শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

উদ্বেগ বাড়ছে ভেজাল মদে

বিদেশি মদের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০০ এএম

দেশে ভেজাল ও বিষাক্ত মদপানে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এতে করে বাড়ছে উদ্বেগ। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের কড়াকড়ি আরোপের নামে এক ধরণের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টিতে বিদেশি মদের সরবরাহ কমায় ভেজালের মাত্রা বেড়ে গেছে। আবার ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় নকল মদের কারখানা থেকেও ভেজাল মদ পাচার হয়ে বাংলাদেশে আসছে। সম্প্রতি আনন্দবাজার পত্রিকার এক খবরে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গত বেশ কিছুদিন ধরে বিদেশি মদের সংকট দেখা দিয়েছে। এই সুযোগে সক্রিয় হয়ে উঠেছে একটি নকল মদ বিক্রেতা চক্র। এরকম চক্রের ছয়জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করার পর ঢাকার পুলিশ জানিয়েছে, সা¤প্রতিক সময়ে ওয়্যারহাউজগুলো থেকে মদ বিক্রিতে কড়াকড়ি থাকায় বাজারে মদের সংকট তৈরি হয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চক্রটি ভেজাল মদ তৈরির কারখানা গড়ে তোলে। এই মদ তারা খুচরা ও পাইকারি বাজারে বিক্রি করতো।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় লাইসেন্সধারী মদের বারগুলোতে বিদেশি মদ বিক্রিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে শুল্ক ও গোয়েন্দারা। এতে করে হঠাৎ করেই বাজার থেকে বিদেশি মদ উধাও হয়ে গেছে। কৃত্রিম এই সঙ্কট সৃষ্টির কারণে সাধারণ মানের যে মদ মাস তিনেক আগেও আড়াই থেকে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হতো, তা এখন ৫ থেকে ৬ হাজারে গিয়ে ঠেকেছে। এ পরিস্থিতিতে বিদেশি বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের বোতলে মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল, স্পিরিটের পাশাপাশি নেশাজাতীয় অন্যান্য পদার্থ মেশানো নকল মদে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। ভেজাল মদ প্রস্তুতকারীরা ভালোমন্দের কথা বিবেচনা না করে শুধু বাড়তি লাভের আশায় এ ধরনের বিষাক্ত মদ দেদার বিক্রি করছে, যা পান করে স¤প্রতি মৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে।
বাজারে বিষাক্ত মদের ছড়াছড়ির বিষয়টি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও নিঃসংকোচে স্বীকার করেছেন। তারা জানান, সম্প্রতি একাধিক অভিযানে বিপুল ভেজাল মদ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে এসব মদ বিষাক্ত কিনা এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিত কোনো তথ্য দিতে পারেননি। এছাড়া মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এখন পর্যন্ত ভেজাল মদ তৈরির কোনো বড় কারখানার সন্ধান পায়নি। এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই তারা সন্দেহ করছে এসব ভেজাল মদ দেশের বাইরে থেকে আসছে। সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বিজিবি সূত্র জানায়, সীমান্তের বিভিন্ন চোরাপথে ভারতীয় মদ বাংলাদেশে আসছে। প্রায়ই তাদের হাতে এসব মদের ছোটবড় চালান ধরা পড়ছে। তবে তা আসল নাকি ভেজাল তা তাদের জানা নেই।

এদিকে স¤প্রতি ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় বাংলাদেশে ভেজাল মদ পাচার সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ভারতের শুল্ক গোয়েন্দারা নদিয়ার করিমপুরে একটি ভেজাল মদের কারখানার সন্ধান পেয়েছে। সেখান থেকে বিপুল ভেজাল মদ তৈরির উপকরণ উদ্ধার করা হয়। এসব মদের একটি অংশ ভারতের বিহার, ঝাড়খন্ডে পাঠানো হলেও এর বড় অংশ বাংলাদেশে পাচার হয়। এসব মদের চালান সীমান্তরক্ষীদের হাতে ধরা পড়ছে বলেও ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরও দাবি করা হয়, ক্যারামেলের (চিনি পুড়িয়ে তৈরি করা রস) সঙ্গে রয়্যাল স্ট্যাগের মতো সস্তা দরের হুইস্কি, কখনো বা পানি মেশানো স্পিরিট দিয়ে সেখানে জ্যাক ড্যানিয়েল, শিবাস রিগ্যাল ও স্ন্যাক লেবেলের মতো নামি ব্র্যান্ডের স্কচ তৈরি করা হতো।

এদিকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকটি নকল মদের কারখানার সন্ধান মিলে। ওই সব কারখানায় পানি, রেকটিফাইড স্পিরিট, ইথানল, মিথানলসহ উচ্চ তাপমাত্রার অ্যালকোহল, রং ও ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে বিষাক্ত মদ তৈরি করা হতো। এছাড়া দেশীয় চোলাই মদের সঙ্গে অতিমাত্রায় অ্যালকোহল মিশিয়েও তৈরি হচ্ছে তীব্রতাযুক্ত ‹শক্তিশালী মাদক›। যা পান করে ডাকসাইটে মাদকসেবীরাও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে মৃতুর কোলেও ঢলে পড়ে। আবার ড্রিংকসের সঙ্গেও অ্যালকোহল ও অতিমাত্রায় রেকটিফাইড স্পিরিট মিশিয়ে বিভিন্ন নামের অ্যানার্জি ড্রিংক বাজারজাত চলছে অবাধে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, এসব ভেজাল মদ তৈরির সঙ্গে জড়িতদের এ ব্যাপারে কোনো জ্ঞান না থাকায় অনেক সময় তারা মাত্রাতিরিক্ত স্পিরিট ও ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিচ্ছে। ফলে তা পান করে অনেক সময় মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এ ধরনের মদ পানে মৃত্যু না হলেও বিকলাঙ্গ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান তারা।

বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যারা নিয়মিত মদ্যপান করেন, এরকম বেশ কয়েকজন জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর থেকেই বিদেশি মদ অনেকটা দুর্লভ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান সব ধরনের মদ এবং আরেকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিয়ার তৈরি করে থাকে। কিন্তু দেশীয় এসব পণ্যের বাইরে বিদেশি মদেরও বিপুল চাহিদা রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার একজন নিয়মিত মদ্যপানকারী বলেছেন, আগে বিভিন্ন বার, ওয়্যারহাউজ থেকে সহজেই মদের বোতল কেনা যেতো। কিন্তু এখন বেশি টাকা দিয়েও সেখান থেকে মদ কেনা যায় না। তাই আমরা অনেকেই পরিচিত ডিলার বা সরবরাহকারীর কাছ থেকে মদ নিয়ে থাকি। কিন্তু স¤প্রতি কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনার পর সেটাও বন্ধ করে দিয়েছি।

মদ বিক্রি করে এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত কয়েকমাস ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে মদ বিক্রিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে ওয়্যারহাউজগুলো। সেই সঙ্গে বারের মদ আমদানিও অনেক কমে গেছে। ঢাকার একটি বার বু মুন রিক্রিয়েশন ক্লাবের কর্মকর্তা মো. শাহজাদা মিয়া বলেন, বাংলাদেশে বিদেশি মদ আমদানিতে অনেক বিধিনিষেধ আছে, অনেক টাকা কর দিতে হয়। ফলে আমাদের যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে, তার খুব সামান্যই আমদানি করতে পারি। এরই সুযোগ নিচ্ছে একটি চক্র। তারা নকল মদ তৈরি করে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছে।

একাধিক বারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগে বিভিন্ন ওয়্যারহাউজ বা ক্লাব থেকে অনেকে কম দামে মদ কিনতেন। কিন্তু স¤প্রতি শুল্ক বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের কারণে ওয়্যারহাউজ বা ক্লাব থেকে বিদেশি নাগরিক ছাড়া মদ বিক্রি একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে যারা বিদেশি মদ্যপানে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, তারা এখন বিভিন্ন সূত্র থেকে মদ কেনার চেষ্টা করছেন। মূলত এই সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছেন ভেজাল কারবারিরা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, যারা বিদেশি মদের নামে নকল মদ তৈরি করছে, তারা যথাযথভাবে রাসায়নিক মিশ্রণ করছে না। অনেক সময় রাসায়নিক কাজে ব্যবহৃত মিথানল ব্যবহার হচ্ছে। ফলে সেটি বিষাক্ত হয়ে উঠছে, যা অনেক সময় মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আহসানুল জব্বার বিবিসি বাংলাকে বলেনন, ‹নিয়ম মেনে যারা লাইসেন্স চায় বা মদ আমদানির জন্য আমাদের কাছে অনুমতি চায়, আমরা সেটা দিয়ে থাকি। মদের সংকটের কারণ হিসাবে তিনি বলেন, একটা কারণ হতে পারে যে মহামারির সময়ে বারগুলো বন্ধ ছিল। প্রায় দুইমাস আগে বারগুলো খোলা হয়েছে, তারা হয়তো যথেষ্ট পরিমাণে আমদানি করতে পারে নাই। অথবা সরকারের অন্যান্য দপ্তরের নজরদারিও বাড়তে পারে। হয়তো সেখানে তারা রাজস্ব ঠিক মতো দিচ্ছে না। তাছাড়া অবৈধভাবে মদ বিক্রির বিরুদ্ধে আমাদের ব্যবস্থাও আছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন