শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

যমুনা নদীর মরণদশা

পাঁচ হাজার মিটার প্রস্থ এখন ৭শ’ মিটার বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদন

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১০ মার্চ, ২০২১, ১২:০০ এএম

নমুনা নদীর ওপর এ যেন ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’। গতকাল বাংলাদেশ-ভারতকে যুক্ত করতে খাগড়াছড়ির রামগড়ে ফেনী নদীর ওপর নির্মিত ‘মৈত্রী সেতু’ উদ্বোধন করা হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই সেতুকে দুই দেশের মধ্যে নতুন ‘বাণিজ্য করিডোর’ হিসেবে অবিহিত করেছেন। কিন্তু গঙ্গা চুক্তি অনুযায়ী পানি না দেয়া এবং তিস্তা চুক্তি ঝুলিয়ে রাখায় দেশের নদীগুলো মরণদশায় পড়েছে। চৈত্র আর আগেই ফালগুন মাসেই দেশের সব নদী শুকিয়ে গেছে। দেশের বড় বড় নদীগুলো বালুময় চরে হাটলে মনে হয় মরুভুমি দিয়ে হাটছি। বন্ধুপ্রতীম ভারত আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে তিস্তা ও পদ্ধার পানি অন্যত্র সরিয়ে নেয়ায় দেশের নদীগুলোতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ মধ্যেই যমুনা গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের আগে ভুল পরিকল্পনা, ডিজাইন ও নকশা প্রণয়ন। সেতুর নকশা ও নির্মাণের আগে নদী শাসনের ভুল পরিকল্পনায় মরতে বসেছে যমুনা নদী। মেয়েদের চুলের বিনুনি বেল্টের (ব্রেইড বেল্ট) মতো প্রবাহিত যমুনার এখন ভয়াবহ দশা। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। ৫ হাজার মিটার প্রস্থ যমুনা নদী শুকিয়ে প্রস্থ এখন মাত্র ৭শ’ মিটার। তিস্তার উজানে গজলডোবায় পানি সরিয়ে নেয়া এবং বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে সংশ্লিষ্টদের ভুলে যমুনা নদীর প্রবাহ ৭ ভাগের এক ভাগে ঠেকেছে।
যমুনার ভাঙন রোধে গঠিত মনিটরিং সেলে পাঁচ বছর কাজ করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক। জানতে চাইলে বলেন, যমুনা নদী অতিরিক্ত মাত্রায় শাসনের ফলে কিছু বিরূপ প্রভাব দেখা যাবেÑতা আগেই ধারণা করা হয়। এজন্য সেতুটি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান হুন্দাইয়ের পরামর্শে একটি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু তারা ঠিকমতো কাজ করেনি। এছাড়া বুয়েটের বেশকিছু পরামর্শ সঠিকভাবে মানা হয়নি। তিনি আরো বলেন, প্রকৃতিগতভাবে নদীর ধর্ম হলো সে শাসন মানতে চায় না। এজন্য নদী শাসন করা কঠিন। আর যমুনা নদী মাত্রাতিরিক্ত শাসন করা হয়েছে। এর কুপ্রভাব সেতুটি উদ্বোধনের পর থেকেই দেখা যাচ্ছে। বাঁধ নির্মাণ, ড্রেজিং কিছুতেই যমুনার ভাঙন বন্ধ করা যাচ্ছে না। নদীর মাঝে বিশাল আকারের চর পড়ছে। এছাড়া নদী কিছুটা উত্তর দিকে বাঙ্গালী নদীর দিকে সরে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বর্ষা মৌসুমে বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের স্থানে যমুনা নদীর প্রস্থ দাঁড়ায় প্রায় ১২ কিলোমিটার। তবে শুষ্ক মৌসুমে কমে হয় ৭ কিলোমিটার। এজন্য বঙ্গবন্ধু সেতুটি কমপক্ষে ৭ কিলোমিটার নির্মাণের পরামর্শ দেয়া হয়। ওই সময় সেতুর অবস্থান কিছুটা ভাটিতে সরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব করা হয় নদী শাসনকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। কিন্তু ব্যয় বেড়ে যাওয়ার যুক্তিতে কোনোটিই মানা হয়নি। বরং দুই প্রান্তে গাইড বাঁধ দিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতুর দৈর্ঘ্য মাত্র ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারে নামিয়ে আনা হয়। এতে সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ৩ হাজার ৭৪৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। তবে গত দুই দশকে নদীর দুই তীর ও সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্ট রক্ষায় এর কয়েকগুণ বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে।
জানা যায়, ২০১০ সালে পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নের সময় নদী শাসনের পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য যমুনার অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন করা হয়। নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত সে মূল্যায়ন কার্যক্রমে যমুনা নদী শাসনের বিভিন্ন দিক উঠে আসে। ‘পারফরম্যান্স রিভিউ অব যমুনা ব্রিজ রিভার ট্রেনিং ওয়ার্কস ১৯৯৭-২০০৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, যমুনার দুই তীরে নির্মিত গাইড বাঁধ সেতুটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৫ কিলোমিটার কমিয়ে দিয়েছে। এটা অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী হলেও এখন এর কুফল দেখা যাচ্ছে। এছাড়া গাইড বাঁধের গভীরতাও কম। এতে সেতুর অবস্থান ও সংযোগ সড়ক রক্ষা হলেও তীর ভাঙন রোধ করা যাচ্ছে না। এতে আরো বলা হয়, যমুনা নদীর গঠন মূলত মেয়েদের চুলের বিনুনি বেল্টের মতো। যে স্থানে গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, তা মূলত কর্দমাক্ত। এটা মাটির ক্ষয় বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে নদীভাঙন রোধে গাইড বাঁধ উভয় দিকে আরো ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার বাড়ানো উচিত ছিল।
সূত্রমতে প্রায় দুই যুগ আগে নির্মাণকালীন ব্যয় সাশ্রয় করতে মূলত যমুনা নদীর দুই তীরে সেতু নির্মাণ স্থানে গাইড বাঁধ দিয়ে প্রস্থ কমিয়ে আনা হয়। যমুনা নদীর গঠন প্রকৃতির কারণে তা কার্যকর হবে না বলে সে সময় অনেকেই মত দেন। তবে তা না মেনে সেতু নির্মাণের ফলে মূল সেতু ও সিরাজগঞ্জের হার্ড পয়েন্ট রক্ষায় ২০ বছরের বেশি সময় ধরেই বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু সেতু সংলগ্ন এলাকায় যমুনা নদীর প্রস্থ প্রায় পাঁচ কিলোমিটার (৫ হাজার মিটার)। এখন চর পড়ে নদীটি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এতে সেতু সংলগ্ন এলাকায় যমুনা নদীর মূল চ্যানেলের প্রস্থ কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭০০ মিটার। এছাড়া নদীটির মূল চ্যানেল ক্রমেই বাম তীরের দিকে সরে যাচ্ছে। এতে যমুনা নদীর গভীরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বঙ্গবন্ধু সেতু সংলগ্ন এলাকায় প্রতি বছর ভাঙছে; যা বর্ষায় তীব্র আকার ধারণ করে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) টাঙ্গাইলের সাইট অফিস থেকে ঢাকায় প্রধান প্রকৌশলী বরাবর পাঠানো এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী বর্ষায় ভাঙন আরো বড় আকার ধারণ করতে পারে। তাই ভাঙন প্রতিরোধে বড় ধরনের ড্রেজিংয়ের সুপারিশ করা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পার্শ্বে বাম তীর রক্ষার্থে ২ কিলোমিটার ভাটি পর্যন্ত প্রতিরক্ষামূলক কাজ করা হয়। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর এ কাজের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। তবে ২০২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ওই কাজের ২০০ মিটার থেকে চেইনেজ ২৫০ মিটার পর্যন্ত এলাকা বড় ধরনের ভাঙনের সম্মুখীন হয়। নদীর গভীরতা স্বাভাবিকের তুলনায় অত্যধিক বৃদ্ধির ফলে এরূপ ভাঙন ঘটেছে। এক্ষেত্রে গত বর্ষা মৌসুমে প্রতিরক্ষামূলক কাজ সংলগ্ন এলাকার নদীর গভীরতা স্বাভাবিকের চেয়ে ৩৪ মিটার বেড়ে গেলে আকস্মীক ভাঙন দেখা দেয়। যদিও প্রতিরক্ষামূলক কাজটি ২৫ মিটার গভীরতা ধরে ডিজাইন করা হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভাঙনপ্রবণ এলাকায় কাজটির ডিজাইন পুনরায় করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরো উঠে আসে যে, নমুনা নদীর তীর বরাবর যে এলাকায় বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ প্রতিরক্ষামূলক কাজ করছে, ওই স্থানের সন্নিকটে প্রতিনিয়ত নদীর গভীরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ১৯ জানুয়ারি নাইন ক্রস লাইন সার্ভে ও ২৮ জানুয়ারি পরিচালিত হাইড্রো সার্ভে প্রতিবেদনে দেখা যায়, সম্পাদিত কাজের সন্নিকটে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩৬ মিটার গভীরতা পাওয়া গেছে। নদীর মূল চ্যানেল ক্রমান্বয়ে সম্পাদিত কাজের বাম তীরে সরে বিরাট আকারের চর জেগে ওঠার দরুন চ্যানেলটি আরো সরু হয়ে গেছে। আর বাম তীর বরাবর সম্পাদিত কাজের ওপর দিয়ে নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে আগামী বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে প্রতিরক্ষামূলক কাজের এলাকার গভীরতা বৃদ্ধি পেয়ে ব্যাপক আকারে ভাঙন দেখা দিতে পারে।
এদিকে সেতু সংলগ্ন এলাকার প্রায় ৫ কিলোমিটার প্রস্থের যমুনা নদী প্রায় ৭০০ মিটার প্রস্থের চ্যানেল দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। চ্যানেলটি সরিয়ে নদীর মাঝ বরাবর প্রবাহিত করানোর জন্য ডিজাইনার ৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে ড্রেজিংয়ের বিষয়ে প্রস্তাবনা দিয়েছে। এতে ৭৮ লাখ ঘনমিটার চর এলাকা ড্রেজিং করতে হবে। এজন্য ব্যয় হবে ১২২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদাউস বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতুর সাইট অফিস থেকে যমুনা নদীর সর্বশেষ চিত্র সংবলিত একটি প্রতিবেদনে পাঠানো হয়েছে। এটি পর্যালোচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন