রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে আগুনে পুড়ে ৭২ জন মারা যাওয়ার ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত ২ বছরেও শেষ করতে পারেনি পুলিশ। অধিক তদন্তের জন্য ১৬ বার সময় নেন তদন্ত কর্মকর্তা। ভয়াবহ এ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিচার কি আদৌ পাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহের মাঝে রয়েছেন পুরান ঢাকার বাসিন্দারা। অন্যদিকে চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয়তলার যে রাসায়নিক গোডাউন থেকে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়েছিল, তার মালিক বা কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এমনকি এদের সম্পর্কে কোনো তথ্যও নেই পুলিশের কাছে। তবে চারতলা ওয়াহেদ ম্যানশনের ক্ষতগুলো নতুন ইটবালিতে সংস্কার হয়েছে। এখন দেখে বোঝার উপায় নেই ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে দাউ দাউ করে জ্বলছিল ভবনটি। বিভিন্ন ফ্লোর থেকে ছিটকে পড়ছিল লাইটারের গ্যাস, সুগন্ধিসহ বিভিন্ন কেমিক্যালের টিউব। মুহূর্তে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল আশপাশের ভবনে। এখন পুরো চকবাজারজুড়ে আবার বসেছে ছোট ছোট কেমিক্যালের গুদাম। সরু গলিতে ঢুকছে সিএনজিচালিত পিকআপ ভ্যান। গলির মুখে খাবার দোকানগুলোতে জ্বলছে চুলাও। এমনকি ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনেই বসেছে অনিরাপদ নানা দাহ্য পদার্থের দোকান।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চকবাজার থানার পরিদর্শক কবীর হোসেন জানান, মামলাটির তদন্ত প্রায় শেষের দিকে। মামলার কিছু কাজ বাকি রয়েছে। এগুলো শেষ হলেই অল্প সময়ের মধ্যে চার্জশিট দাখিল করতে পারব। সর্বশেষ গত ১৮ জানুয়ারি মামলাটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ধার্য ছিল। কিন্তু ওই দিন তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেননি। এ জন্য ঢাকার মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ ধার্য করেন।
এদিকে মামলার বাদী আসিফ আহমেদ জানান, নির্মমভাবে ৭২ জন মানুষ পুড়ে মারা যাওয়ার দুই বছর হয়ে গেল। এখনও তদন্ত শেষ করতে পারেনি পুলিশ। এর চেয়ে দুঃখের আর কিছু আছে। আমরা এতে হতাশ। বিচার কি আদৌ হবে? ওইদিন আমি আমার বাবাকে হারিয়েছে। এ ঘটনায় আমরা অনেকে নিঃস্ব হয়ে গেছি। শুনেছি আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের জন্য সব ব্যাংক ৩০ কোটি টাকার মতো দিয়েছিল। আমরা কেউ কোনো সাহায্য পায়নি। তাহলে টাকাগুলো গেল কোথায়?
আক্ষেপ প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমরা কেউ খেয়ে, না খেয়ে আছি। কেউ খোঁজ নেয় না। এদিন আসলে অনেকে একটু খোঁজ নেয়। এরপর আবার ভুলে যায়। মামলাটির যেন দ্রুত বিচার হয় সরকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি বলে তিনি মন্তব্য করেন।
আজও ভবনটির দিকে তাকিয়ে স্বজনরা : ঠিক দুই বছর আগে এই দিনে আগুনে স্বামী হারান- পুরান ঢাকার বাসিন্দা ফাতেমা আক্তার। গত শুক্রবার ১৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় তাকে ওই ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। তিনি জানান, তার স্বামী ফয়সালের শরীরের প্রায় শতভাগই পুড়ে গিয়েছিল আগুনে। ফাতেমা অভিযোগ করে বলেন, এই যে মামলা হয়েছে, তাতে কী হয়েছে? বাড়ির মালিকরা তো ১০ দিনও জেলখানায় ছিলেন না। জামিনে বের হয়ে ঘোরাফিরা করছেন। পুড়ে যাওয়া ভবনের সংস্কারও করেছেন। সরকারও বলেছিল, আমাদের পাশে দাঁড়াবে। এখনও কেউ দাঁড়ায়নি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করছি, তিনি যেন অন্তত আমাদের পাশে দাঁড়ান।
পুড়ে যাওয়া যুবক মাহিরের বাবা নাসির উদ্দিন বলেন, এ ঘটনায় যে আইনি প্রক্রিয়া চলছে তাতে আমরা খুশি না। নিমতলীতে যখন ঘটনাটা ঘটেছিল তখন যদি সরকার কড়া ব্যবস্থা নিতো, তবে চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি ঘটতো না। এখনও যদি এ ঘটনায় সরকার ব্যবস্থা না নেয়, তবে সামনে আবারও এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটবে। আমরা চাই রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবসা সরকার আবাসিক এলাকা থেকে সরিয়ে নিক। আর কোনও বাবা যেন সন্তান না হারায়। দ্বিতীয় তলায় যে রাসায়নিকের গোডাউন থেকে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছিল সেই গোডাউনের মালিককে আজও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ, সন্তান হারিয়েছি। কিন্তু বিচার পেলাম না আক্ষেপ নাসির উদ্দিনের।
চকবাজার থানার ওসি মওদুদ হাওলাদার বলেন, এই মামলায় দু’জন গ্রেফতার হয়েছিলেন। তারা জামিনে আছেন। আমরা সব ধরনের প্রতিবেদন হাতে পেয়েছি। এজাহার নামীয় দু’জন সন্দেহভাজন আসামি আছে। যাদের নাম-ঠিকানা এখনও পাইনি, দ্রুতই পাবো।
চুড়িহাট্টার স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, পুলিশ এই ঘটনার তদন্ত করেই যাচ্ছে। কিন্তু গুরুত্ব দিয়ে ঘটনার তদন্ত কার্যক্রম হচ্ছে না। কারণ ঘটনার পর হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন ভবনের ওই ভবনের মালিক দুই সহোদর হাসান ও সোহেল দীর্ঘদিন পালিয়ে ছিল। পরে তারা দুইজন আদালতে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে জামিন নিয়েছিল। এখন তারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এছাড়া ওই ভবনের দ্বিতীয়তলায় রাসায়নিক গোডাউনের মালিক বা কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
চুড়িহাট্টার হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন বর্তমান চিত্র : গতকাল সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ঘটনার দুই বছর পর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন ভবনটি ঘটনার এক বছর পর পর্যন্ত জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল। এরপর ভবন মালিক দুই সহোদর পুনরায় ভবনটি মেরামত করে ফেলেছেন। যদিও নিয়ম অনুযায়ী এ ভবনটি মামলার জব্দ আলামত হিসেবে দেখানো হয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, তারা দুইজন কোনো প্রকার অনুমতি না নিয়ে ভবনটি সংস্থার করেছেন।
এদিকে, তার বিপরীত পাশে থাকা ক্ষতিগ্রস্ত একটি ভবন সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলা হয়েছে। পাশে নন্দ কুমার দত্ত লেনে ৬৩ নম্বর ভবনটি মেরামত করে দোকান করে দেওয়া হয়েছে এবং দ্বিতীয় তলায় একটি নতুন রেস্টুরেন্ট দেখা গেছে। হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের পাশে বাস্তায় মুখোমুখি দুটি হোটেল ছিল। সে দুটির মধ্যে রাজমহল হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট একইভাবে আছে। কিন্তু বিপরীত পাশে থাকা হোটেলটি ভেঙে দুটি দোকান করা হয়েছে। মোড়ে থাকা চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের দেদওয়ালে ক্ষতিগ্রস্ত টাইলসগুলো মেরামত করা হয়েছে। তবে বর্তমানে চুড়িহাট্টার হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন ভবনটি দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে, এখানে গত দুই বছর আগে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটেছিল।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর চকবাজার চুড়িহাট্টার মোড়ে কেমিক্যাল থেকে ছড়িয়ে পড়া আগুনে ওয়াহেদ ম্যানশনসহ আশপাশের ৫টি ভবন পুড়ে যায়। অগ্নিকান্ডে প্রাণ হারায় ৭২ জন। এর মধ্যে ৬৭ জনের লাশ ঢামেকে আসে। যার মধ্যে পুরুষ ৫৮, নারী ৫ এবং শিশু ৪ জন। আহত হয় আরও অনেকে। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট ১৪ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ভয়াবহ এ অগ্নিকান্ডের পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারিতে অবহেলার কারণে সৃষ্ট অগ্নিসংযোগের ফলে মৃত্যু ঘটনাসহ ক্ষতিসাধনের অপরাধে চকবাজারের ওয়াটার ওয়ার্কস রোডের ৩২/৩৩ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা মো. আসিফ আহমেদ চকবাজার থানায় মামলা করেন। অগ্নিকান্ডের পরে ঘটনার তদন্তে নামে অনুসন্ধানে ফায়ার সার্ভিস, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিস্ফোরক পরিদফতর, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনসহ ৫টি সংস্থার তদন্ত কমিটি। মাঠ পর্যায়ে ঘুরে ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে এবং ঘটনাস্থলের বিভিন্ন আলামত বিচার বিশ্লেষণ করে এ কমিটিগুলো তদন্ত প্রতিবেদনও তৈরি করে। তবে সবগুলো প্রতিবেদনেই আগুনের সূত্রপাত হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলায় স্প্রে (কেমিক্যাল) গোডাউন থেকে হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন