কিশোর অপরাধ যেন ঠেকানোই যাচ্ছে না। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আবারো বাড়ছে কিশোর অপরাধ। পাড়ায়-মহল্লায় গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। যে কিশোরদের নিয়ে বাবা-মা আগামীর স্বপ্ন দেখেন; সেই কিশোর বখে গিয়ে ভয়ঙ্কর অপরাধী হয়ে যাচ্ছে। চুরি-ছিনতাই-মানুষ খুন কোনো অপরাধই বাদ দিচ্ছে না তারা। নাটক-সিনেমার দৃশ্যের মতো ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটাচ্ছে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। পুলিশের তৎপরতার মধ্যেই সম্প্রতি কিছু অপরাধ ঘটাচ্ছে।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কিশোর অপরাধী প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০টি খুনের ঘটনা ঘটায় বলে জানিয়েছে পুলিশ। এছাড়াও কিশোর গ্যাং যে কত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে তা গত ১১ জানুয়ারি পুলিশের আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে। তিনি বলেছেন, পুলিশের জন্য এই কিশোর গ্যাং বা কিশোর অপরাধীরাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন। তবে দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এ ধরনের অপরাধ বাড়ছে। এক্ষেত্রে নিরুপায় হয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সালমা বেগম ইনকিলাবকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন থেকে কিশোর-কিশোরীরা ঘরবন্দি রয়েছেন। তাদের কোনো কাজ নেই। কর্মহীন হয়ে পড়ায় সহজেই তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব তাদের কাজে ফিরিয়ে নিতে হবে। তা হলে এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।
কিশোর অপরাধের সর্বশেষ ঘঠনা ঘটে গত শুক্রবার রাতে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার ভাংনামারী ইউনিয়নের লক্ষীপুর দক্ষিণপাড়া গ্রামে। সেখানে হাসান মিয়া নামের এক কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহত হাসানের বয়স মাত্র ১৬ বছর। সে ওই এলাকার রাজু মিয়ার ছেলে। স্থানীয়রা জানায়, উপজেলার লক্ষীপুর গ্রামে হাসান মিয়াকে অপরিচিত দু’জন লোক বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পর বাড়ি থেকে কিছু দূরে কে বা কারা গলা কেটে গুরুতর আহত করে ফেলে রাখে। এলাকাবাসী তাকে উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।
গৌরীপুর থানার ওসি খান আব্দুল হালিম সিদ্দিকী জানান, হত্যাকান্ডের রহস্য উদ্ঘাটন ও জড়িতদের শনাক্ত করার কাজ চলছে। কি বিরোধে হত্যাকান্ড ঘটেছে বা কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা এখনও জানা যায়নি।
এর আগে গত গত ১০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কদমতলী থানার পূর্ব জুরাইন কলেজ রোডের নবারুন গলির মাথায় মো. জাকির হোসেন নামের আরেক কিশোরকে ছুরি দিয়ে বুকে, পেটে নৃশংসভাবে আঘাত করে ও পায়ের রগ কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায় একদল দুর্বৃত্ত। এ সময় মো. মজিবুর রহমান ওরফে মোহন নামের আরেক কিশোর জাকিরকে উদ্ধার করতে গিয়েও আহত হন। পরে আহত মজিবুর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার জাকির হোসেনকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় কদমতলী থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।
এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মুগদায় একদল কিশোর-তরুণের দ্ব›েদ্বর জেরে ছুরিকাঘাতে একজন নিহত হন। নিহত মো. হাসান মিয়ার বয়স মাত্র ১৬ বছর। সে একটি ছাপাখানায় কাজ করত। হাসান মিয়া মা-বাবা আর তিন ভাই বোনের সঙ্গে থাকতো মুগদার মান্ডায়। সালাম দেয়া না দেয়া নিয়ে বাকবিতন্ডা থেকে হয় সংঘর্ষ। পরে ছুরিকাঘাতে নিহত হন তিনি। কিশোর গ্যাং কালচারে অতিষ্ঠ রাজধানীর মুগদার মান্ডাবাসী। পাড়ার অলিগলিতে আড্ডা, চুরি, ছিনতাই মাদক সেবনসহ চলে নানা অপকর্ম। হচ্ছে হামলা-পাল্টা হামলা-খুনোখুনিও। হাসানের মা বলেন, আমার ছেলেটাকে তারা ডেকে নিয়ে মেরে ফেলেছে। হাসানের বোন বলেন, যারা আমার ভাইকে ডেকে নিয়ে এভাবে মেরে ফেলছে তাদের বিচার চাই।
স্থানীয়দের অভিযোগ, দুই গ্রুপের বিরোধের কারণেই এমন ঘটনা ঘটেছে। এসব গ্রুপের বিরুদ্ধে তাদেরও আছে বিস্তর অভিযোগ। স্থানীয়রা বলছেন, ছেলেটা ভালো ছিল, খারাপ কোনো কাজে থাকতো না। প্রতিদিনই কোনো না কোনো জায়গায় এরকম ঘটনা ঘটছে। অনেকেই গুরুতর আহত হচ্ছে।
এদিকে এ ঘটনায়ও একটি মামলা দায়ের করা হয়। পরে অভিযান নামে পুলিশ। পৃথক অভিযান পুলিশ ১৪ কিশোরকে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে সাতজন অপ্রাপ্তবয়স্ক বলে জানায় পুলিশ। অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। বাকিরা হলেন- মো. শুক্কুর, মো. নুরুল ইসলাম স্বপন, মো. রতন ওরফে সোলাইমান ওরফে রেম্বো, মো. শফিকুর রহমান ওরফে দিপু, ফাহিম হাসান তানভীর ওরফে লাদেন, মো. তরিকুল ইসলাম তারেক ও মো. মাসুদ পারভেজ।
এদিকে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে আয়োজন করা হয়। এ সময় জানানো হয়, কদমতলীতে মো. জাকির হোসেন হত্যার ঘটনায় সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা একটি সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী ও অপরাধ জগতের সক্রিয় সদস্য। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ভিকটিমদের উপর হামলা চালায় তারা। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে কদমতলী থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।
এছাড়াও মুগদা এলাকায় মো. হাসান খুনের ঘটনায় সাতজনকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা মতিঝিল বিভাগের খিলগাঁও জোনাল টিম। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি। তবে সিনিয়র-জুনিয়র দ্ব›েদ্ব হাসান মিয়াকে খুন করা হয়েছে। ডিএমপির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মো. মাহবুব আলম বলেন, গড়ে প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০টি খুনের ঘটনা ঘটে। কোনো মাসে বেশি বা কোনো মাসে কম হয়। বার্ষিক গড় থেকে এই সংখ্যা বলেছি। ফেব্রæয়ারিতে কদমতলী ও মুগদায় দুটি খুনের ঘটনা ঘটে।
ডিএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার (ডিবি) শাহিদুর রহমান বলেন, এলাকায় যেসব কিশোর গ্যাং রয়েছে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তাদের পেছনে যেসব গডফাদার রয়েছে তাদেরকেও খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে। জড়িতদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
এদিকে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আপনার সন্তান কী করছে? কার সঙ্গে মিশছে, তা জানা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি সন্তানকে সময় দেয়া, তার সঙ্গে গল্প করা, তার মনের অবস্থা বোঝা, তার কাছে বাবা-মায়ের অবস্থান তুলে ধরা। আরও সহজভাবে বলতে গেলে, অভিভাবকদের সঙ্গে সন্তানের বন্ধন খুবই জরুরি। এ বন্ধন যত হালকা হবে, সন্তান তত বাইরের দিকে ছুটবে, বাইরের কলুষিত বিষবাষ্প গ্রহণ করবে। তখন আর তাকে ফেরানোর কোনও রাস্তা থাকবে না।
তবে অভিভবাকরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা ঘরের মধ্যে বন্দি রয়েছেন। কোথায় যাওয়া জায়গা নেই। তাই মাঝে মধ্যে মহল্লার গলিতে ঘুরতে বের হয় তারা। এক্ষেত্রে অভিভাবকরা সন্তানদের সঙ্গে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণেই উড়তি বয়সী কিশোররা মিলিত হয়ে বিভিন্ন সময় আড্ডা দিচ্ছেন। আর আড্ডা দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে তারা বিভিন্ন অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছেন।
গতকাল ফাতেমা বেগম নামের এক অভিভাবক ইনকিলাবকে বলেন, আমার সন্তান সপ্তম শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। কিন্তু দীর্ঘদিন থেকে স্কুল বন্ধ থানায় এখন আর পড়তে বসে না। বাসা বাইরে গিয়ে শুধু বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা দেয়।
শুধু ফাতেমা নয়, নূরুল ইসলাম নামের আরেক অভিভাবক ইনকিলাবকে বলেন, আমার ছেলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। ক্লাসে তার রোল এক নম্বর ছিল। এবার পরীক্ষা হলে বৃত্তিও পেত। কিন্তু বর্তমানে সে লেখাপড়া করে না। শুধু বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বাসা থেকে বের হয়ে চলে যায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন