চট্টগ্রাম ব্যুরো : বন্দর নগরী চট্টগ্রামের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সেই ‘টর্চার সেল’ বা নির্যাতন কেন্দ্র ডালিম হোটেল। মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় বহালের খবর আসার সাথে সাথে সেই টর্চার সেলের সামনে গতকাল (মঙ্গলবার) চট্টগ্রামের সর্বস্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা মিছিল সহকারে সমাবেশে মিলিত হন এবং সবাই মিষ্টিমুখ করেন। তাছাড়া সেখানে গণজাগরণ মঞ্চও মিছিল করেছে। একাত্তরে চট্টগ্রামের আলবদর নেতা মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে বহুল আলোচিত ডালিম হোটেলে তৈরি করা হয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের লোকজনকে নির্যাতনের জন্য টর্চার সেল। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে বন্দি এবং অকথ্য নির্যাতন করা হতো। গতকাল সেই অভিশপ্ত ডালিম হোটেলের সামনে মিছিল-সমাবেশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা-জনতা এবং গণজাগরণ মঞ্চ। মিছিল শেষে বক্তব্যকালে মুক্তিযোদ্ধা ও গণজাগরণমঞ্চের নেতৃবৃন্দ মীর কাসেমের ফাঁসি দ্রুত কার্যকর করার পাশাপাশি তার সম্পদ বাজেয়াপ্তের জোর দাবিও জানান।
একাত্তরে মীর কাসেম আলীর নির্দেশেই চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রস্থল টেলিগ্রাফ অফিসসংলগ্ন এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্রীরঞ্জন নাথের মালিকানাধীন মহামায়া ভবন দখল করে নাম দেয়া হয় ডালিম হোটেল। সেখানে গড়ে তোলা হয় বদর বাহিনী চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঘাঁটি এবং বন্দিশিবির।
এদিকে গতকাল আদালতের আদেশ ঘোষণার পরই সকালে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী-সংগঠক এবং বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা নগরীর চেরাগি পাহাড় মোড়ে এসে জমায়েত হয়। চেরাগির মোড় থেকে গণজাগরণ মঞ্চের সদস্য সচিব ডা. চন্দন দাশের নেতৃত্বে মিছিল বের হয়। মিছিলটি আন্দরকিল্লা মোড় ঘুরে পুরানা টেলিগ্রাফ রোডে ডালিম হোটেলের সামনে যায়। মিছিলে অন্যান্যের মধ্যে নারী নেত্রী নূরজাহান খান, গণজাগরণ মঞ্চের সদস্য সচিব ডা. চন্দন দাশ, সমন্বয়কারী শরীফ চৌহান, উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের সহ-সভাপতি সুনীল ধর, প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের সভাপতি রাশেদ হাসান, সংস্কৃতিকর্মী হাবিব বিপ্লব, অমর-সাত্তার স্মৃতি পাঠাগারের সভাপতি অমিতাভ সেন, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী তরুণ উদ্যোগের যুগ্ম আহ্বায়ক প্রীতম দাশ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। ডালিম হোটেলের সামনে বক্তারা বলেন, একাত্তরের জল্লাদ মীর কাসেম আলীর ফাঁসি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। মীর কাসেমরা তাদের অর্থবিত্ত দিয়ে বিচার ঠেকানোর অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জনতাই জয়ী হয়েছে। মীর কাসেমের মৃত্যুদ-ের রায় বহাল রাখায় বিচারপতিদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মা শান্তি পেয়েছে।
মিছিল শেষে মীর কাসেমের ফাঁসির রায় বহালের আদেশে সন্তোষ প্রকাশ করে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। মিছিলকারীরা যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াত-শিবির এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আইন করে নিষিদ্ধের দাবি জানান।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আল বদর বাহিনীর চট্টগ্রামের ঘাঁটি ছিল ডালিম হোটেল। সেখানে বন্দিদের অমানবিক নির্যাতনের আর্তনাদ আজও তাড়িয়ে বেড়ায় অনেককে। আদালত সেই ডালিম হোটেলকে একটি ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’ হিসেবে বর্ণনা করেন। একাত্তরের ১৯৭১ সালের জুলাই-আগস্ট মহামায়া ভবনটি দখল করে নেন চট্টগ্রামের আল বদর নেতা মীর কাসেম ও তার অনুসারীরা। তখনই মহামায়া ভবনের নাম পাল্টে রাখা হয় ‘ডালিম হোটেল’। সেখানে নির্যাতনের শিকার মুক্তিযোদ্ধারা জানান, মীর কাসেম ও তার সহযোগীরা একাত্তরে খোলা জিপ ও অস্ত্র হাতে নিয়ে চট্টগ্রাম শহর দাপিয়ে বেড়াত। শহরের কোথাও কোনও মুক্তিযোদ্ধা গোপনে আশ্রয় নিয়েছেন বলে খবর পেলেই মীর কাসেমের নেতৃত্বে আল বদর বাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদের নিয়ে অভিযান চালিয়ে তাদের ধরে ডালিম হোটেলে নিয়ে আসত। মীর কাসেমের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সহযোগীদের ধরে সেখানে নিয়ে চালানো হতো অমানবিক নির্যাতন। ওই হোটেলে মীর কাসেম আলী এলে আল বদর সদস্যরা ‘ডা. খান আ গ্যায়া..., কাসেম সাব আ গ্যায়া’ বলে হাঁকডাক পড়ে যেত বলে জানান মুক্তিযোদ্ধারা। একাত্তরে মীর কাসেমের নৃশংসতার বর্ণনায় জানা গেছে, তার নির্দেশেই নগ্ন করে পেটানোর পর রক্তাক্ত অবস্থায় অন্ধকার কক্ষে বন্দিদের ফেলে রাখা হতো। বিভিন্ন কক্ষ থেকে ভেসে আসত বন্দিদের আর্ত-চিৎকার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন