শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

বৈধতা পাচ্ছেন প্রবাসীরা

মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার দালাল ছাড়াই রিক্যালিব্রেশন কর্মসূচি আবারো সিন্ডিকেটের আনাগোনা

শামসুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০০ এএম

করোনা মহামারিতে গোটা বিশ্ব যখন লন্ডভন্ড। মালয়েশিয়া সরকার তখন বৈধতা দেয়ার কর্মসূচি (রিক্যালিব্রেশন) চালু করায় দেশটিতে বসবাসকারী বাংলাদেশিসহ লাখ লাখ অবৈধ অভিবাসীদের মাঝে আশার আলো দেখা দিয়েছে। নিয়োগকর্তাদের মাধ্যমে অবৈধ কর্মীরা কোনা দালাল ছাড়াই দেশটির ইমিগ্রেশন থেকে সরাসরি বৈধতা লাভের সুযোগ পাচ্ছেন। বৈধতা লাভের সুযোগ কাজে লাগাতে দেশটিতে কর্মরত বাংলাদেশিরা নতুন পাসপোর্টের জন্য বাংলাদেশ হাইকমিশনে ভিড় জমাচ্ছেন। মালয়েশিয়া থেকে নির্ভরযোগ্য সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। গত ১ জানুয়ারি চালু হওয়া রিক্যালিব্রেশন কর্মসূচি আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত চলবে। এ সময়ের মধ্যে যারা বৈধতা লাভের সুযোগ কাজে লাগাতে পারবে না তারা দেশটির ইমিগ্রেশন আইনানুযায়ী কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হবেন। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় দেশটিতে অবৈধভাবে অবস্থানরত বাংলাদেশসহ ১৫টি দেশের অভিবাসী কর্মীরা চার ক্যাটাগরিতে বৈধতা লাভের সুযোগ পাচ্ছে।

বৈধতার এই খবরে আগের মতোই দেশি-বিদেশি অনেক প্রতারক চক্র, দালাল ও এজেন্ট সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে অভিবাসীদের মাঝে লোভনীয় অফার ও অপপ্রচার চালাচ্ছে। এদের অফার এবং অপপ্রচারে কেউ যাতে বিভ্রান্ত বা প্রতারিত না হন এজন্য কুয়ালালামপুরস্থ হাইকমিশন নানামুখী সচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়েছে। ইতোমধ্যে একটি গণনোটিশ জারি করা হয়েছে।
দেশটিতে বৈধতা লাভের সুযোগ কাজে লাগাতে অবৈধ কর্মী এবং যাদের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে তারা কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে ১ লাখ ১০ হাজার নতুন পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। দ্রæত এসব নতুন পাসপোর্ট বিতরণ করা সম্ভব না হলে হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মী বৈধতা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। মালয়েশিয়া থেকে একাধিক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
বিএমইটির সূত্র জানায়, শুরু থেকে এ যাবত মালয়েশিয়ায় ১০ লাখ ৫৭ হাজার ১৭১ জন কর্মী চাকরি লাভ করেছে। বর্তমানে দেশটিতে ৬ লাখের বেশি কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছে। ২০১৯ সালে দেশটি থেকে প্রবাসী কর্মীরা ১২৭৮ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। দশ সিন্ডিকেটের অনৈতিক কর্মকান্ডের দরুন ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে মালয়েশিয়ার তৎকালিন সরকার প্রধান মাহথির মোহাম্মদ ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেয়া বন্ধ করে দেন। এতে কলিং ভিসাপ্রাপ্ত আরো প্রায় ৫০ হাজার কর্মী দেশটিতে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। বাংলাদেশের দুয়ার বন্ধ হবার ফলে নেপাল থেকে কয়েক লাখ কর্মী মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
নিয়োগকর্তা এবং অভিবাসী কর্মীদের সুরক্ষায় এবার কোনো দালাল এজেন্ট বা ভেন্ডার নিয়োগ ছাড়াই রিক্যালিব্রেশন কর্মসূচি চালু করেছে মালয়েশিয়া সরকার। নিয়োগকর্তা বা কোম্পানি সরাসরি দেশটির ইমিগ্রেশনে অবৈধ কর্মীর তালিকা জমা দিয়ে কর্মীদের বৈধতা লাভের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছেন। এ সুযোগ নিয়ে বৈধভাবে অবস্থান করার জন্য সোর্সকান্ট্রিগুলোর অভিবাসীদের অনুরোধ করেছে সংশ্লিষ্ট দূতাবাস। এটি মালয়েশিয়ায় বিদেশি কর্মীদের এবং নিয়োগকর্তাদের শৃঙ্খলিত করার জন্য সরকারের প্রচেষ্টা। কিভাবে বৈধ হতে হবে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের রাষ্ট্রদূতদের সামনে এক বৈঠকে বৈধকরণ কর্মসূচির প্রক্রিয়া তুলে ধরেছেন দেশটির ইমিগ্রেশনের মহাপরিচালক দাতুক সেরি খায়রুল দাজাইমি দাউদ।
উল্লেখিত কর্মসূচির আওতায় বৈধ হবার জন্য নির্দিষ্ট শর্ত ও যোগ্যতা আরোপ করেছে দেশটির সংশ্লিষ্ট বিভাগ। যেমন বৈধভাবে মালয়েশিয়ায় গিয়ে নিয়োগকর্তার অধীনে কাজ করছে কিন্তু ভিসা নবায়ন করেনি বা ওভার স্টে হয়েছে, নিজ নিজ কোম্পানিতে কাজ করেনি এবং কোম্পানি থেকে পালিয়ে গেছে। এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হতে হবে ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ এর মধ্যে। এরপর হলে হবে না।
২০১৬ সালে রি-হায়ারিং নামে বৈধকরণ কর্মসূচি দিয়েছিল তার সাথে রিক্যালিব্রেশন এর কিছুটা পার্থক্য রয়েছে যা না বুঝলে প্রতারিত হতে হবে। যেমন রিহায়ারিং এ নৌ, সাগর বা স্থল পথে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করেছিল তাদেরকেও বৈধতা দিয়েছিল দেশটি। এবার সে সুযোগ নেই। রিহায়ারিং প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ভিসাধারিদেরও সুযোগ দিয়েছিল এবার সুনির্দিষ্ট করে পি এল কে এস উল্লেখ করা হয়েছে এবং অবশ্যই বৈধভাবে মালয়েশিযায় প্রবেশ করার প্রমাণ থাকতে হবে।
মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন ওয়েব সাইট এবং ফেসবুক পেজে প্রচার করছে যে, এবার কোম্পানি বা নিয়োগকর্তা সরাসরি ইমিগ্রেশনে কর্মীদের নামের তালিকা জমা দিয়ে বৈধতার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে। কোম্পানি নিয়োগ করতে পারবে কি না তা যাচাই করবে দেশটির লেবার ডিপার্টমেন্ট। রিহায়ারিং এর সময় অনেক ভুয়া ও ভ‚ইফোঁড় কোম্পানি বা নিয়োগকর্তা বৈধতার নামে প্রতারণা করেছিল। রিহায়ারিং কর্মসূচি শেষে হাজার হাজার কর্মীর প্রতারিত ও নিঃস্ব হবার কান্না ও অভিযোগ ছিল। অনেক প্রতারক হাজার হাজার কর্মীর নিকট থেকে অর্থ নিয়ে রাতারাতি কৌশলে বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়ে অবস্থান করে। ফলে তাদের মালয়েশিয়া পুলিশ খুঁজে পায়নি। যদিও হাইকমিশন থেকে সতর্ক করে লিফলেট, টিভিসি এবং অন্যান্য প্রচার করেছিল।
এদিকে, মালয়েশিয়া থেকে করোনা মহামারির আগে ছুটিতে দেশে আসা আটকে পড়া প্রবাসী কর্মীরা এখনো দেশটিতে যেতে পারেনি। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আটকে পড়া কর্মীদের মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সুযোগ দেয়ার জন্য ঢাকায় নিযুক্ত দেশটি হাই কমিশনারের মাধ্যমে অনুরোধ জানিয়েছেন।
মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তারা বৈধকরণ কর্মসূচির আওতায় কর্মী নিতে আগ্রহী। ইতোমধ্যে প্ল্যান্টেশন ও কৃষি সেক্টরে কর্মী সঙ্কটের সংবাদ মিডিয়ায় এসেছে। ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরেও অনেক কর্মী দরকার। ব্যয়বহুল কনস্ট্রাকশন সেক্টর করোনার প্রভাবে মন্দ অবস্থা চলছে। এই চারটি সেক্টরেই শুধু বৈধকরণ চলছে।
বর্তমানে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে আবারো ২৫ থেকে ৩০ জনের সিন্ডিকেট চক্রের আনাগোনা শুরু হয়েছে। এ নিয়ে ঢাকায় বায়রার সচেতন সদস্যরা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে সিন্ডিকেটবিরোধী আন্দোলন শুরু করেছেন। গতকাল সোমবার রাতে রাজধানীর মগবাজারস্থ কনভেনশন সেন্টারে বায়রা সিন্ডিকেট নির্মূল ঐক্য জোটের (৯টি সহযোগী সংগঠন) উদ্যোগে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে সিন্ডিকেটের অপচেষ্টা বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। রিক্রুটিং এজেন্সি ঐক্য পরিষদের সভাপতি এম টিপু সুলতানের সঞ্চালনায় সভায় বায়রার সাবেক নেতৃবৃন্দ সকল বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিকে মালয়েশিয়াসহ প্রত্যেক দেশে কর্মী প্রেরণের সুযোগ দেয়ার জোর দাবি জানানো হয়।
জি-টু-জি প্লাস পদ্ধতিতে দশ সিন্ডিকেট ২০১৭ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০১৮ সালের ৭ আগস্ট পর্যন্ত ১ লাখ ৯৪ হাজার ৯৪৯ জন কর্মীকে মালয়েশিয়ায় পাঠায়। প্রত্যেক কর্মী থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা নেয়ার কথা থাকলেও দশ সিন্ডিকেট জনপ্রতি তিন লাখ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সংক্রান্ত বায়রার তৎকালিন স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ড. ফারুকের মালিকানাধীন মেডিক্যাল সেন্টারসহ প্রায় ত্রিশটি মেডিক্যাল সেন্টার দশ লাখের বেশি মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মীর কাছ থেকে ৫ হাজার ৩শ’ টাকা করে নিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। এমএএস বাংলা ওভারসীজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমডি জামিল হোসেন গতকাল সোমবার ইনকিলাবকে বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে আবারো সিন্ডিকেটের আনাগোনা শুরু হয়েছে।
মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ায় প্রায় ৫০ হাজার কলিং ভিসার কর্মী দেশটিতে যেতে পারেনি। দশ সিন্ডিকেটের আর্শিবাদপুষ্ঠ মেডিক্যাল সেন্টারগুলো জনপ্রতি ৫ হাজার ৩শ’ টাকা করে নিয়ে প্রায় ১২ লাখ কর্মীর কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা পাচার করেছে। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়মিত চালু রাখার স্বার্থে কঠোর আইন তৈরি করে সকল বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিকে কর্মী প্রেরণের সুযোগ দিতে প্রধানমন্ত্রীকেই বাস্তবমুখী উদ্যোগ নিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (5)
আবদুল মান্নান ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:১৩ পিএম says : 0
অফার এবং অপপ্রচারে কেউ যাতে বিভ্রান্ত বা প্রতারিত হবেন না
Total Reply(0)
হাসান সোহাগ ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:১৪ পিএম says : 0
বাংলাদেশ হাইকমিশনকে সিন্ডিকেটের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
Total Reply(0)
পারভেজ ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:১৬ পিএম says : 0
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে আবারো সিন্ডিকেটের আনাগোনা শুরু হয়েছে। বিষয়টি খুবই উদ্বেগের
Total Reply(0)
আসাদ ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:১৬ পিএম says : 0
প্রবাসীদের ব্যাপারে সরকারকে আরও আন্তরিক হতে হবে।
Total Reply(0)
রিপন ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:১৮ পিএম says : 0
মালয়েশিয়ায় এখন বিভিন্ন সেক্টরে লোক লাগবে। এই সুযোগে আমাদেরকে বৈধভাবে আরও অনেক জনশক্তি রপ্তানি করতে হবে।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন