঁ, মিষ্টির দোকান এবং বেকারিতে। এসব প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করার পর তাদের খাদ্য নিরাপদ রাখার নির্দেশনা জানিয়ে দিচ্ছে। তাতে করে অনেক নাম করা রেস্তোরাঁ এখন নিরাপদ খাদ্য আইন প্রতিপালনে অনেকটা বাধ্য হয়েছে। তবে পথের খাবার নিরাপদ করতে তেমন কোনও উদ্যোগ নিতে পারেনি সরকারের এই প্রতিষ্ঠানটি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, দূষিত খাবারের কারণে সারা বিশ্বে প্রতি বছর ৬০ কোটি মানুষ অসুস্থ হয়ে থাকে। একই কারণে মৃত্যু হচ্ছে ৪ লাখ ২০ হাজার জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ভারত, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে প্রতিবছর দূষিত খাবার খেয়ে প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজার মানুষ মারা যায়। আর অসুস্থ হয় ১৫ কোটি মানুষ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি ১০টি শিশুর তিন জনই ডায়রিয়ায় ভোগে। ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, পরজীবী, বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান ইত্যাদির মাধ্যমে খাবার দূষিত হয়। সেই অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে বমি বমি ভাব, ডায়রিয়ার মতো প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হয়। আর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হিসেবে ক্যান্সার, কিডনি ও যকৃৎ বিকল, মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর বিভিন্ন অসুখ হয়। কম বয়সী শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারী ও প্রবীণরা খাবারে দূষণের শিকার হন সবচেয়ে বেশি।
জানতে চাইলে প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, পথের খাবারে চারপাশের ধুলোবালি উড়ে এসে পড়ে। এ ধুলোবালি আবর্জনার সঙ্গে কতগুলো রোগজীবাণু চলে যায় পেটে। তাতে নানা ধরনের অসুখ তৈরি করে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন