ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, জঙ্গি তৎপরতা, মানবপাচার, জাল ডলার, প্রতারণা ও মাদকপাচারে জড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশে অবস্থানরত অনেক বিদেশি। এদের মধ্যে নাইজেরিয়া, সেনেগাল, লাইবেরিয়া, ঘানা, কেনিয়া, উগান্ডা, সোমালিয়া ও ভারতসহ আরও কয়েকটি দেশের নাগরিক বেশি। এদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোতেও রয়েছে জটিলতা।
বাংলাদেশে অবস্থান করা বিদেশিদের মধ্যে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায় আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা নাগরিকদের মধ্যে। বিভিন্ন অপরাধে গ্রেফতার হওয়ার পর বর্তমানে কারাগারে রয়েছে ৬০০ জন বিদেশি। এদের মধ্যে আফ্রিকার দেশগুলো থেকে আসা অপরাধী আছে চার শতাধিক। এদেরকে ফেরত পাঠানোর প্রশ্ন আসলে দেখা যাচ্ছে, তারা যেখান থেকে এসেছে সেসব দেশের সরকার তাদের দায় নিতে চাচ্ছে না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও কারাগার সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, দেশে অবস্থানকারী বিদেশি নাগরিকের ডাটাবেজ তৈরির কাজ চলছে। বৈধভাবে প্রায় ২ লাখ বিদেশি রয়েছেন। এদের মধ্যে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের আছে প্রায় ১৭ হাজার। অবৈধভাবে থাকা বিদেশি চক্র বিভিন্ন কৌশলে দেশের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে। চক্রটি কখনো চাকরি দেয়া, কখনো লটারি পেয়েছেন এমন এসএমএস বা মেইল পাঠায়। আবার দামি উপহারের প্রলোভন দেখিয়েও প্রতারণা করে। প্রায়ই চক্রের সদস্যরা গ্রেফতার হচ্ছে। আবার ছাড়া পেয়ে তারা একই অপরাধে জড়ায়।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, চাকরি দেয়ার নামে প্রতারণাসহ নানা অপরাধের সাথে বাংলাদেশে অবস্থানরত কিছু বিদেশির সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সক্রিয় রয়েছে পুলিশ।
তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ সচেতন ও সর্তক হলে প্রতারণার মতো অপরাধ থেকে রক্ষা পাওয়া সহজ হয়। প্রতারণা ও জালিয়াতির বিষয়ে প্রতিনিয়ত পুলিশের পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষকে সর্তক করা হচ্ছে মিডিয়ার মাধ্যমে। চাকরি কিংবা অন্য কোনো ক্ষেত্রে সর্তকতা অবলম্বন করার পাশাপাশি যে কোনো প্রয়োজনে পুলিশের সহযোগিতা গ্রহণ করার জন্য তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন সংস্থার পৃথক নজরদারিতে বিদেশি চক্রগুলো কৌশলে নিজেদের অবস্থান গোপন করছে। অনেকে এসেই পাসপোর্ট ফেলে পরিচয় আড়াল করছে। চাইলেও সহজে তারা কোন দেশ থেকে এসেছে তা শনাক্ত করা যায় না। প্রচলিত আইনে তাদের ফেরত পাঠাতে অনেক সময় প্রয়োজন। কেননা অনেক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। করোনার আগে থেকে অপরাধীদের নিজ দেশে পুশব্যাকও বন্ধ রয়েছে।
গত চার মাসে সিআইডি, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), পিবিআই ও র্যাব ৭০ জন কৃষ্ণাঙ্গ বিদেশিকে গ্রেফতার করেছে। গত তিন বছরে এই গ্রেফতারের সংখ্যা দুই শতাধিক। বাংলাদেশে ফেসবুকে উপহারের নামে প্রতারণা, হেরোইন, কোকেনসহ অপ্রচলিত মাদকের কারবার, ব্যাংকের এটিএম বুথের জালিয়াতি, বিভিন্ন দেশের জাল মুদ্রার কারবার, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, সোনা চোরাচালান, অনলাইনে ক্যাসিনো এবং মানবপাচারে এসব অপরাধীর জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিটি চক্রে বাংলাদেশি নারী সদস্যদের উপহার গ্রহণের নামে টাকা নিতে কাস্টমস কর্মকর্তা সাজানো হয়। সিআইডি ও ডিবি সূত্র বলছে, তারা সম্প্রতি কয়েকজন অপরাধীর তথ্য পেয়েছে। অপরাধী চক্রের সাথে জড়িতরা কিভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে সেটাও দেখা হচ্ছে।
জানা গেছে, চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত ১১০টি মামলায় র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয় দুই শতাধিক বিদেশি। সাতটি মামলায় নানা অপরাধে সিআইডির হাতে ধরা পড়েছে ৬০ বিদেশি। এ ছাড়া পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে তিন শতাধিক।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, বিদেশিদের ভাড়া দেয়ার সময় প্রত্যেক বাড়িওলাকে সব ধরনের তথ্য জেনে ভাড়া দেয়া উচিত। অনেকেই বাড়তি টাকার আশায় বিদেশিদের কোনো তথ্য না নিয়েই থাকার সুযোগ করে দেয়। এটাও অপরাধীদের একটা বড় আশ্রয়। এ ধরনের বাড়ির মালিকদেরও আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।
সম্প্রতি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পাঠানো একটি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীর উত্তরা, গুলশান, বনানী, বারিধারা, রামপুরা, বনশ্রী, ধানমন্ডিসহ কয়েকটি এলাকায় বসবাস করছে কয়েক হাজার অবৈধ বিদেশি নাগরিক। এদের অধিকাংশেরই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তারা খেলোয়াড়, ব্যবসায়ী বা পর্যটক পরিচয়ে অবস্থান করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে নানা অপরাধে জড়িত বিদেশি চক্রের সদস্যদের ধরা হলেও অপতৎপরতা বন্ধ করা যাচ্ছে না।
ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, মূলত ট্যুরিস্ট ও অন অ্যারাইভাল ভিসায় বিদেশিরা এ দেশে আসে। এদের বেশির ভাগই নানা ধরনের চাকরিতে নিয়োজিত হয়। আয়কর ফাঁকি দিতে এদের বড় একটি অংশ আর ভিসার মেয়াদ বাড়ায় না। এরাই পরে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। বিদেশি নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ ও যথাযথ তদারকির জন্য ‘বিদেশি নাগরিক নিবন্ধন আইন ২০১৫’ বিল সংসদে পেশ করা হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এই আইন বাস্তবায়ন করা হলে সব বিদেশিই নজরদারিতে চলে আসবে।
দেশে অবৈধভাবে বিদেশি নাগরিক কতদিন ধরে কতজন অবস্থান করছে? এর সঠিক তথ্য কারো কাছে নেই। ফুটবলার, গার্মেন্ট ব্যবসায়ী, ছাত্র ও পর্যটক হিসেবে তারা দেশে আসে। ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও নিজ দেশে ফিরে যায়নি।
স্পেশাল ব্রাঞ্চের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইমিগ্রেশনের তথ্যের ভিত্তিতে বিদেশিদের আসা এবং অবস্থানের সময় বের করে প্রতিবেদন দিচ্ছে। তবে বিদেশি অপরাধীরা অবস্থানের সময়কাল ঠিকানা ও নাম বদল করে ফেলছে। ফলে কেউ গা ঢাকা দিয়ে ভুয়া পরিচয়ে চললে তা যাচাই করার ব্যবস্থা নেই। এসব দুর্বলতা দূর করতে বিদেশি নাগরিকদের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে আইন প্রণয়ন করা জরুরি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন