‘মিরাজ’ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ সিঁড়ি। অন্য অর্থে ঊর্ধ্বলোকে আরোহন বা মহামিলন। নবী করিম (সা.)-এর ৫০ বছর বয়সে মক্কি জীবনের প্রায় শেষলগ্নে নবুওয়াতের দশম বছরে ৬২০ খ্রিষ্টাব্দের রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে মিরাজের মহিমান্বিত ও বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে।
এ রাত মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র রাত। এ রাতে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) স্বর্গীয় বাহন বোরাকে চেপে ঊর্ধ্বাকাশে গমন করেন। দৈনিক পাঁচওয়াক্ত নামাজ ফরজের বিধানও করা হয় এ মহিমান্বিত রাতে।
ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে রাতটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। শবে মেরাজের রাতে যা ঘটেছিল তা মুসলমানদের বিশ্বাস করা ইমানি দায়িত্ব। এ রাতেই সপ্তম আসমান পেরিয়ে আরশে আজিমে পৌঁছে আল্লাহ তা’য়ালার সঙ্গে সরাসরি কথোপকথন শেষে পৃথিবীতে ফিরে আসেন হজরত মোহাম্মদ (সা.)।
প্রথমে মদিনা মুনাওয়ারা, তারপর সিনাই পর্বত, তারপর হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্মস্থান ‘বায়তে লাহম’ হয়ে চোখের পলকে জেরুজালেমের মসজিদুল আকসা তথা বায়তুল মুকাদ্দাসে গিয়ে পৌঁছান। মহানবী (সা.) সেখানে আম্বিয়ায়ে কিরামের সঙ্গে দুই রাকাত নামাজের জামাতে ইমামতি করেন।
তিনি হলেন ‘ইমামুল মুরসালিন’ অর্থাৎ সব নবী-রাসুলের ইমাম। নামাজের পর জিব্রাইল (আ.) উপস্থিত সবার সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আনুষ্ঠানিক পরিচয় করিয়ে দেন। নৈশভ্রমণের প্রথমাংশ এখানেই সমাপ্ত হয়।
পবিত্র কোরআনের ভাষায় মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা বা বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত পরিভ্রমণকে ‘ইস্রা’ নামে অভিহিত করা হয়েছে।
তারপর নবী করিম (সা.) বোরাকে আরোহন করলে তা দ্রুতগতিতে মিরাজ বা ঊর্ধ্বলোকে যাত্রা শুরু করে।
বিশ্বস্রষ্টার নভোমণ্ডলের অপরূপ দৃশ্য দেখে তিনি বিমোহিত হন। প্রতিটি আসমানে বিশিষ্ট নবীদের সঙ্গে তাঁর সালাম ও কুশলাদি বিনিময় হয়। প্রথম আকাশে হজরত আদম (আ.), দ্বিতীয় আকাশে হজরত ঈসা (আ.) ও হজরত ইয়াহ্ইয়া (আ.), তৃতীয় আকাশে হজরত ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আকাশে হজরত ইদ্রিস (আ.), পঞ্চম আকাশে হজরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আকাশে হজরত মুসা (আ.) এবং সপ্তম আকাশে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে মহানবী (সা.)-এর সাক্ষাৎ হলে পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
সপ্তম আসমানে অবস্থিত ফেরেশতাদের আসমানি কাবাগৃহ বায়তুল মামুরে তিনি অসংখ্য ফেরেশতাকে তাওয়াফরত অবস্থায় এবং অনেককে সালাত আদায় করতে দেখেন। এরপর তিনি জিব্রাইল (আ.)-এর সঙ্গে বেহেশত-দোজখ পরিদর্শন করেন। এছাড়া আলমে বারজাখের অসংখ্য দৃশ্যাবলী স্বচক্ষে অবলোকন করে পুনরায় সিদরাতুল মুনতাহায় ফিরে আসেন।
এভাবে সপ্তম আসমান থেকে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ পর্যন্ত এসে সফরসঙ্গী জিব্রাইল (আ.) ও ঐশীবাহন বোরাকের গতি স্থির হয়ে গেল। জিব্রাইল (আ.) এখানে থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এই সীমানাকে অতিক্রম করে আমার আর সামনে অগ্রসর হওয়ার ক্ষমতা নেই। এখানে শুধু আপনি আর আপনার রব।’ এখানে রাসুলুল্লাহ (সা.) ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.)-কে তাঁর স্বরূপে দেখতে পান।
অতঃপর জিব্রাইল (আ.) মহানবীর সঙ্গে গমন করলেন না। এখানে তাঁর বাহনও পরিবর্তন হয়। তারপর নবী করিম (সা.) স্বয়ং ‘রফরফ’ নামক বিশেষ স্বর্গীয় বাহনে আরোহন করে রাব্বুল আলামিনের অসীম কুদরতে কল্পনাতীত দ্রুতবেগে ৭০ হাজার নূরের পর্দা পেরিয়ে আরশে মোয়াল্লার সন্নিকটে পৌঁছালেন এবং আল্লাহর দরবারে হাজির হলেন। মহানবী (সা.) স্থান-কালের ঊর্ধ্বে লা মাকাম-লা জামান স্তরে পৌঁছান। নূর আর নূরের সৌরভে তিনি অভিভূত হয়ে যান।
সেখানে আল্লাহ তা’য়ালার সঙ্গে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দিদার এবং কথোপকথন হয়। তিনিই একমাত্র মহামানব, যিনি এ সফরের মাধ্যমে আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্যে যান। রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহ তা’য়ালার নৈকট্য, সান্নিধ্য ও দিদার লাভ করার পর জ্ঞান-গরিমায় মহীয়ান হয়ে তাঁর প্রশংসা ও গুণকীর্তন করেন এবং করুণা ও শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ পুরস্কার হিসেবে আল্লাহর বান্দাদের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের হুকুম নিয়ে ওই রাত ও উষার সন্ধিক্ষণে আবার মক্কায় নিজগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন।
পটভূমি : রাসুল (সা.)-এর প্রিয়তম চাচা আবু তালেব মৃত্যুবরণ করেন। এর কিছুদিন পরই রাসুল (সা.)-এর প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা (রা.) ইন্তেকাল করেন। ইসলামের জন্য তাঁদের সহযোগিতা অনস্বীকার্য। তা ছাড়া ইসলামের দিকে দাওয়াত দিতে তায়েফ গমন করেন। সেখানের অধিবাসীদের দাওয়াত দিলে তারা সাড়া দেয়নি। উপরন্তু তারা রাসুল (সা.)-কে পাথর নিক্ষেপ করে কষ্ট দেয়। রাসুলের পেছনে শিশু-কিশোরদের লেলিয়ে দেয়। ফলে তিনি ভারাক্রান্ত মনে বেরিয়ে আসেন। মহানবী (সা.)-এর এই মনঃকষ্ট দূর করতে আল্লাহ তাঁর প্রিয় বন্ধুকে একান্ত সাক্ষাতে ডেকে নেন।
করণীয় : এই ফজিলতময় রাতে নফল নামাজ আদায়, রোজা পালন, রাতব্যাপী জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল ইবাদত-বন্দেগিসহ পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, মিলাদ ও মোনাজাতের মধ্যদিয়ে কাটিয়ে দেয়া মহাপুণ্য ও সওয়াবের কাজ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন