শেখ জামাল ও মালেক মল্লিক :একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর রিভিউ আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এর ফলে মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় বহাল রয়েছে। জনাকীর্ণ বিচারকক্ষে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ গতকাল মঙ্গলবার এ রায় ঘোষণা করেন। এই রায়ের প্রতিবাদে আজ সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে জামায়াত। এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধে বিএনপি-জামায়াতের পাঁচ নেতার মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে। এদিকে মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগের দেয়া আদেশের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গতকাল রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রায়ের কপি পাঠায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর আগে বিকালে রায়ের কপি যায় ট্রাইব্যুনালে। বিচারপতিদের স্বাক্ষরের পর ট্রাইব্যুনালে রায়ের কপি পাঠানো হয়। এখন মীর কাসেম প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইলে তা নিষ্পত্তির পর, অথবা প্রাণভিক্ষা না চাইলে সরকারের ইচ্ছানুযায়ী যে কোন সময় ফাঁসি কার্যকর করা যাবে। এরই মধ্য দিয়ে সব আইনী প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। সব আইনী লড়াইয়ের মীর কাসেম হারলেন।
মীর কাসেম ১৯৭১ সালে ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতক সংগঠন আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান। পরে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বর্তমানে তিনি জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য।
বিচারিক আদালতে প্রমাণিত দশ অভিযোগের মধ্যে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার একাদশ অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ- বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ। এছাড়া দ্বিতীয়, তৃতীয়, সপ্তম, নবম, দশম ও চতুর্দশ অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মোট ৫৮ বছরের দ- বহাল রাখা হয়েছে আপিল বিভাগে। তবে চতুর্থ, ষষ্ঠ ও দ্বাদশ অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন মীর কাসেম। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে সরকারপক্ষ। তবে আসামিপক্ষ বলছে, মিথ্যা অভিযোগ ও সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে মীর কাসেমকে এ সাজা দেয়া হয়েছে।
রায় ঘোষণা উপলক্ষে সকাল ৯টা ২ মিনিটে এজলাসে আসন গ্রহণ করেন বিচারপতিরা। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সঙ্গে এজলাসে আসন গ্রহণ করেন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার এবং বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান। ৯টা ৪ মিনিটের দিকে আদালত রায় ঘোষণা করেন। আদালত জানান, মীর কাসেমের আপিলের রায়ে আগে একটি অংশে ভুল ছিল। চতুর্দশ অভিযোগ প্রমাণিত হলেও আপিলের রায়ে তাকে সাজা দেয়া হয়নি। সেই অভিযোগে তাকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ১০ বছরের সাজা বহাল রাখা হলো। রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা, ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ এবং আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী এস এম শাহজাহান। রায় ঘোষণা উপলক্ষে সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
রিভিউয়ের রায় প্রকাশ
মীর কাসেমের ফাঁসির চূড়ান্ত রায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বিকালে আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখা ২৯ পৃষ্ঠার রিভিউয়ের রায় প্রকাশ করে। এর আগে পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ সংশ্লিষ্ট বিচারপতিরা। পরে সেই রায় পাঠানো হয় এই মামলার বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। সন্ধ্যায় সেই রায়ে স্বাক্ষর করে কেন্দ্রীয় কারাগারে তা পাঠানো হয় রাতেই।
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার মো. সাব্বির ফয়েজ গতকাল বিকাল সোয়া ৫টায় রায় প্রকাশের কথা জানান। তিনি বলেন, “বিচারকদের স্বাক্ষরের পর রিভিউ রায় প্রকাশ করা হয়েছে। ২৯ পৃষ্ঠার এই রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়েছে।” এরপর সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মেহেদী হাসান সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে রায়ের অনুলিপি পৌঁছে দেন এ মামলার বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। তার কাছ থেকে অনুলিপি বুঝে নেন ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার শহীদুল আলম ঝিনুক। নিয়ম অনুযায়ী, ট্রাইব্যুনাল, কারা কর্তৃপক্ষ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য রায়ের তিনটি অনুলিপি ট্রাইব্যুনালে যায়। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও দুই পক্ষের আইনজীবীকেও অনুলিপি পাঠাতে হয়।
ট্রাইব্যুনাল ওই রায়ের আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কারা কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেবে। আদেশে ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের সই নিয়ে রায়ের কপিসহ পাঠানো হবে কারা কর্তৃপক্ষ, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ে। এরপর কারা কর্তৃপক্ষ রায় ও আদেশ পাঠাবে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে। কাসেম এখন সেখানেই আছেন।
বিচার প্রক্রিয়া
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ জুন গ্রেফতার হন মীর কাসেম। পরে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে কারাগারে পাঠানো হয় তাকে। ২০১৩ সালের ১৬ মে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয় ওই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর। ৩০ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে মামলাটি স্থানান্তর করা হয় ট্রাইব্যুনাল-২-এ। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল যুক্তিতর্ক শুরু করে প্রসিকিউশন। মামলাটি ট্রাইব্যুনালে রায়ের অপেক্ষায় রাখা হয় ওই বছরের ৪ মে। ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর তাকে মৃত্যুদ- দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করেন। গত ৮ মার্চ মীর কাসেমের মৃত্যুদ- বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। সেই রায়ের বিরুদ্ধে তিনি রিভিউ আবেদন করেন।
মীর কাসেম আলী ষষ্ঠ ব্যক্তি যিনি মানবতাবিরোধী অপরাধে আপিলেও চূড়ান্তভাবে মৃত্যুদ- পেয়েছেন। এর আগে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন