সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

ইসলামে অসিয়তের গুরুত্ব

নূর মুহাম্মদ রাহমানী | প্রকাশের সময় : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০৮ এএম

মৃত্যুর পর কার্যকর করতে হয় ইসলামের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধানের নাম অসিয়ত। যেমন যদি কোনো ব্যক্তি মৃত্যুর সময় বলে, আমার মৃত্যুর পর আমার পরিত্যাক্ত সম্পত্তি হতে এত পরিমাণ সম্পত্তি অথবা এতটুকু জমি অমুক ব্যক্তি, অমুক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, অমুক মুসাফিরখানা কিংবা অমুক এতিমখানায় যেন দিয়ে দেওয়া হয়। তাহলে এটাকে শরিয়তের পরিভাষায় অসিয়ত বলে।

ইসলাম অসিয়ত করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে এবং এর জন্য রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। অসিয়তটা একমাত্র মৃত ব্যক্তির স্বদিচ্ছায় হতে পারে। তাকে জবরদস্তি করার কারও অধিকার নেই। সেটা হতে হবে ব্যক্তির পার্থিব উপার্জন থেকে। মৃত্যুর পর এর জন্য রয়েছে বিশাল সওয়াব। কোরআন ও হাদিসের ভাষ্যমতে অসিয়ত করা গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নত। কারণ এটি বান্দাকে দ্রুত তাওবার দিকে আহবান করে। পাপাচার না করতে উৎসাহিত করে। ইবাদত-বন্দেগিতে অন্তরে উদ্যমতা সৃষ্টি করে। আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস সৃষ্টি করতে সাহায্য করে। অসিয়তের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলমানের জন্য যার কাছে অসিয়ত করার মতো কোনো বিষয় থাকে তাহলে দু’রাতও অসিয়ত লিখে সংরক্ষণ না করে অতিবাহিত করা উচিত নয়।’ (বোখারি : ২৭৩৮)।
কোরআন ও হাদিসের আলোকে ওলামায়ে কেরাম বলেছেন, যার দায়িত্বে ঋণ থাকে, তার কাছে কারও আমানত রাখা থাকে কিংবা তার দায়িত্বে কোনো আবশ্যিক কোনো বিষয় থাকে যা সে নিজে আদায় করতে সক্ষম হবে না তখন তার জন্য অসিয়তনামায় বিস্তারিত লিখে রাখা জরুরি। সাধারণ মানুষের জন্য অসিয়ত লেখা জরুরি নয় তবে মুস্তাহাব।
উম্মতের ইজমা বা সর্বসম্মতিক্রমেও অসিয়ত শরিয়তসম্মত। কোরআন ও হাদিসের আলোকে সমগ্র উম্মতে মুসলিমা অসিয়ত বৈধ হওয়ার ওপর একমত। আল্লামা ইবনে কুদামা (রহ.) স্বীয় প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘আল-মুগনি’তে (৮/৩৯০) অসিয়ত বৈধ হওয়ার ব্যাপারে উম্মতের ইজমা বা সর্বসম্মতিক্রমের কথা উল্লেখ করেছেন।
কতটুকু সম্পদে অসিয়ত করা যায়? : অঢেল সম্পদ রয়েছে এমন ব্যক্তির জন্য পরিত্যক্ত সম্পদের এক পঞ্চমাংশ, এক চতুর্থাংশ কিংবা এক তৃতীয়াংশ পরিমাণ সম্পদ অসিয়ত করা মোস্তাহাব। এক তৃতীয়াংশের অধিক পরিমাণ সম্পদে অসিয়ত করা জায়েজ নয়। নবীজি (সা.) সাহাবি সাদকে (রা.) বলেন, অসিয়ত করতে চাইলে এক তৃতীয়াংশ সম্পদে অসিয়ত করতে পার, তবে এক তৃতীয়াংশও অধিক।’ (বোখারি : ২৭৪৪)। অগত্যা এক তৃতীয়াংশের বেশি অসিয়ত করতে চাইলে ওয়ারিশদের অনুমতি লাগবে। যদি এক তৃতীয়াংশের অধিক সম্পদ অসিয়ত করে ফেলা হয় তাহলে এক তৃতীয়াংশ সম্পদে অসিয়ত কার্যকর করা ওয়ারিশদের ওপর ওয়াজিব। যেমন কোনো ব্যক্তির পরিত্যাক্ত সম্পত্তি হতে কাফন-দাফন, অন্যান্য ওয়াজিব হকসমূহ ও ঋণ পরিশোধ করার পর ৯ লাখ টাকা অতিরিক্ত হলো, তাহলে এখানে সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত অসিয়ত কার্যকর করা ওয়ারিশদের ওপর আবশ্যক। এক তৃতীয়াংশ হতে অধিক সম্পত্তির ওপর অসিয়ত কার্যকর করা ও না করা ওয়ারিশদের ইচ্ছাধীন।
অসিয়তের জন্য সাক্ষী রাখা : অসিয়ত দু’জন ন্যয়-নিষ্ঠাবান সাক্ষীর উপস্থতিতে লিখিয়ে নেওয়া জরুরি যাতে পরবর্তীতে অসিয়তকারীর মৃত্যুর পর কোনো মতবিরোধ সৃষ্টি না হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মোমিনগণ! তোমাদের মধ্যে যখন কারও মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন অসিয়ত করার সময় তোমাদের মধ্য থেকে ধর্মপরায়ন দুজনকে সাক্ষী রেখো। তোমরা সফরে থাকলে এবং সে অবস্থায় তোমাদের মৃত্যু উপস্থিত হলে তোমরা তোমাদের ছাড়াও দু’ ব্যক্তিকে সাক্ষী রেখো।’ (সুরা মায়িদা : ১০৬) আয়াতটিতে বলা হয়েছে, সফরে আর বাড়িতে সব জায়গায় অসিয়ত করা যায়। তবে অসিয়ত করার সময় আমানতদার দু’জন ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখা যাতে পরবর্তীতে কোনো রকমের মতবিরোধ সৃষ্টি না হয়। তবে জীবদ্দশায় কল্যাণ মনে করলে অসিয়তকারীর জন্য অসিয়তে পরিবর্তন করার সুযোগ আছে।
কাউকে বঞ্চিত করার জন্য অসিয়ত না করা : কাউকে ঠকানোর জন্য কখনো অসিয়ত করা যাবে না। ওয়ারিশদের হক কম দেওয়ার জন্য, তাদের বঞ্চিত করার জন্য অসিয়ত করা চরম অন্যায়। কবিরা গুনাহ। যা জুলুমের শামিল। সুরা নিসার ১২ নাম্বর আয়াতে অসিয়ত করতে গিয়ে কারও ক্ষতি করতে নিষেধ করা হয়েছে। নবীজি (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ওয়ারিশকে সম্পত্তি হতে বঞ্চিত করল আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তাকে জান্নাত থেকে বঞ্চিত করে দেবেন।’ (ইবনে মাজাহ : ২৭০৩)।
ওয়ারিশদের অসিয়ত করা যাবে না : ইসলাম সূচনাকালে যতক্ষণ পর্যন্ত ওয়ারিশের অংশ নির্ধারিত ছিল না, তখন সবার ওপর নিজেদের ওয়ারিশদের অংশ অসিয়তের মাধ্যমে নির্ধারিত হতো, যাতে মৃত্যুর পর তার বংশে ঝগড়া না হয়, কোনো হকদারের হক নষ্ট না হয়। কিন্তু পরবর্তীতে উত্তরাধিকার সম্পদ বণ্টণের জন্য খোদ আল্লাহ তায়ালা কিছু নীতিমালা দিয়ে দিলেন, তখন অসিয়তের অপরিহার্যতা শেষ হলো। এ ব্যাপারে সুরা নিসায় আলোচনা করা হয়েছে। অবশ্য দু’টি মৌলিক শর্তের ভিত্তিতে অসিয়ত করা মোস্তাহাব হিসেবে অবশিষ্ট থাকল। ১. যে ব্যক্তি পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নির্দিষ্ট অংশ পাচ্ছে, তার জন্য অসিয়ত করার সুযোগ নেই।
যেমন বাবা-মা, স্ত্রী, স্বামী ও সন্তান-সন্তুতি এদের জন্য অসিয়ত করা যায় না। নবীজি (সা.) বিদায় হজের সময় আনুমানিক দেড় লাখ সাহাবির সমাবেশে বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক ওয়ারিশের অংশ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, তাই এখন কোনো ওয়ারিশের জন্য অসিয়ত করা বৈধ নয়।’ (তিরমিজি : ২১২০)। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর হাদিসে আরও স্পষ্টভাবে এসেছে। উত্তরাধিকার বিধান ঐ লোকদের অসিয়তকে রহিত করে দিয়েছে যাদের অংশ নির্ধারিত আছে। অন্যান্য আত্মীয় যাদের নিয়মানুসারে অংশ নেই, এদের জন্য অসিয়তের বিধান এখনো বলবৎ আছে। ২. বেশির চেয়ে বেশি এক তৃতীয়াংশ পরিত্যাক্ত সম্পত্তির ওপর অসিয়ত কার্যকর হতে পারে। অবশ্য সকল ওয়ারিশরা রাজি থাকলে এক তৃতীয়াংশের অধিক সম্পত্তিতেও অসিয়ত কার্যকর হতে পারে।
মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমতে যে সকল আত্মীয়ের মিরাসে কোনো অংশ নেই, তাদের জন্যও এখন আর অসিয়ত করা ফরজ বা আবশ্যকীয় কোনো বিষয় নয়। কেননা অসিয়ত ফরজ হওয়ার বিধান রহিত হয়ে গেছে। প্রয়োজন শর্তে অসিয়ত করা মুস্তাহাব।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন