শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

অহঙ্কারী ও দাম্ভিকদের নির্মম পরিণতি

মোঃ আবদুল গনী শিব্বীর | প্রকাশের সময় : ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০৬ এএম

কওমে সামুদ বা সামুদ জাতিঃ সামুদ জাতি শিল্প ও সংস্কৃতিতে পৃথিবীতে অপ্রতিদ্ব›দ্ধী। আদ জাতির পর তারাই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী জাতি। কিন্তু তাদের জীবনযাপনের মান যতটা উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল, মানবতা ও নৈতিকতার মান ততই নিম্নগামী ছিল।

একদিকে উন্মুক্ত প্রান্তরে পাথর খোদাই করে করে প্রাসাদের পর প্রাসাদ তৈরি হচ্ছিল, অন্যদিকে সমাজে কুফর, শিরক ও পৌত্তলিকতার প্রসার ঘটছিল। সমাজে চরিত্রহীন লোকের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। হজরত সালেহ (আ.) তাদের প্রতি প্রেরিত হয়ে সত্যের দাওয়াত দিয়েছেন, তাতে কেবল নিম্ন শ্রেণির লোকেরাই সাড়া দেয়। সালেহ (আ.) সারা জীবন তাদের হেদায়েতের পথে আনার চেষ্টা করেছেন। এতে অল্প কিছু সঙ্গী ছাড়া গোটা জাতি তার অবাধ্যই থেকে যায়। একপর্যায়ে তারা দাম্ভিকতা নিয়ে দাবি করে, আপনি যদি সত্যি নবী হয়ে থাকেন, তাহলে আমাদের ‘কাতেবা’ নামের পাথরময় পাহাড়ের ভেতর থেকে একটি ১০ মাসের গর্ভবতী, সবল ও স্বাস্থ্যবতী মাদি উট বের করে দেখান। এটি দেখাতে পারলে আমরা আপনার ওপর ইমান আনব। সালেহ (আ.) আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। আল্লাহর কুদরতে পাহাড় থেকে একটি অদ্ভুত রকমের মাদি উট বের হয়। তা দেখে কিছু লোক ইমান আনে। কিন্তু তাদের সর্দাররা ইমান আনেনি, বরং তারা সে মাদি উটকে হত্যা করে ফেলে। এতে সালেহ (আ.) তার জাতির ওপর আল্লাহর আজাব নেমে আসার ঘোষণা দেন। তিনি তাদের সতর্ক করে দেন যে তিন দিন পরই আল্লাহর আজাব তোমাদের ধ্বংস করে দেবে। নির্ধারিত সময়ে আসমানি আজাব ও গজব এসে অবিশ্বাসীদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
আল্লাহপাক বলেন, ‘তারপর সীমা লঙ্ঘনকারীদের মহানাদ আঘাত করে। ফলে তারা নিজ নিজ গৃহে উপুড় হয়ে পড়ে থাকে (ধ্বংস হয়ে যায়)। যেন তারা কখনোই সেখানে বসবাস করেনি। উদ্ধত সামুদ জাতির প্রতি হজরত সালেহ (আ.)-এর হুঁশিয়ারি সত্যি বাস্তবায়িত হয়েছে। হঠাৎ একদিন প্রচন্ড শব্দে ভূমিকম্প তাদের নাস্তানাবুদ করে ফেলে। বজ্রপাতের ভয়ংকর শব্দে মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত ও আতঙ্কিত হয়ে যায়। অবশেষে তাদের অপমৃত্যু ঘটে।
কওমে নুহ বা নুহ (আ.) এর জাতিঃ আদমে সানী খ্যাত হযরত নুহ (আ.)-এর জাতি মূর্তিপূজা করত। আল্লাহ তায়ালা নুহ (আ.)-কে সুদীর্ঘ জীবন দান করেছিলেন। তিনি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে মূর্তিপূজা ত্যাগ করতে বলেছেন। কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী অক্লান্তভাবে দাওয়াত দেওয়ার পরও তারা ইমান আনেনি। তিনি তার জাতিকে সত্যের পথে আনতে দীর্ঘ ৯৫০ বছর নিরলস চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কিন্তু তারা নুহ (আ.)-এর দাওয়াত তাচ্ছিল্যভরে প্রত্যাখ্যান করে। তারা তাকে বলেছিল, ‘হে নুহ! যদি তুমি বিরত না হও, তবে পাথর মেরে তোমার মস্তক চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়া হবে। বহু চেষ্টায় অহংকারী ও দাম্ভিক জাতির অল্পসংখ্যক মানুষ তার আহবানে হেদায়েতের পথে এসেছিল। তার সময়ের সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা তার কথায় কর্ণপাত করেনি। নুহ (আ.) তাদের আল্লাহর শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করেন। তবু তাদের চৈতন্যোদয় হয়নি, তারা তার কথাকে মোটেও পাত্তা দেয়নি। অবশেষে আল্লাহর আজাব আসে। এক ভয়ংকর প্লাবন ও জলোচ্ছ্বাস তার জাতির অবাধ্য লোকদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এমন প্লাবন সেই জাতিকে গ্রাস করেছিল, যেই প্লাবন হাজার বছর ধরে পৃথিবীতে ইতিহাস হয়ে আছে। তখন নুহ (আ.)-এর নৌকায় যারা আশ্রয় নিয়েছিল তারাই রক্ষা পেয়েছিল।
কওমে মুসা বা মুসা (আ.) এর জাতিঃ হযরত মুসা (আ.) এর যমানায় অহংকার ও দাম্ভিকতায় নিজেকে খোদা দাবি করেছিল মিশরের অধিপতি ফেরাউন। তার কাছে ইমানের দাওয়াত নিয়ে গিয়েছিলেন হযরত মুসা ও হারুন (আ.)। বিনিময়ে হযরত মুসা (আ.) ও তাঁর প্রতি বিশ্বাসীদেরকে হত্যা করতে মনস্থির করে ফেরাউন। তার দাম্ভিক আচরণ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে এসেছে- আল্লাহপাক বলেন,‘ফেরাউন জমিনে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিল এবং সে তার অধিবাসীদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করেছিল। তাদের একটি শ্রেণীকে সে অত্যন্ত দুর্বল করে রেখেছিল, যাদের পুত্রদের সে যবাই করত ও নারীদেরকে জীবিত রাখত। প্রকৃপক্ষে সে ছিল বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। (কাসাস ২৮ : ৪)। ফেরআউনের অহংকারী মনোভাব ও দাম্ভিক আচরণের কারণে আল্লাহতায়ালা তার জাতিকে বিভিন্ন শাস্তিতে নিপতিত করেন। আল্লাহপাক বলেন, ‘অতঃপর, আমি তাদেরকে প্লাবন, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ এবং রক্ত দ্বারা পরীক্ষা করি। (সূরা আরাফ: আয়াত: ১৩৩)। এর পূর্বের আয়াতে বলা হয়, ‘এবং নিশ্চয় আমি ফেরাউন বংশকে দুর্ভিক্ষ ও ফল-শস্য হানির দ্বারা ধৃত করেছিলাম, যেন তারা হৃদয়ঙ্গম করে।’ (সূরা আরাফ: আয়াত: ১৩০)। এ সকল শাস্তির পরও দাম্ভিক ফেরআউন ও তার জাতি শিক্ষাগ্রহণ করেনি। বরং তারা হযরত মুসা (আ.) ও তাঁর প্রতি বিশ্বাসী লোকদেরকে দুনিয়া থেকে হত্যার মাধ্যমে একেবারে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য সদলবলে ধাওয়া করে। তিন দিক থেকে সশস্ত্র সৈন্য ঘেরাও হওয়া মুসা (আ.) ও তাঁর দলের সামনে ছিল উত্তাল সাগর। আল্লাহর হুকুমে সাগরে পথ সৃষ্টি হয়। নিজের দল নিয়ে মুসা (আ.) এই পথ দিয়ে সমুদ্র পার হয়ে যান। কিন্তু সাগরে ডুবে মারা যায় ফেরাউন। আল্লাহপাক ফেরআউনের নির্মম পরিণতির কথা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘ফেরাউন ও তার বাহিনী জমিনে অন্যায় অহমিকা প্রদর্শন করেছিল। তারা মনে করেছিল তাদেরকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে না। সুতরাং আমি তাকে ও তার সৈন্যদেরকে পাকড়াও করলাম এবং সাগরে নিক্ষেপ করলাম। এবার দেখ, জালিমদের পরিণতি কী হয়ে থাকে! (সূরা আল কাসাস: আয়াত: ৩৯-৪০)। আল্লাহ তাকে পৃথিবীবাসীর কাছে দৃষ্টান্ত হিসেবে রেখে দিয়েছেন। আল্লাহপাক বলেন, আমি বনী ইসরাইলকে সাগর পার করিয়ে দিলাম। তখন ফিরআউন ও তার বাহিনী যুলুম ও সীমালঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল। পরিশেষে যখন সে ডুবে মরার সম্মুখীন হলো, তখন বলতে লাগল, আমি স্বীকার করলাম, বনী ইসরাইল যেই আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে তিনি ছাড়া কোনোও ইলাহ নেই এবং আমিও অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত। (উত্তর দেয়া হলো) এখন ঈমান আনছ? অথচ এর আগে তো তুমি অবাধ্যতা করেছ এবং তুমি অশান্তি সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে। সুতরাং আজ আমি তোমার দেহটি রক্ষা করব, যাতে তুমি তোমার পরবর্তী কালের মানুষের জন্য নিদর্শন হয়ে থাক।
(কেননা) আমার নিদর্শন সম্পর্কে বহু লোক গাফেল হয়ে আছে।’ (সুরা ইউনুস: আয়াত: ৯০-৯২)। তিন হাজার বছরেরও বেশি সময় সাগরে নিমজ্জিত থাকার পরও তার লাশে কোনো পচন ধরেনি।
এভাবে যুগে যুগে মহান রাব্বুল আলামীন হটকারী অহংকারী ও দাম্ভিক জাতির নেতা, জনগণ ও জনপদকে স্বীয় গজব ও লানত দ্বারা একেবারে সমূলে নিশ্চিন্ন করে দেন। আল্লাহপাক তাঁর রহমত দ্বারা যেন আমাদেরকে সিক্ত করে সকল প্রকার আযাব ও গজব থেকে হেফাজত করেন। আমীন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন