বিলুপ্ত কোম্পানির মাধ্যমে কর্মী প্রেরণের চেষ্টা : মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার সাথে দফায় দফায় বৈঠক
শামসুল ইসলাম : সিঙ্গাপুরের শ্রমবাজার অস্থিতিশীল করে তুলতে একটি চক্র আবারো তৎপর হয়ে উঠেছে। চড়া অভিবাসন ব্যয়ে বিলুপ্তকৃত কোম্পানির মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে কর্মী প্রেরণের লক্ষ্যে চীনা বংশদ্ভূত সিঙ্গাপুরের এক নাগরিক বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছে। ইতোমধ্যে সিঙ্গাপুরের নাগরিক ভিক্টর লী সিওং কী ওরফে ভিক্টর লী বেশ কয়েকবার ঢাকায় এসে কর্মী প্রেরণের লক্ষ্যে সিন্ডিকেট তৈরিতে কয়েক দফা মিটিং করেছেন। মি. লী বাংলাদেশ থেকে যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ট্রেনিং দিয়ে সিঙ্গাপুরে কর্মী প্রেরণ করছেন, সেই প্রগ্রেসিভ টেস্ট সেন্টার (প্রা.) লি. কোম্পানিটি যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদফতর থেকে বিলুপ্ত করা হয়েছে। মি. লী সরকারি বিধি তোয়াক্কা না করে বর্তমানে উচ্চ অভিবাসন ব্যয়ে (জনপ্রতি ৫ লাখ টাকা) সিঙ্গাপুরে কর্মী প্রেরণে প্রকাশ্যে প্রস্তাব দিয়ে বেড়াচ্ছেন। ইতোমধ্যে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আকরাম হোসেনের সাথে সক্ষতা গড়ে তুলছেন মি. লী। মি. লী যুগ্ম সচিব আকরাম হোসেনের সাথে কয়েক দফা বৈঠক করে কর্মীদের কাছ থেকে ৪-৫ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে তৎপরতা চালাচ্ছে। কর্মী প্রেরণে জনপ্রতি ৪-৫ লাখ টাকা আদায় করার কৌশল হিসেবে মন্ত্রণালয়কে ভুল বোঝানোর লক্ষ্যে যুগ্ম সচিব আকরাম হোসেনের পরামর্শে মি. লী সম্প্রতি একটি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন করেন, যে প্রেজেন্টেশনে সিঙ্গাপুরে কর্মী প্রেরণের জন্য ৫ লাখ টাকা করে আদায় করার কথা উল্লেখ রয়েছে। সিঙ্গাপুরে কর্মী প্রেরণে সরকার জনপ্রতি অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করেছে ৮৪ হাজার টাকা। সেখানে মি. লী প্রকাশ্যে জনপ্রতি ৫ লাখ টাকা করে সিঙ্গাপুরে কর্মী প্রেরণের দুঃসাহস কিভাবে দেখায় তা বোধগম্য নয়। একজন জনশক্তি রফতানিকারক এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
জানা গেছে, মি. লীর কোম্পানিতে কর্মরত বাংলাদেশীদের অনেকেই ৫শ’ থেকে ৬শ’ সিঙ্গাপুরি ডলার বেতন পায়। এদের অনেকেই এক বছরের মধ্যে কাজের চুক্তি শেষে খালি হাতে দেশে ফিরে আসে। বিএমইটি’র সূত্র জানায়, ১৯৭৯ সালে প্রথম সিঙ্গাপুরে ১১০জন কর্মী কর্মসংস্থানের সুযোগ লাভ করে। বর্তমানে সিঙ্গাপুরে নব্বই হাজার থেকে এক লাখ বাংলাদেশী কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে দেশে প্রচুর রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে। ১৪টি বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মীরা সিঙ্গাপুরে যাচ্ছে। দেশটিতে জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ কয়েক মাস আগে ওই দেশের আদালত ৫ জন বাংলাদেশী কর্মীকে সাজা দিয়েছে। গত মঙ্গলবারও সিঙ্গাপুর আদালত আরো দু’জন বাংলাদেশীকে জঙ্গিবাদের সাথে সম্পৃক্ততার জন্য শাস্তি দিয়েছে। এ নিয়ে সিঙ্গাপুরে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের মাঝে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। একজন জনশক্তি রফতানিকারক ইনকিলাবকে বলেন, সিঙ্গাপুরে প্রচুর বাংলাদেশী কর্মীর চাহিরা রয়েছে। বাংলাদেশী কর্মীরা সিঙ্গাপুরে কঠোর পরিশ্রম করে জীবিকা অর্জন করছে। দেশটিতে বাংলাদেশী সাধারণ কর্মীরা প্রতি মাসে ৮শ’ থেকে ১ হাজার সিঙ্গাপুরি ডলার আয় করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১২ সালের ৮ মে যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদফতর কোম্পানি আইনের ৩৪৬(৫) ধারা মোতাবেক প্রগ্রেসিভ টেস্ট সেন্টার (প্রা.) লিমিটেড নামের কোম্পানির নাম পরিদফতরের নিবন্ধন বই থেকে কেটে কোম্পানিটি বিলুপ্ত করা হয়, যাতে উল্লেখ করা হয় উক্ত কোম্পানির পরিচালক বা সদস্যদের কোনো দায় দেনা থাকলে তা পরিশোধ করতে হবে। প্রগ্রেসিভ টেস্ট সেন্টার বিলুপ্ত সংক্রান্ত বিষয়ে গত ২০১২ সালের ৮ মে গেজেটে নোটিশ আকারে প্রকাশিত হয়। জানা গেছে, প্রগ্রেসিভ টেষ্ট সেন্টার ২০১২ সালে যৌথ মূলধনী কোম্পানি কর্তৃক বিলুপ্ত হইলেও গত ৪ বছর ধরে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে কোম্পানি বিলুপ্ত সংক্রান্ত তথ্য গোপন করে প্রতিবছর সরকারের অনাপত্তিপত্র গ্রহনের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে কর্মী প্রেরণ করে আসছে। ২০১৫ সালের ১০ আগস্ট সর্বশেষ প্রগ্রেসিভ টেস্ট সেন্টার সিঙ্গাপুরে কর্মী প্রেরণের নিমিত্তে ওয়েসিসি সার্ভিসেস রিক্রুটিং লাইসেন্স নং ৯৯৯ এবং জিহান ওভারসিস রিক্রুটিং লাইসেন্স নং ১১০৪-এর জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে তালিকাভুক্ত হয়। মি. ভিক্টর লী সিওং কী ওরফে ভিক্টর লী এর বাংলাদেশী পার্টনার ওয়েসিসি সার্ভিসেস রিক্রুটিং লাইসেন্স এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হুদা মেহেদী ইতিপূর্বে সিঙ্গপুরে কর্মী প্রেরণে প্রতারণার কারনে দীর্ঘ দিন থেকে সিঙ্গাপুর যেতে পারছে না। সিঙ্গাপুর ইমিগ্রেশন নাজমুল হুদা মেহেদীকে ব্ল্যাক লিস্টেড করে রেখেছে।
এদের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে প্রেরণকৃত কর্মীদের বেশিরভাগই সিঙ্গাপুর গিয়ে উপযুক্ত বেতন-ভাতা পাচ্ছে না। অন্যদিকে কোম্পানি বিলুপ্তর পরও প্রতারণার উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে জানা যায়। তাছাড়া বিলুপ্ত কোম্পানি ব্যবসা পরিচালনা করলে সরকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়। ইতিমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রগ্রেসিভ টেস্ট সেন্টার তথা ভিক্টর লী সম্পর্কে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে। ২০১৩ সালে ৬০ হাজার ৫৭জন কর্মী সিঙ্গাপুরে চাকরি লাভ করেছে। ২০১৪ সালে ৫৪ হাজার ৭৫০ জন কর্মী, ২০১৫ সালে ৫৫ হাজার ৫২৩ জন কর্মী এবং গত জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে ৩৩ হাজার ৫৪২ জন কর্মী চাকরি লাভ করেছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সিঙ্গাপুর থেকে প্রবাসী বাংলাদেশীরা ৪২৯ দশমিক ১১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রবাসীরা দেশটি থেকে ৪৪৩ দশমিক ৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জুন পর্যন্ত সিঙ্গাপুর থেকে প্রবাসীরা ৩৮৭ দশমিক ২৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেশে পাঠিয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন