মো. শফিকুল ইসলাম ওরফে সফিকুল ওরফে সকি ওরফে শইক্কা (৩১)। সুনামগঞ্জ থেকে চট্টগ্রাম এসে উঠেন আবাসিক হোটেলে। সেখান থেকে কয়েকদিনে নগরীর অন্তত ৬০টি বাড়িতে চুরি করেন। দ্রুতসময়ে গ্রিল কেটে বাসায় ঢুকে মালামাল লুটে পারদর্শী শইক্কা রাতে-দিনে একাধিক বাড়িতে চুরি করেছেন। নগরীর লাভলেইন এলাকায় একুশে পদকপ্রাপ্ত নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দারের বাসায় চুরি করে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন শইক্কা। এরপর তার জবানবন্দীতে চাঞ্চল্যকর অসংখ্য চুরির তথ্য পায় পুলিশ।
শইক্কার মত চট্টগ্রাম মহানগরীতে অগণিত গ্রিল কাটা চোর এখন সক্রিয়। পেশাদার চোরচক্রের সাথে রয়েছে ভাসমান অপরাধীরা। রাতে-দিনে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাসাবাড়িতে হানা দিয়ে স্বর্ণালঙ্কার, নগদ টাকা, ল্যাপটপ, আইফোনসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিচ্ছে তারা। বিশিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা ক্ষমতাধরের বাসায় চুরির ঘটনা ঘটলে মামলা নিচ্ছে পুলিশ। ধরা পড়ছে চোর চক্রের সদস্যরা। চুরির মালামালও উদ্ধার হচ্ছে। তবে বেশিরভাগ ঘটনায় থানায় মামলা হয় না। প্রতিকার পাবেন না এমন আশঙ্কায় থানায় যাননা অনেকে।
আবার থানায় গেলেও মামলা না নেয়ার অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। কিছু ক্ষেত্রে মামলা নেওয়া হলেও চোরাই মালামাল ফেরত পাচ্ছেন এমন সৌভাগ্যবানের সংখ্যা হাতেগোনা। ফলে নগরজুড়ে এখন গ্রিলকাটা, তালা ভাঙা চোর আতঙ্ক বিরাজ করছে। খালি বাসাবাড়িতে দিনদুপুরেও চুরি হচ্ছে। বহুতল ভবন এবং ফ্ল্যাট বাড়িতে হানা দিচ্ছে চোরের দল। তবে মহানগর পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, চুরি বা দস্যুতার ঘটনায় মামলা হচ্ছে, আসামিরাও গ্রেফতার হচ্ছে। নিয়মিত অভিযানে চোরচক্রের সদস্যদের পাকড়াও করা হচ্ছে।
নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দারের বাসায় ১ ফেব্রুয়ারি রাতে হানা দেয় চোর। দুটি আইফোন, হাত ঘড়ি ও ৩০টি শাড়ি চুরির ঘটনায় তিনি কোতোয়ালী থানায় মামলা করেন। ঘটনার এক সপ্তাহের মাথায় ধরা পড়ে চোরচক্রের হোতা সুনামগঞ্জের শইক্কা। নগরীর রেয়াজুদ্দিন বাজারের হোটেল হার্ট অব সিটি থেকে তাকে পাকড়াও করা হয়। তার কাছ থেকে বেশকিছু স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার করা হয়। পরে তার দেয়া তথ্যে, সহযোগী আনোয়ার হোসেনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় দুটি আইফোন।
পুলিশ জানায়, দেশের বড় বড় শহরে চুরি করতে যায় শইক্কা। আবাসিক হোটেলে অবস্থান করে টানা ১৫ দিন চুরি করার পর ওই শহর ত্যাগ করে। ১৫ দিনের টার্গেট নিয়েই চুরি করতে চট্টগ্রাম আসে সে। ১০ দিনে ৫০-৬০টি বাড়িতে চুরি করে। ৪ ফেব্রুয়ারি নগরীর পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার একটি খালি ফ্ল্যাটে গ্রিল কেটে ঢুকে ২৫ ভরি স্বর্ণালঙ্কার লুট করে। ওই বাসায় রাতের খাবার গ্রহণ এবং শেষে চা বানিয়ে খায়। নগরীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় রিকশা কিংবা হেঁটে রেকি করে সে। যে বাড়িতে তালা দেয়া থাকে তাকে টার্গেট করে। এসব বাড়িতে দিনের বেলায়ও চুরি করেছে সে। লোকজন আছে এমন বাড়িতে রাতের আঁধারে গ্রিল কেটে চুরি করে এ পাকা চোর। এই নগরীতে আছে তার বেশ কয়েকজন সহযোগী।
গত ১ অক্টোবর নগরীর ফিরিঙ্গীবাজার আর সি চার্জ রোডের বাসা থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে যান হুমায়ুন মোরশেদ সিদ্দিকী। এ ফাঁকে জানালার গ্রিল কেটে মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যায় চোরের দল। ৩৯ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ভর্তি লকার বা সিন্দুক ছাড়াও নগদ ৭০ হাজার টাকা, লাখ টাকা দামের আইফোন, স্ত্রী-পুত্রের পাসপোর্টসহ মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়া হয়। এ মামলা তদন্তে মাঠে নামে পুলিশ। দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ মাস পর ধরা পড়ে চোরচক্রের চার সদস্য। গত বুধবার পুলিশ চারজনকে গ্রেফতার করে। তাদের দেয়া তথ্যমতে, হাজারী গলির একটি স্বর্ণের দোকান থেকে উদ্ধার করা হয় ২৩ ভরি ওজনের গলানো স্বর্ণ। ওই বাসা থেকে চুরি করা স্বর্ণালঙ্কার গলিয়ে বিক্রি করা হয় ওই জুয়েলারীতে।
পুলিশ জানায়, গ্রেফতার আব্দুল আজিজ, বশির বাচ্চু ওরফে বশর ও ওসমান পেশাদার চোর। তারা আগে বেশ কয়েকবার চুরির অপরাধে জেল খাটে তারা। ঘটনার কয়েক মাস আগে জেলখানায় অপর আসামী সুমন ধরের সাথে তাদের পরিচয় হয়। সুমন ধর তার প্রথম স্ত্রীর করা নারী নির্যাতন মামলায় জেলহাজতে ছিল। সে সুবাদে আসামীদের মধ্যে সখ্যতা হয়। জেল থেকে বের হয়ে তারা ফিরিঙ্গী বাজারের ওই বাসায় গ্রিল কেটে হানা দেয়।
অন্যান্য মালামালের সাথে লোহার সিন্দুকটিও নিয়ে যায় তারা। সিন্দুকটি কর্ণফুলীর ওপারে নিয়ে গ্রান্ডার মেশিন দিয়ে কেটে স্বর্ণালঙ্কার বের করা হয়। আসামিরা জানায়, তারা একই কায়দায় শুধু কোতোয়ালী থানা এলাকায় গত কয়েক মাসে ৬-৭টি বাড়িতে চুরি করে। চুরি করার জন্য তারা দিনের বেলায় আবাসিক এলাকায় ঘুরে খবর নিত কোন বাসা খালি। যেখানে মানুষের আনাগোনা নেই সে বাড়িকে টার্গেট করে চুরি করত। তাদের একটি গ্রুপ বাড়িতে ঢুকত অন্যরা বাইরে পাহারা বসাত। মহানগরীতে এমন চোরচক্রের শতাধিক সদস্য সক্রিয় বলে জানান নগর পুলিশের কর্মকর্তারা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন