রজব আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের মাস। এ মাস বান্দার গুনাহ মাফের মাস। রজব মাসের সাথে ইসলামের অতীত ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে। রাসুল (সা.) রজব মাসে মেরাজে গমন করেছিলেন। নূহ (আ.) মহাপ্লাবনের আশঙ্কায় রজব মাসেই কিস্তিতে আরোহণ করেছিলেন। রাসুল (সা.)-এর কাছে রজব মাসেই প্রথম ওহি আসে। এ ছাড়া রজব হলো জান্নাতের তলদেশে প্রবাহিত একটি নদীর নাম। এ নদীর পানি দুধের মতো ধবধবে সাদা এবং মধুর চেয়েও অধিক মিষ্টি। যে সকল মুমিন বান্দা রজব মাসে নফল রোজা রাখবে, আল্লাহ আখেরাতে ওই সমস্ত রোজাদারকে রজব নদীর পানি দ্বারা আপ্যায়ন করবেন। সুমিষ্ট রজব নদীর পানি বরফের চেয়ে শীতল। যারা একবার রজব নদীর পানি পান করবে, তাদের আর কোনো দিন পানির পিপাসা লাগবে না।
ইসলাম আগমনের পর বছরের বারো মাসের মধ্য থেকে রজবসহ ৪টি মাসকে ‘আশহুরে হুরুম’ তথা সম্মানিত মাস ঘোষণা করা হয়। এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর কাছে গণনায় মাস ১২টি, তন্মধ্যে ৪টি (সম্মানিত হওয়ার কারণে) নিষিদ্ধ মাস, এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান’ (সুরা. তওবা, আয়াত-৩৬)। রজব মাস মুসলমানদের কাছে আসে রমজানের আগমনী বার্তা নিয়ে। প্রতিটি বড় বড় কাজ ও মহান দায়িত্ব পালনের জন্য নানা আয়োজন, প্রশিক্ষণ ও পূর্বপ্রস্তুতির দরকার হয়। রমজানে মাসব্যাপী সিয়াম সাধনা ইসলামের অন্যতম ইবাদত। এর মাধ্যমে পাপপঙ্কিলতাপূর্ণ অন্তরকে পরিশোধিত করা হয়। স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সেতুবন্ধন স্থাপিত হয়। আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদারগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো’ (সুরা. বাকারা, আয়াত-১৩৮)। বান্দার দোয়া কবুলের ক্ষেত্রে পাঁচটি বিশেষ রাতের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। পাঁচটি রাতের প্রথমটি হলো জুমার রাত, দ্বিতীয়টি ঈদুল ফিতরের রাত, তৃতীয়টি ঈদুল আজহার রাত, চতুর্থটি রজব মাসের চাঁদ উদয়ের প্রথম রাত, পঞ্চমটি শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত (সুনানে বায়হাকি )। ইমাম আবু বকর জাসসাস (রহ:) বলেন, ‘এসব মাসে ইবাদতের প্রতি যত্নবান হলে, বাকি মাসগুলোয় ইবাদত করা সহজ হয়। আর এ মাসগুলোয় গুনাহ থেকে বেঁচে থাকলে অন্য মাসেও গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা সহজ হয়’ (আহকামুল কোরআন)।
অন্যান্য মাসের মতো রজব মাসের জন্য বিশেষ কিছু নফল আমল রয়েছে; যে আমলের মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত লাভের পথ সুগম হয়। রজব মাস অন্য মাসের তুলনায় অধিক সম্মানী হবার কারণে রাসুল (সা.) দুই মাস আগ থেকেই মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা শুরু করতেন। আনাস (রা.) বলেন, ‘যখন রজব মাসের আগমন হতো, তখন রাসুল (সা.) এই দোয়াটি পড়তেন, ‘হে আল্লাহ, রজব ও শাবান মাসে আমাদের বরকত দান করুন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন’ (মুসনাদে আহমদ, নাসায়ি )।
রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘রজব মাস হচ্ছে মহান আল্লাহর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস, ফজিলতের দিক থেকে রমজানের পর অন্য কোনো মাস এর সমপর্যায়ের নয়। এ মাসে কাফেরদের সঙ্গেও যুদ্ধ করা হারাম। রজব মাস আল্লাহর মাস, শাবান মাস আমার মাস এবং রমজান মাস হচ্ছে আমার উম্মতের মাস। যে ব্যক্তি রজব মাসের একটি দিন রোজা রাখে, মহান আল্লাহ তার ওপর সন্তুষ্ট হন, তার প্রতি মহান আল্লাহর ক্রোধ দূর হয়ে যায় এবং জাহান্নামের একটি দরজা তার জন্য বন্ধ হয়ে যায়।’ অন্যত্রে বর্ণিত আছে, ‘রজব মাস হচ্ছে আমার উম্মতের ক্ষমা প্রার্থনার মাস। অতএব এ মাসে অত্যধিক ক্ষমা প্রার্থনা কর, কেননা মহান আল্লাহ ক্ষমাশীল ও অত্যন্ত দয়ালু’। গোনাহে পরিপূর্ণ মানবাত্মাকে তাওবার মাধ্যমে পরিষ্কার করে নিতে হবে। আবু বকর বলখি (রহ:) বলেন, ‘রজব চারা রোপণের মাস। শাবান চারাতে পানি সেচ দেয়ার মাস আর রমজান হলো ফসল তোলার মাস। তিনি আরো বলেন, ‘রজব মাস ঠান্ডা বাতাসের মতো, শাবান মাস মেঘমালার মতো আর রমজান মাস হলো বৃষ্টির মতো’ (লাতায়েফুল মা’আরেফ )। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি রজব মাসের রাতগুলোর একটিতে (দুই রাকাত করে) নির্দিষ্ট একটি নিয়মে দশ রাকাত নামাজ আদায় করবে, আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করে দেন।
রজব মাস আগমন হলে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেইন, তাবে-তাবেইন, আইম্মায়ে মুজতাহেদিন, ওলী আল্লাহসহ মুমিন বান্দারা বিশেষ কিছু নফল আমল করতেন। এ মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ইবাদতের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ রাতকে লাইলাতুল রাগায়িব বলা হয়। এ মাসের ১৫ তারিখের রাতকে লাইলাতুল ইস্তিফতাহ বলা হয়। এ মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতকে শবে মেরাজ বলা হয়। রাসুল (সা.)-এর মাধ্যমে যে কয়েকটি মোজেজা সংঘটিত হয়েছিল, এর মধ্যে মেরাজ হলো সর্বশ্রেষ্ঠ মোজেজা।
মেরাজের রাতের ফজিলত ও গুরুত্ব অপরিসীম। রাসুল (সা.)-এর নবুওয়াত লাভ-পরবর্তী ঘটনাগুলোর মধ্যে মেরাজ সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা। রমজানের আগমনী বার্তা ও প্রস্তুতি গ্রহণ করার মাস হিসেবে রজব মাস মুসলমানদের জন্য অনেক তৎপর্য ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই একান্তভাবে রাসুল (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করে এই বরকতময় মাসটিকে যথার্থভাবে আমলে কাটানোর চেষ্টা করা। রাসুল (সা.)-এর দেখানো পথে রমজান মাসের প্রস্তুতি গ্রহণস্বরূপ রোজা রাখার আমল করা। রজবের প্রস্তুতির ওপর নির্ভর করে রমজানের প্রস্তুতি। যে সকল মুসলমানগণ রজব মাস থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারবেন তারাই রমজান কাটাতে পারবেন পুরোপুরি হক আদায় করে। এছাড়া রজব মাসের মহামান্বিত রাত লাইলাতুল মেরাজে ইবাদত-বন্দেগি করে কাটানোও মুমিনের দায়িত্ব। রজব মাস থেকেই শুরু করতে হবে রমজানের সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ। মহা সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে রজব মাসের মর্যাদা যথাযথভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন