স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পর শুল্কমুক্ত বাণিজ্যসুবিধা প্রত্যাহার করা হলে বাংলাদেশের রফতানি আয় ৮ থেকে ১০ শতাংশ কমতে পারে। এতে বছরে প্রায় ২৫০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রফতানি আয় কমবে। বর্তমান বাজার দরে টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি। গতকাল বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের সঙ্গে অনলাইনে আলাপচারিতায় এসব তথ্য দেন। তিনি জানান, এলডিসি থেকে উত্তরণের পরপর ক্রমান্বয়ে বাণিজ্যসুবিধাগুলো হারাবে বাংলাদেশ। যেমন, ইউরোপীয় ইউনিয়নে উত্তরণের পরও বাড়তি তিন বছর শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা থাকবে। গত শুক্রবার রাতে জাতিসংঘের কমিটি ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) এলডিসি থেকে উত্তরণের সুপারিশ করেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হয়ে যাবে। সিডিপির সদস্য হলেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এর আগে গত শনিবার এই খুশির খবর এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিকে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ স্বীকৃতি পেলেও উন্নয়নশীল দেশের মর্যদা পেতে বাংলাদেশকে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় এলডিসি থেকে মসৃণ উত্তরণের পথে বাংলাদেশের কী করা উচিত, তা নিয়ে কথা বলেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, এ দেশে আলোচনাগুলো বেখাপ্পা মনে হয়। বিদেশ থেকে কীভাবে বেশি সাহায্য-সহায়তা পাব, এ নিয়েই বেশি আলোচনা হয়। কিন্তু কোন কোন সমস্যার কারণে এই সাহায্য নিতে হচ্ছে, তা নিয়ে আলোচনা বেশি হয় না। সমস্যাগুলোর সমাধানে বেশি মনোযোগী হই না।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও যদি বিশেষ সুবিধা পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে যাই, তাহলে ভুল হবে। বিশেষ সুবিধাকে বাড়তি পাওনা হিসেবে দেখতে হবে। তবে দেশের অভ্যন্তরে সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে বেশি মনোযোগী হতে হবে। এ জন্য দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য তিনটি বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এগুলো হলো, ব্যক্তি বিনিয়োগ বাড়াতে পরিবেশ সৃষ্টি করা, কর আহরণ বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি। এ ছাড়া এলডিসি থেকে মসৃণ উত্তরণের জন্য একটি উত্তরণকালীন কৌশলপত্র তৈরির সুপারিশও করেছেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, এলডিসি থেকে বের হলে রফতানি খাতের নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়টিই বেশি আলোচনায় আসে। অন্য প্রভাবের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনায় এক ধরনের অনীহা আছে। তাঁর মতে, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর মেধাসত্ত¡সংক্রান্ত শর্ত আরো কড়াকড়ি হবে। কৃষি খাতে ভর্তুকি আরো স্বচ্ছ ও সীমিত হতে হবে। নতুন শিল্পকে প্রণোদনা দেয়ার শর্ত কঠিন হবে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আন্তর্জাতিক স¤প্রদায় জানতে চায়, উত্তরণপ্রক্রিয়ায় বাংলাদেশসহ এলডিসিগুলোয় অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন হচ্ছে কি না, উন্নয়ন কতটা টেকসই হচ্ছে, বৈষম্য হ্রাস পাচ্ছে কি না। অবশ্য বাংলাদেশে বৈষম্য বাড়ছে। এ ছাড়া সুশাসনের বিষয়েও আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের নজর আছে। তারা নিশ্চিত হতে চায়, তাদের পক্ষ থেকে এলডিসিগুলোকে যে সুবিধা দেয়া হয়, তা পিছিয়ে পড়া মানুষের কাছে কাজে লাগছে কি না।
সিডিপির অন্যতম সদস্য ড. দেবপ্রিয় বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর প্রস্তুতি পর্বে একটি ‘উত্তরণকালীন কৌশলপত্র’ প্রণয়নের তাগিদ দেন। একই সঙ্গে তিনি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণে বেশি গুরুত্ব দিতে বলেন। উত্তরণের পর প্রস্তুতি পর্বে বাংলাদেশের করণীয় কী, তা জানাতে সাংবাদিকদের সঙ্গে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন ড. দেবপ্রিয়। এ সময় এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর আগামীতে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন তিনি। দেবপ্রিয় বলেন, এখন নিজেদের অবস্থান পরিবর্তনের দিকে সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের বিশেষ সুবিধার আসক্তি থেকে বের হতে হবে। মূল জায়গাটা হতে হবে দেশের পরিবর্তন।
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, বিশ্বের কাছ থেকে বেশি সুবিধা আনতে হবে, এমন মানসিকতার পরিবর্তন করে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ভিত্তি আরো শক্তিশালী করতে হবে। দাঁড়াতে হবে নিজেদের পায়ে। এ জন্য বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে। জোর দিতে হবে কর আহরণে। মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, জাতিসংঘ বলেছে, উত্তরণ পরবর্তী বাংলাদেশের সামনে সম্ভাবনা আছে। এ জন্য পাঁচটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে বলেছে তারা। এগুলো হলো অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ বাড়ানো, নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, রফতানিযোগ্য পণ্যের সংখ্যা বাড়ানো, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পূর্ণ বাস্তবায়ন ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন থেকে বের হয়ে আসা। তিনি বলেন, এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী যে কৌশলপত্র তৈরি করা হবে তাতে উল্লিখিত বিষয় যুক্ত করতে হবে।
এলডিসি থেকে উত্তরণের পর ভুটান এরই মধ্যে কৌশল তৈরি করেছে জানিয়ে খ্যাতনামা এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বাংলাদেশের তো কৌশলপত্রের অভাব নেই। এসবের মধ্যেও এলডিসি উত্তরণকালীন কৌশল কীভাবে তৈরি করা যায়, তা এখন থেকে ভাবতে হবে। এই কৌশলপত্র তৈরিতে ২০১৬ সালে গঠন করা জাতীয় টাস্কফোর্সকে দায়িত্ব দেয়ার প্রস্তাব করে তিনি জানান, টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করতে হবে। এতে বাণিজ্য, ইআরডি, পরিকল্পনা কমিশন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করে পরস্পরের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন