বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) নিবন্ধন ছাড়াই প্রতারণার মাধ্যমে প্রতিবছর শিক্ষার্থী ভর্তি করছে রংপুরের নর্দান প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ। এতে বিপর্যায়ের মুখে পড়ছে একদল মেধাবী শিক্ষার্থীর জীবন।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিক্ষার্থী আছে কিন্তু শিক্ষক নেই, হাসপাতাল আছে চিকিৎসক ও রোগী নেই। এমনকি অপারেশন থিয়েটার, আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট), সিসিইউ (করোনারি কেয়ার ইউনিট) নেই। নামমাত্র বিভাগ থাকলেও কোন বিভাগেরই নেই বিভাগীয় প্রধান, প্রফেসর, সহকারি-সহযোগী অধ্যাপক ও রেজিস্ট্রার। এমনকি বিএমডিসি’র নিবন্ধনও নেই। তবুও স্বাভাবিকভাবেই চলছিল প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির নানা অনিয়ম নিয়ে আজ মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছে শিক্ষার্থীরা।
কলেজের ভুক্তভোগী একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, কলেজের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত ২২২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি রয়েছে। কিন্তু এরা কেউই বিএমডিসি নিবন্ধিত নয়। ফলে এদের মধ্যে যারা ইতোমধ্যে এমবিবিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে তারা কেউই ইর্ন্টান করার সুযোগ পাচ্ছে না। এমনকি যারা অন্যান্য বর্ষে অধ্যায়ন করছেন তারা প্রফেশনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। কলেজে বা হাসপাতালে কখনো মন্ত্রণালয় বা অধিদফতর থেকে পরিদর্শনে গেলে আশপাশের হাসপাতাল থেকে রোগী, চিকিৎসক ও এ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে এনে দেখানো হয়।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. এএইচএম এনায়েত হোসেন বলেন, কলেজটি দীর্ঘদিন তাদের নিবন্ধন নবায়ণ করেনি। এমনকি কলেজ পরিচালনার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের নিয়ম নীতিও তারা ঠিক মতো মানেনি। কিন্তু উচ্চ আদালতের আদেশের বলে তারা প্রতি বছর শিক্ষার্থী ভর্তি করছে। ফলে অধিদফতরের পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে কলেজের একটি ব্যাচের শিক্ষার্থী এমবিবিএস পরীক্ষায় পাশ করেছে। কিন্তু তারা বিএমডিসি’র নিবন্ধিত নয়। তাই তারাও বিপাকে পড়েছে। তবে বিশেষ বিবেচনায় এসব শিক্ষার্থীর ইর্ন্টানের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান তিনি।
নর্দান প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ও আজকের সংবাদ সম্মেলনের আহবায়ক মো. শিহাব আহমেদ বলেন, ২০০০ সালে এই মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কোন শর্ত পূরণ না করায় ২০০৪ সালে কলেজটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। তারপরও কলেজ কর্তৃপক্ষ উচ্চ আদালতের নির্দেশনা নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু করে। তবে এ পর্যন্ত বিএমডিসি’র অনুমোদন নেই নি। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তভর্‚ক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধিত থাকলেও পরবর্তীতে সেটিও তারা নবায়ণ করেনি। শিক্ষার্থীরা জানান, এই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষে যারা ভর্তি হয়েছেন তাদের কাছ থেকে মন্ত্রনালয় নির্ধারিত ফিস এর চেয়ে অনেক বেশি টাকা আদায় করা হয়। ভর্তির ক্ষেত্রে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা। মাসিক বেতন ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। এমনকি গরীব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে শিক্ষার কোটা থাকলেও তাদের কাছ থেকে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা আদায় করা হতো। শিক্ষর্থাীরা বিভিন্ন সময় বিএমডিসির নিবন্ধনের দাবি জানিয়ে আসলে এক পর্যায়ে একটি জাল সনদ দেখিয়ে তাদের শান্ত করে প্রশাসন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালের অবকাঠামো ছাড়া আর কিছুই না থাকায় ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে রংপুর এর সিভিল সার্জন হাসপাতাল কর্যক্রম বন্ধ করে দেন। মেডিকেল কলেজ সংযুক্ত হাসপাতাল হলেও সেখানে নেই কোন জরুরী বিভাগ। এমনকি মেডিসিন, সার্জারি বা অন্য কোন বিভাগও নেই। সেখানে নেই কোন প্যাথলজিক্যাল ল্যাব, টেকনোলজিস্ট, টেকনিশিয়ান। নেই কোন অপারেশন থিয়েটার। কলেজে একজন প্রিন্সিপাল থাকলেও নেই কোন চিকিৎসক। কলেজের মেডিসিন বিভাগের কোন শিক্ষক নেই, সার্জারি বিভাগে সবেধন নীলমনি একজন সহকারি অধ্যাপক। ফরেনসিক ও কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগে দু’জন অধ্যাপক থাকলেও বয়সের ভারে তারা নূজ্য। অন্যান্য বিভাগ বলে কিছু নেই। কলেজে আগে পরীক্ষার কেন্দ্র থাকলেও সেটিও বাতিল হয়ে গেছে। ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য নেই কোন হোস্টেল। এমনকি হাসপাতালের নিজস্ব কোন এ্যাম্বুলেন্সও নেই।
নর্দান প্রাইভেট মেডকেল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান রোকেয়া লাভলি বলেন, আমাদের কাগজপত্রে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু অধিদফতর বা মন্ত্রণালয় নিবন্ধন না দিলে আমরা কি করবো।
বিএমডিসি’র সদস্য প্রফেসর ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, এ ধরনের মেডিকেল কলেজগুলো মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিবন্ধন নেয়। কিন্তু বিএমডিসি’র নিবন্ধন নিতে পারে না। কারণ সব নিয়ম নীতি না মানায় তাদের নিবন্ধন দেয়া হয় না। তিনি বলেন, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একটি পূর্ণাঙ্গ টিম করে (বিএমডিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ে) পরিদর্শন করতে হবে। নিয়ম না মানলে প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন