শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

বাগিয়ে নিতে মরিয়া জিকে শামীম চক্র

সিকৃবির ১৪ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ

ফয়সাল আমীন | প্রকাশের সময় : ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০০ এএম

এবার সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে চোখ পড়েছে কারান্তরীণ ব্যবসায়ী জিকে শামীম চক্রের। সর্বনিম্ন দরদাতাকে টপকে উন্নয়ন কাজ হাতিয়ে নিতে মরিয়া হয়ে উঠছে তারা। প্রভাব বিস্তার, লবিংসহ ম্যানেজ প্রক্রিয়াও চূড়ান্ত বলে সূত্র জানিয়েছে। এ নিয়ে তোলপাড় চলছে সিকৃবিতে।

সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, জিকে শামীম চক্রের থাবায় উন্নয়ন কাজ ভেস্তে যেতে পারে সিকৃবির, সেই সাথে লোপাট হয়ে যেতে পারে বরাদ্দকৃত টাকা। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে (চবি) ৭৫ কোটি টাকার কাজ জাল কাগজপত্র দাখিল করে প্রতারণার মাধ্যম হাতিয়ে নেয়ার ঘটনার একটি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছিল মো. গোলাম কিবরিয়া শামীমকে (জিকে শামীম)। ওই মামলার অপর আসামি হলেন জিকে শামীম চক্রের অন্যতম সদস্য দি বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স এসোসিয়েটস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল করিম চৌধুরীকে (স্বপন)। সিকৃবির দরপত্র আহবান সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র আশঙ্কা করছেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এ চক্র দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির অযোগ্যতা ও অদক্ষতার সুযোগে ৭৫ কোটি টাকার কাজ অতি সূক্ষভাবে হাতিয়ে নিয়েছিল। একই ঘটনা সিকৃবির বেলায় ঘটাতে পারে তারা। সূত্র জানায়, জিকে শামীমের অন্যতম সহযোগী দি বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স এসোসিয়েটস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল করিম চৌধুরীকে (স্বপন) কেন্দ্রীয় যুবদলের সিনিয়র সদস্য। তার রাজনীতিক পরিচয়ও বির্তকিত।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২টি একাডেমিক ভবন ও অডিটোরিয়াম নির্মাণের লক্ষ্যে আহবান করা হয় দরপত্র। নির্মাণ খরচ বাবদ প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় প্রায় ১৩ কোটি ৭৫ লাখ ৬ হাজার ৪৩৩ টাকা। ইজিপি দরপত্র খোলা হয় গত ২৫ জানুয়ারী। এতে অংশগ্রহণ করে ৩টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান ছিল মেসার্স ফ্রেন্ডস ইন্টারন্যাশনাল। এছাড়া ঢালি কনস্ট্রাকশন ২য় দরদাতা ও ৩য় দরদাতা প্রতিষ্ঠান ছিল দি বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স এসোসিয়েটস-চৌধুরী এন্টারপ্রাইজ। দরপত্রে মেসার্স ফ্রেন্ডস ইন্টারন্যাশনাল ১৩ কোটি ৪৩ লাখ, ৫৮ হাজার ৩০৩ টাকা, ঢালি কনস্ট্রাকশন ১৩ কোটি ৭২ লাখ ৮১ হাজার ২৬২ টাকা ও দি বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স এসোসিয়েটস-চৌধুরী এন্টারপ্রাইজ ১৩ কোটি ৭৪ লাখ ৬০ হাজার ৬৪ টাকা উল্লেখ করেন। ২য় ও ৩য় দরদাতা প্রতিষ্ঠান দুটিই আলোচিত ব্যবসায়ী জিকে শামীম চক্রের বলে জানা গেছে। শর্ত অনুযায়ী সর্বনিম্ন দরদাতা কাজের সুযোগ পাবেন। সেই অনুসারে উন্নয়ন কাজের সুযোগ পাবে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান মেসার্স ফ্রেন্ডস ইন্টারন্যাশনাল। কিন্তু তার বদলে জিকে শামীম চক্র নিয়মের ব্যতয় ঘটিয়ে কাজটি হাতিয়ে নিতে বহুমুখী অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

সিকৃবি সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ একাডেমিক ভবনের (২য় কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ ভবন) দ্বিতীয় পর্যায়ের নির্মাণ কাজের জন্য ২০১৬ সালের ২৮ আগস্ট দরপত্র আহ্বান করা হয়। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে দি বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স-জিকেবিএলকে তাদের দাখিল করা একক মালিকানধীন ফার্ম হিসেবে ৭৫ কোটি একলাখ ২৯৫ টাকার কার্যাদেশ দেয়া হয়। দুই বছরের মধ্যে কাজ সমাপ্ত করার শর্তে ওই বছরের ১৪ নভম্বের তাদের চুক্তি হয়। দি বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স-জিবেবিএলকে তাদের দাখিল করা কাগজের সঙ্গে আগের পাঁচ বছরের কমপক্ষে একটি ৩৫ কোটি টাকার বহুতল ভবন নির্মাণ কাজ সন্তোষজনকভাবে সমাপ্তির সনদপত্র জমা দেয়া। আগের পাঁচবছরের গড়ে কমপক্ষে ৪১ কোটি টাকার টার্ণওভার এবং ১ কোটি ২৫ লাখ টাকার লিকুইড অ্যাসেট সংক্রান্ত কাগজপত্রও জমা দেয়। এমনকি গোলাম কিবরিয়া শামীম ও মো. ফজলুল করিম চৌধুরী প্রতারণাও জালিয়াতির মাধ্যমে কোম্পানীর প্রকৃত নিবন্ধিত নামের সাথে একক মালিকানাধীন ফামের্র নাম সংযুক্ত করে নিবন্ধনের সনদ জমা দেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কোন চুক্তির কাগজপত্র জমা দেননি তারা। এছাড়া নিবন্ধিত প্রকৃত শেয়ার সংখ্যার চেয়ের বেশি শেয়ার দেখানো হয়। ১০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা ও টার্ণওভার সংক্রান্ত যে কাগজপত্র জমা দেয়া হয় তাও জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা হয়। এ ঘটনায় গত বছরের ২২ নভেম্বর দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার বাদি দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-১ এর সহকারী পরিচালক মো. ফখরুল ইসলাম।

মামলার এজহারের উল্লেখ করা হয়েছে, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ের দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির অযোগ্যতা ও অদক্ষতার সুযোগে ব্যবসায়ী হিসেবে অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গ করে অতি সূক্ষভাবে তথ্যগত জালিয়াতির মাধ্যমে ক্রয় প্রক্রিয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তার করে ওই কার্যাদেশ হাসিল করে নেয় তারা। এই মামলায় গত ২ ফেব্রুয়ারী সিনিয়র স্পেশাল দায়রা জজ মো. ইসমাইল হোসেন দুর্নীতি দমন কমিশনের দুদক আইনজীবির করা এক আবেদনের প্রেক্ষিতে জিকে শামীমের বিরুদ্ধে শোর্ন এ্যারেস্ট ও তার সহযোগী দি বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স এসোসিয়েটসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেন।

অপরদিকে, বিগত ৪/৫ বছর পূর্বে সিকৃবির ডিবিএম ভবন নির্মাণ কালে একটি দরপত্র আহবান করা হয়েছিল। সেসময় দি বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স এসোসিয়েটস জাল পে-অর্ডার সংযুক্ত করে দরপত্র জমা করেছিল বলে অভিযোগ উঠে। পরবর্তীতে কালোতালিকাভূক্ত করা হয়েছিল এ প্রতিষ্ঠানকে। অতীত ও বর্তমান রেকর্ড বিতর্কিত থাকার পরও পুনরায় জিকে শামীম চক্রের হাতে কাজ তুলে দিতে দরপত্র সংশ্লিষ্টরা জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। গোপনে ঘন ঘন বৈঠক করে দেনা-পাওনার হিসেবও চূড়ান্ত করছেন তারা। নানা কৌশলে বাগে আনার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন অন্যদের। প্রতিযোগী অন্য প্রতিষ্ঠানদের বিভিন্নভাবে প্রস্তাব করছেন কাজ নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে। সংশ্লিষ্টরাও অসযোগিতা দেখিয়ে কার্যাদেশ প্রদানের সময়ক্ষেপণও করছেন। এর ফাঁকে জিকে শামীম চক্রকে শক্তিশালী করছেন কাজ পাইয়ে দেয়ার।

একটি সূত্র জানায়, জিকে শামীম চক্রের সাথে আঁতাত করেছেন দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সেক্রেটারী সিকৃবির সুপারেনটেনডেন্ট প্রকৌশলী মো: কামাল হোসেন মোল্লা। মূলত তাদের পক্ষে প্রভাব বিস্তারে কলকাটি নাড়ছেন তিনিই। এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক শরফউদ্দিন বলেন, দরপত্র কমিটির সাথে আমার সংশ্লিষ্টতা নেই। তবে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান কার্যাদেশ পাওয়ার শর্ত। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি সর্তক ও যাচাই-বাচায়ে দক্ষতা দেখালে বিতর্কিত কোন প্রতিষ্ঠান কাজ নিতে পারবে না। তিনি বলেন, জিকে শামীম চক্রের তৎপরতা সর্ম্পকে আমি তেমন অবগত নই, পুরোটাই নির্ভর করছে মূল্যায়ন কমিটির উপর, তারাই দেখবেন দরপত্র জমাদানকারী প্রতিষ্ঠানের অতীত ও বর্তমান ফিরিস্তি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ৩য় দরপত্র জমাদানকারী প্রতিষ্ঠান দি বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ারিং এসোসিয়েটস অতীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ জালিয়াতি করে হাতিয়ে নিয়ে অপরাধ করলে, তার হাতে সিকৃবির কাজ তুলে দেয়া অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ হবে। কেননা এ প্রতিষ্ঠানের কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৫ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে।

দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি প্রফেসর ড. মো: আবুল কাসেম বলেন, এখন কার্যাদেশ প্রদান করা হয়নি। তবে কাজ নিতে অনেকে চেষ্টা চালাচ্ছে। যথাযথ মূল্যায়ন করেই দেয়া হবে কার্যাদেশ। তিনি বলেন, ব্যাক ডোরে কেউ কাজ নিতে পারবে না। কারণ এ কাজের জন্য আমাদেরও জবাবদিহিতা করতে হবে। তিনি বলেন, জিকে শামীমসহ তার সহযোগীদের প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আমরা খোঁজ নিবো, অবশ্যই বির্তকিত কোন প্রতিষ্ঠান বা কালোতালিকাভূক্ত কোন প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হবে না। কেউ তথ্য গোপন করে কাজও নিতে পারবে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন