বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

দেশী গরুতেই কোরবানি

প্রকাশের সময় : ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৪৮ পিএম, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

ভারত থেকে গরু না এলেও সঙ্কটের আশঙ্কা নেই : রাজধানীর অস্থায়ী হাট বসলেই বানের পানির মতো গরু আসা শুরু করবে : হাসিল কমছে গাবতলীর হাটে
নূরুল ইসলাম : কোরবানির পশু আসতে শুরু করেছে রাজধানীতে। ঈদকে সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পশুবাহী ট্রাক ঢুকছে রাজধানীতে। এসব ট্রাক যাচ্ছে সর্ববৃহৎ পশুর হাট গাবতলীতে। এর মধ্যে কুষ্টিয়া, পাবনা ও রাজশাহীসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়িরা গরু, মহিষ ও ছাগল হাটে এনে মজুদ করতে শুরু করেছে। গাবতলী ছাড়াও এবার রাজধানীতে আরও ২২টি অস্থায়ী হাট বসবে। এসব হাটের ইজারাদাররা ইতোমধ্যে কোরবানির পশু সংগ্রহের জন্য দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরছেন। তাদের কয়েকজন জানান, কোরবানির জন্য প্রস্তুত যে পরিমাণ পশু তারা দেখেছেন তাতে এবার ভারত থেকে পশু না এলেও কোনো সংকট সৃষ্টি হবে না। বরং ব্যবসায়িরা লাভবান হবে। ইজারাদাররা জানান, দেশের ফরিদপুর, মাদারিপুর, শরিয়তপুর, পাবনা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, যশোর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী জেলার বিভিন্ন উপজেলায় হাজার হাজার খামারে কোরবানির পশু প্রস্তুত রয়েছে। যার মধ্যে গরুর সংখ্যাই বেশি। রাজধানীর অস্থায়ী হাটগুলো শুরু হলেই এগুলো বানের পানির মতো আসা শুরু করবে। এদিকে ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে গাবতলী পশুর হাট জমতে শুরু করেছে। ঢাকা বাইরে থেকে এই প্রধান হাটে বিভিন্ন ধরণের পশু আসা শুরু করেছে। গাবতলী পশুর হাটে সিটি কর্পোরেশন নির্ধারিত হাসিলের চেয়ে এবার কম হাসিল নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইজারাদার কর্তৃপক্ষ। শুধুমাত্র বেপারী এবং গোশত সরবরাহকারীদের এই সুযোগ দেয়া হচ্ছে বলে জানান ইজারাদার লুৎফর রহমান। উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বিষয়টিকে মহৎ উদ্যোগ হিসাবে দেখছেন।
সিটি কর্পোরেশন সূত্র জানায়, সরকারি হিসাবে এ বছর রাজধানীতে সম্ভাব্য পশু কোরবানির সংখ্যা ৩ লাখ ৬১ হাজার ৪১০টি নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৪১ হাজার ৪১০টি। বাড়তি পশুর চাহিদা পূরণের জন্য এবার রাজধানীতে স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলে ২৩টি কোরবানির পশুর হাট বসছে। এর মধ্যে দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় অস্থায়ী হাটের সংখ্যা ২২টি। ১৪টি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও ৯টি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায়। দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকার অস্থায়ী হাটগুলো কোরবানির ঈদের তিন দিন আগ বসবে। অস্থায়ী হাটগুলোর ইজারা প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। ইজারাদাররা কোরবানির পশু সংগ্রহের জন্য ছুটে বেড়াচ্ছেন দেশের বিভিন্ন জেলার আনাচে-কানাচে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর দনিয়া-শনিআখড়া হাটের ইজারাদার আবুল কালাম গতকাল ইনকিলাবকে জানান, কোরবানির পশু সংগ্রহের জন্য তিনি গত কয়েক দিনে ফরিদুপর, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, পাবনা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জসহ কয়েকটি জেলার আনাচে-কানাচে গেছেন। শত শত পশু খামারে তিনি যে পরিমাণ কোরবানির পশু দেখেছেন তাতে এবার বিপুল পরিমাণ পশু কোরবানির হাটে উঠবে বলে তিনি আশাবাদী। ইজারাদার আবুল কালাম বলেন, আমি বেপারীদের সাথে কথা বলে যা বুঝেছি তাতে মনে করি ভারত থেকে এবার পশু না এলেও কোনো সংকট সৃষ্টি হবে না। বরং আমাদের দেশীয় ব্যবসায়িরা লাভবান হবে। যশোরের গরু ব্যবসায়ি আব্দুর রব জানান, গত দেড় বছর ধরে ভারতীয় গরু আসা বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে যশোরে অসংখ্য খামার গড়ে উঠেছে। সেখানে হাজার হাজার গরু কোনবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। যশোর জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবার ওই জেলায় কোরবানির পশুর চাহিদা প্রায় ২৫ হাজার পশু। অথচ যশোরের প্রায় ১১ হাজার পশু খামারে এবার কোরবানির জন্য প্রস্তু করা হয়েছে ৭০ হাজার পশু। যশোর সদর উপজেলার ঝুমঝুমপুর, নরেন্দ্রপুরসহ ৮টি উপজেলায় এসব খামার অবস্থিত। খামারগুলোতে অনেকটা প্রাকৃতিক নিয়মেই পশু মোটা-তাজাকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হচ্ছে। খামারগুলোতে কোনো প্রকার ক্ষতিকারক ওধুষ যাতে ব্যবহার করা না হয় সে দিকে সার্বক্ষণিক নজরদারি করেছে জেলা পশু সম্পদ অধিদপ্তর।
ফরিদপুরের বেপারী ইদ্রিস হোসেন গতকাল ইনকিলাবকে জানান, ফরিদপুরের খামারগুলোতে হাজার হাজার দেশী গরু কোরবানির হাটে উঠানোর অপেক্ষায় রয়েছে। দু’একদিনের মধ্যে খামারগুলো থেকে গরু ট্রাকে করে ঢাকার পথে রওনা করবে। ইতোমধ্যে বেশি কয়েক ট্রাক গরু ঢাকার গাবতলী হাটে গিয়ে পৌঁছেছে। বেপারীরা পশুগুলো আগাম এনে গাবতলী হাটে মজুদ করছে। কুষ্টিয়ার খামারি আব্দুল লতিফ জানান, কুষ্টিয়া জেলায় এবার সাড়ে ৫শ’ খামারে ৭০ হাজারেরও বেশি গরু কোরবানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে। তিনি জানান, বছরখানেক ধরে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন প্রজাতির গরু পরিচর্যার মাধ্যমে প্রতিটিই এখন যথেষ্ট মোটা-তাজা। এগুলোতে কোনো প্রকার ক্ষতিকারক ওধুষ প্রয়োগ করা হয়নি। কুষ্টিয়া অঞ্চলের আরেক বেপারী তৈয়ব আলী জানান, কুষ্টিয়ায় সবচেয়ে বেশি গরু পালন হয় সদর উপজেলায়। এ উপজেলার গ্রামাঞ্চলের বেশিরভাগ বাড়িতেই কোরবানির গরু পালন করা হয়। এছাড়া কুমারখালী, মিরপুর, ভেড়ামারা, দৌলতপুর ও খোকসা উপজেলায় গরু পালন করা হয়। জেলার সর্ববৃহৎ গরুর হাট সদর উপজেলার বালিয়াপাড়া। কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়কের পাশেই এ হাটটি সপ্তাহের শনিবার বসে। ওই দিন ভোর থেকেই সেখানে ক্রেতা-বিক্রেতাদের উপস্থিতি জমজমাট হয়ে ওঠে। আশপাশের বিভিন্ন জেলা থেকেও ওই হাটে পশু আসে। আবার সেখান থেকে চলে যায় ঢাকায়। বেপারী তৈয়ব আলী বলেন, এবারের ঈদে এই একটি হাট থেকে ৮-১০ হাজার গরু ঢাকায় যাবে। কুষ্টিয়া জেলা প্রাণীসম্পদ অফিস সূত্রে জানা গেছে, এবার এ জেলায় প্রায় ৭১ হাজার গরু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করেছে খামারিরা।
রাজধানীর গাবতলী পশুর হাট ঘুরে দেখা গেছে, কোরবানির জন্য গরু ছাড়াও মহিষ, ছাগল ও উটও এসেছে হাটে। হাটের ভেতরে উঁচু করে শামিয়ানা টানিয়ে কোরবানির গরু মজুদের প্রস্তুতি নিচ্ছেন অনেকে। স্থায়ী শেডে উঠেছে উট। দেড় বছর আগে সউদী আরব থেকে উট এনে দেশে লালন-পালন করে হাটে উট উঠিয়েছে টিপু এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি উট ৮ থেকে ১২ লাখ টাকা দাম হাঁকা হচ্ছে। অন্যদিকে কোরবানি উপলক্ষে রাজশাহী, যশোর ও দক্ষিণের জেলাগুলো থেকে হূষ্টপুষ্ট অনেক মহিষ আনা হয়েছে। মহিষের বেপারী খোকন মিয়া জানান, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অনেক মানুষ মহিষ কোরবানি দিতে পছন্দ করে। সেখানকার বেপারীরা গাবতলী থেকে কিনে কোরবানির আগে বিক্রি করবেন। প্রতিটি মহিষের মূল্য পড়বে ৭০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকা।
হাসিল কমছে গাবতলীর হাটে
এদিকে, গাবতলী গবাদি পশুর হাটে সিটি কর্পোরেশন নির্ধারিত হাসিলের চেয়ে এবার কম হাসিল নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইজারাদার কর্তৃপক্ষ। শুধুমাত্র বেপারী এবং মাংশ সরবরাহকারীদের এই সুযোগ দেয়া হচ্ছে বলে জানান ইজারাদার লূৎফর রহমান। গাবতলী বাসটার্মিনাল সংলগ্ন এই পশুর হাটটি ঘিরে প্রতিবছর নানা উত্তেজনা থাকে। বছরজুড়ে হাজার হাজার গরুর কেনা-বেচা চলে এই হাটে। রাজধানীসহ আশপাশের জেলাগুলোতে গোশতের চাহিদা মেটায় এই হাটের গরু দিয়ে। তবে কোরবানি ঈদে স্থায়ী এই হাট ঘিরে এক আলাদা পরিবেশ গড়ে উঠে। ব্যবসায়ি ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ নজর থাকে। এরই মধ্যে হাট ঘিরে শতাধিক সিসি ক্যামেরা বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে ৪/৫ দিন কেনাবেচা বেশী হয় বলে ইজারাদার প্রায় দেড় হাজার অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ দিয়ে থাকেন।
হাটের ইজারাদার লুৎফর রহমান জানান, এবারের ইজারার শর্ত অনুযায়ী (ঈদুল আযহার চারদিন ছাড়া) প্রতিটি পশুর মূল্যের উপর শতকরা সাড়ে তিনটাকা হাসিল নেয়ার বিধান রয়েছে। আর ঈদের চারদিন শতকরা ৫ টাকা হারে। আর সারা বছর গোশত ব্যবসায়িদের জন্য ছাগল-ভেড়া প্রতিটি ১৫ টাকা, গরু প্রতিটি ৫০ টাকা এবং মহিষ প্রতিটি ৭০ টাকা হাসিল নেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। কম লাভে বেশী বিক্রির কৌশল হিসাবে এবার তিনি শুধুমাত্র বেপারী এবং গোশত সরবরাহকারীদের জন্য সাড়ে তিন টাকার পরিবর্তে শতকরা একটাকা হাসিল নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটা সারা বছর চলবে। তবে ঈদের চারদিন এর আওতায় পড়বে না। বড় বড় বেপারীরা বা সরবরাহকারীরা কম হাসিল দিয়ে এখান থেকে গরু নিয়ে দেশের বিভিন্নস্থানে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি। এবার ভারত থেকে গরু না আসায় কোনো সমস্যা হবে না জানিয়ে গাবতলী হাটের ইজারাদার লুৎফর রহমান বলেন, আমাদের দেশে এখন হাজার হাজার খামারে লাখ লাখ গরু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। আমার মনে হয় দেশি গরুতেই এবার চাহিদা মিটবে। তবে দামটা একটু বেশি হতে পারে। তাতে আমাদের দেশী ব্যবসায়িরা লাভবান হবে।
কোরবানির হাটের মোটা-তাজাকরণ প্রক্রিয়ার গরু সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওধুষ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক ড. এ কে লুৎফুল কবির বলেন, ভিটামিন দিয়ে গরু মোটা-তাজাকরণ করলে সেটা ক্ষতিকারক নয়। কিন্তু স্টেরয়েড জাতীয় হরমোন দিয়ে গরু মোটাতাজা করলে সেই গরুর গোশত মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক। বিশেষ করে যে মা তার শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান সেই মা ওই সব গরুর গোশত খেলে তা দুধের মাধ্যমে কোনো মেয়ে শিশুর শরীরে প্রবেশ করবে। পরবর্তীতে সেই শিশু বড় হওয়ার পর গর্ভধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের এই শিক্ষক বলেন, সাধারণত ভারতীয় গরুগুলোকে মোটাতাজা করতে স্টেরয়েড জাতীয় হরমোন খাওয়ানো হয় বেশি। এবার ভারতীয় গরু না আসায় সেই ঝুঁকি থেকে আমরা অনেকটা নিরাপদ কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিরাপদ তো বটেই। তবে আমাদের দেশেও হরমোনের ব্যবহার হয়। দেশের বিভিন্ন জেলার খামারগুলোতে প্রাণিসম্পদ বিভাগের তত্ত্বাবধানে সার্বক্ষণিক নজরদারির মাধ্যমে প্রাকৃতিক নিয়মে গরু মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে- এ কথা শুনে তিনি বলেন, এরকম হয়ে থাকলে আমাদের সবার জন্যই ভালো।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
তানবীর ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১১:৪৪ এএম says : 0
গরু ব্যবসায়িদের কাছে অনুরোধ, দয়া করে স্টেরয়েড জাতীয় হরমোন দিয়ে গরু মোটাতাজা করবেন না।
Total Reply(0)
সজিব ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ৩:৪৩ পিএম says : 0
সীমান্তে নজরদারিতা বাড়াতে হবে যাতে একটি ভারতীয় গরু দেশে ঢুকতে না পারে।
Total Reply(0)
Rubel ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ৩:৫০ পিএম says : 0
Indian goru na asle e amader khamarira lavoban hobe
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন