শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

মরছে ধলেশ্বরী-বংশী

সাভারে ট্যানারির বর্জ্যে দূষণের কবলে দুই নদী : কমেছে মাছ ও অন্য জলজ প্রাণীর বিচরণ

সেলিম আহমেদ, সাভার থেকে | প্রকাশের সময় : ১২ মার্চ, ২০২১, ১২:০৬ এএম

ঢাকার সাভারের হরিণধরা এলাকার চামড়া প্রক্রিয়াজাতকারী ট্যানারির বিষাক্ত বর্জ্যে দূষণের শিকার হচ্ছে ধলেশ্বরী ও বংশী নদী। ট্যানারির বর্জ্যে নদীর পানিতে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হচ্ছে। নদী পার ও আশপাশের মানুষজনের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ছে। এসব নদীতে মাছ নেই বললেই চলে, জলজ উদ্ভিদের অস্তিত্বও বিপন্ন।
নদীর দুই তীরের স্বল্প আয়ের মানুষের জীবিকা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাতাসেও বর্জ্যরে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। চারপাশের পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। দূষিত পানি ব্যবহার করে অনেকে চর্মরোগ ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হচ্ছেন। অথচ বুড়িগঙ্গার দূষণ রোধে রাজধানীর হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোকে সাভারের চামড়াশিল্প নগরে সরিয়ে নেওয়া হলেও একই দূষণের শিকার ধলেশ্বরী ও বংশী নদী।

বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনের ঢাকা জেলা কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট মজিবুর রহমান বলেন, ট্যানারির বর্জ্যে ধলেশ্বরী নদীর পানি দূষিত হয়ে পড়েছে। প্রায়ই বিভিন্ন মাছ মরে ভেসে উঠতে দেখা যায়। বর্জ্যরে দূর্গন্ধে নদীর পাড়ে যাওয়া যায়না। তিনি বলেন, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের এক সভায় ট্যানারির বর্জ্যে নদী দূষণের বিষয়টি উত্থাপন করা হলেও কোন সূরাহ মিলেনি।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ট্যানারির বর্জ্য সরাসরি একটি পাইপ দিয়ে ধলেশ্বরী নদীতে পড়ছে। এছাড়া ড্রেনের বর্জ্য ও ময়লা পানির আরও ৪টি মোটা পাইপ দিয়ে সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। এখান থেকে দূষিত পানি গিয়ে মিশছে বংশী নদীতে। দূষণের ফলে ভরা বর্ষায়ও নদীতে কোনো মাছ নেই। ট্যানারির আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্ষার সময় পানিতে দুর্গন্ধ কম থাকে। পানির রংও অনেকটা স্বাভাবিক। তবে বর্ষার পরই পানি কালো হয়ে তীব্র দুর্গন্ধ ছড়ায়। দুর্গন্ধে অনেকের শ্বাসকষ্ট হয়। চর্মরোগও দেখা দেয়। আগে এগুলোর প্রকোপ ছিল না।

নদী তীরের বাসিন্দা রিপন হোসেন বলেন, ট্যানারীর বর্জ্য মিশ্রিত পানি নদীতে যাওয়ায় নদীর পানিও দূষিত হয়ে পড়েছে। এই নদীতে গোসল করলে শরীরে এলার্জি, দাউদ ও ফোসকা পড়ে যায়। অথচ আগে এই নদীর পানি ব্যবহার করতেন সবাই। এখন নদীর পানি কোনো কিছুতেই ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। এমন কি গরু-ছাগলও গোসল করানো যায় না। এই নদীতে মাছ ধরতে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে ছুটতাম। আগে জেলেরা সারা বছর মাছ ধরেও শেষ করতে পারত না। এখন তো নদীতে মাছও নেই বলেন তিনি।

স্বাধীন ট্যানারির তত্তাবধায়ক সিরাজুল ইসলাম সোলাইমান বলেন, আমরা কারখানায় কাজ করেও বর্জ্যরে বিষাক্ত গন্ধে টিকতে পারিনা, বাহিরের লোক কিভাবে বিষাক্ত এ গন্ধ সহ্য করবে। বর্জ্য বিভিন্ন কারখানা থেকে ডাম্পিং এরিয়ায় নিয়ে ফেলার কাজ করেন পিয়াস হোসেন। তিনি বলেন, ৫ বছর ধরে এই কাজ করছি। পায়ে জুতা হাতে গøাবস পড়েও বিষাক্ত বর্জ্যরে কবল থেকে রক্ষা পাইনা। হাতে পায়ে ফোসকা পড়ে যায়।

এদিকে পরিবেশ দূষণ করে ট্যানারি কারখানায় উৎপাদন ও বর্জ্য নদীতে ফেলার অভিযোগে সাভারে বিসিক শিল্প নগরী ট্যানারিতে গত বছরের ৭ অক্টোবর অভিযান চালিয়ে আটটি কারখানাকে ২১ লাখ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমান আদালত। পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-সচিব রুবিনা ফেরদৌসীর নেতৃত্বে ট্যানারি শিল্প নগরীর মেসার্স কহিনুর ট্যানারি, ইউনিকর্ণ লেদার (মেসার্স ইন্টারন্যাশনল ট্যানারি), মেসার্স গুলশান ট্যানারি, আঞ্জুমান ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেড, ভেলেঙ্গ এ্যাজেন্সিস লিমিটেড, মেসার্স কিড লেদার, মেসার্স সুপ্রিয়র লেদার এবং মেসার্স টিপারা ট্যানারিকে ২১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
তখন পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-সচিব রুবিনা ফেরদৌসী বলেছিলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না নিয়ে বিষাক্ত বর্জ্য পাশে ধলেশ^রী নদীতে ফেলে পরিবেশ দূষণ করে কারখানায় লেদার উৎপাদন করে আসছিল। এলাকাবাসীর অভিযোগের ভিত্তিত্বেই এই অভিযান পরিচালনা করা হয়। চামড়া শিল্প নগরীর প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী জিতেন্দ্র নাথ পাল বলেন, নদীতে পাইপের মাধ্যমে যে পানি যাচ্ছে সেটা কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার থেকে পরিশোধিত হয়ে নদীতে পড়ছে। হয়তো পানির রং কালো কিন্তু বর্জ্য মিশ্রিত পানি নয়।

৪টি মোটা পাইপ দিয়ে ধলেশ্বরী নদীতে তরল বর্জ্য পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী জিতেন্দ্র নাথ পাল বলেন, ওটা ট্যানারির ড্রেনের পানি। প্রতিটি ট্যানারির সাথে ড্রেনের সংযোগ রয়েছে। এসব ড্রেনে পিঠ রয়েছে ৩৩৩টি। ড্রেনে বৃষ্টির পানি ও কারখানাগুলোর ওয়াশরুমের পানি যাওয়ার কথা। কিন্তু কারখানা কর্তৃপক্ষ পানির সাথে চামড়ার টুকরো ও ময়লা আবর্জনা ফেলায় কোন না কোন পিঠ আটকে পানি উপচে সড়কে বা ড্রেন দিয়ে নদীতে পড়ছে। এতেই অনেকে মনে করে বর্জ্য নদীতে পড়ছে।

তবে প্রকল্পের কাজ এখনও শেষ হয়নি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, জুনের মধ্যে কাজ শেষ হবে। আর কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) কাজও মার্চ/এপ্রিলের শেষ হবে। সব কাজ শেষে আমরা চায়না ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তখন সব বুঝে রাখবো। এরপর কোন ময়লা বা কালো পানি নদীতে পড়লে তখন আমাদের বলতে পারবেন। কারখানাগুলো পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম মানছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেকেই পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম মানছে না। আমরা একাধিকবার বলার পরও কারখানা কর্তৃপক্ষ কোন কর্ণপাত করেনি। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পড় না থাকায় কয়েকটি কারখানায় অভিযান চালিয়ে বিসিককে জরিমানাও করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়মকানুন মানছে না এমন প্রায় ৬০টি কারখানার তালিকা করে পরিবেশ অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে বলেন তিনি।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন