শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

নকশা দুর্বলতায় দুর্ঘটনা বাড়ছে

ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১৩ মার্চ, ২০২১, ১২:০১ এএম

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। হাইওয়ে পুলিশের পরিসংখ্যান মতে, গত ১৪ মাসে যাত্রাবাড়ী-মাওয়া অংশে ৭৯টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অর্ধ-শতাধিক। তবে স্থানীয়দের মতে, দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, নকশাগত দুর্বলতা এবং নজরদারি না থাকার কারণে বেপরোয়া চলতে গিয়ে এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে এক্সপ্রেসওয়ের ভেতরে বাস-বে রাখা নিয়ে। এ ছাড়া ব্যারিয়ার সঠিকভাবে না বসানো এবং পথচারি পারাপারের জন্য ফুটওভার ব্রিজ না রাখায় দুর্ঘটনা ঘটছে। এ প্রসঙ্গে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, যদি এক্সপ্রেসওয়ে আমরা বানাই, তাহলে এক্সপ্রেসওয়ের যেসব বৈশিষ্ট্য সেগুলো আমাদের রাখতে হবে। নাহলে সেটা একটা সাধারণ মহাসড়কের মতো হয়ে যাবে। তিনি বলেন, এক্সপ্রেসওয়েতে বাস-বে রাখা যাবে না। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে এটি রাখা হয়েছে। এতে বাসে উঠতে বা নামতে গিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের ভেতরে চলে আসছে যাত্রী। ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। তখনই দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে।
এদিকে, একের পর এক দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ মার্চ ফুটওভারব্রিজ নির্মাণের দাবিতে হাসাড়া এলাকায় এক্সপ্রেসওয়েটিতে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন এলাকাবাসী। তারা বলেন, ফুটওভার ব্রিজ না থাকায় এক্সপ্রেসওয়ে পারাপার হতে গিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা। এর জন্য দ্রæত সময়ের মধ্যে হাসাড়া কালী কিশোর স্কুল অ্যান্ড কলেজ গেটে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের দাবি জানান তারা।
ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সহজ ও নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এজন্য একমুখী প্রশস্ত সড়ক, ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস, ইন্টারচেঞ্জ, ধীরগতির গাড়ির জন্য আলাদা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। এসবের জন্য এক্সপ্রেসওয়েতে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। পুথিবীর কোনো দেশে এত বেশি খরচের এক্সপ্রেসওয়ে বা মহাসড়ক নেই। তবে এক্সপ্রেসওয়েটি চালুর পর যাতায়াত সহজ হলেও নিরাপদ হয়নি। এক্সপ্রেসওয়ের ঢাকা-মাওয়া অংশটি পড়েছে হাইওয়ে পুলিশের গাজীপুর রিজিয়নে। নিয়ন্ত্রণ করছে মুন্সীগঞ্জের হাঁসাড়া হাইওয়ে থানা। হাঁসাড়া থানার তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১ মার্চ পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটারের ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৬৫ জনের। আহত হয়েছেন ৬৭ জন। তবে স্থানীয়দের দাবি, দুর্ঘটনার সংখ্যা আরও অনেক বেশি। নিহতের সংখ্যাও ৬৫ জনের বেশি হবে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে সব ধরনের যানবাহন চলে বেপরোয়া গতিতে। বিশেষ করে ঢাকা-মাওয়া রুটের বাসগুলো নিজেদের মধ্যে ‘কে আগে যাবে’- এ প্রতিযোগিতায় নেমে ঝুঁকিপূর্ণভাবে ওভারটেক করে। জুরাইনের বাসিন্দা তাজুল ইসলাম বলেন, কয়েকদিন আগে তিনি মাওয়া গিয়েছিলেন ইলিশ পরিবহনের বাসে। বাসটি এক্সপ্রেসওয়েতে বেপরোয়া বেগে চালাচ্ছিল চালক। একটার পর একটা বাসকে ওভারটেক করতে গিয়ে বাসটি বেশ কয়েকবার দুর্ঘটনার কবলে পড়তে যাচ্ছিলো। এমতবস্থায় যাত্রীরা ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে। তারপরেও চালক একইভাবে চালাতে থাকলে বাধ্য হয়ে আমি নিজে গিয়ে চালককে বাস থামাতে বলি। আমার কথাও যখন চালক শুনছিল না তখন হেলপারকে বলি আমি জুরাইনের বাসিন্দা। এ বাসকে আর জুরাইন হয়ে ফিরতে দিবো না। এরপর চালক বাসের গতি কমায়। তাজুল বলেন, এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ির বেপরোয়া গতি পর্যবেক্ষণ করা উচিত। হাইওয়ে পুলিশ অনায়াসে তা করতে পারে। আমার জানা মতে, প্রতিদিনই এরকম ঘটনা ঘটছে কিন্তু হাইওয়ে পুলিশ সেগুলোর খবরই রাখে না। প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, এক্সপ্রেসওয়েতে বালু ও ইটবাহী ট্রাকগুলো চলে বেপরোয়া গতিতে। এগুলোর কারণে অনেকগুলো দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া শত শত মোটরসাইকেল চলে বেপরোয়া গতিতে। নিমতলী এলাকার বেশ কয়েকজন বাসিন্দা জানান, তারা গত এক বছরে বহু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা দেখেছেন। বেপরোয়া গতিতে চলতে গিয়েই দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে। পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গছে,এক্সপ্রেসওয়েটিতে সবচেয়ে বেশি মারা গেছে পথচারী। বেপরোয়া বাস বা ট্রাকের চাপায় তারা নিহত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ঘটেছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। এছাড়াও পেছন থেকে গিয়ে অন্য গাড়ি ধাক্কা, ধীরগতির গাড়িকে দ্রুতগতির গাড়ির ধাক্কা, ওভারটেকিং করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারানো ও বেপরোয়া গতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত।
গাজীপুর হাইওয়ে রিজিয়নের একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এক্সপ্রেসওয়েতে হতাহতের মধ্যে পথচারীর সংখ্যাই বেশি। তিনি জানান, এক্সপ্রেসওয়েতে আন্ডারপাস থাকলেও বেশির ভাগ মানুষ তা ব্যবহার করেন না। রেলিং টপকে এক্সপ্রেসওয়ের ওপর দিয়ে রাস্তা পার হয়। শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ-সবার মধ্যে একই প্রবণতা। হুটহাট পথচারীদের এক্সপ্রেসওয়ের ভেতরে ঢুকে পড়া দ্রুতগতির গাড়ির চালকদের পক্ষে সব সময় লক্ষ্য রাখা সম্ভব হয় না। তখনই দুর্ঘটনাগুলো ঘটে।
জানা গেছে, এক্সপ্রেসওয়েটির নির্মাণকাজ চলমান থাকা অবস্থায় ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর বাস-মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নয়জন নিহত হয়। ঘটনার পর বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তারা একটি তদন্ত প্রতিবেদন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেন। ওই প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার জন্য অনেকগুলো কারণ চিহ্নিত করা হয়। এর একটি ছিল সড়ক ডিভাইডারের ব্যারিয়ার সঠিকভাবে স্থাপন না করা। এক্সপ্রেসওয়েটির যে জায়গায় ডিভাইডারের কংক্রিটের অংশ রয়েছে, তার চেয়ে ১০ ইঞ্চি পেছনে স্টিলের ব্যারিয়ার স্থাপন করা হয়েছে। বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দলের একজন সদস্য জানান, গাড়ি চালানোর সময় স্টিলের ব্যারিয়ার আর কংক্রিটের ডিভাইডারের ১০ ইঞ্চি পার্থক্য সব সময় চালকের পক্ষে লক্ষ্য করা সম্ভব হওয়ার কথা নয়। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ব্যারিয়ার সঠিকভাবে স্থাপন না করার দায় সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী, তদারককারী ও বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট। এর সঙ্গে নকশাগত দুর্বলতাকেও দায়ী করেছেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান। তিনি বলেন, এখনো পদ্মা সেতু চালু হয়নি। সেতু চালু হলে ট্রাফিক আরো বাড়বে। তখন কিন্তু এসব সমস্যা আরো বেশি হবে। একমুখী হওয়ার কারণে মুখোমুখি সংঘর্ষ হবে না, কিন্তু বাস-বেগুলোর কারণে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, বাস-বেগুলো তুলে দিয়ে কিংবা নতুন করে ‘অর্গানাইজ’ করে ও পথচারীদের পারাপারের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক ফুটওভারব্রিজ কিংবা আন্ডারপাস নির্মাণ করে দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া, সেখান থেকে পদ্মা সেতুর পর ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়েটি গত বছরের ১২ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। তবে জানুয়ারির শুরু থেকেই পুরোদমে শুরু হয় গাড়ি চলাচল। এখনো পদ্মা সেতু চালু হয়নি। ফেরি পারাপার ছাড়া ওপারে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাই টোলবিহীন এক্সপ্রেসওয়েটির ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-মাওয়া অংশই বেশি ব্যবহার হচ্ছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন