[প্রখ্যাত সাংবাদিক, পরবর্তীকালে সফল টিভি উপস্থাপক ফজলে লোহানীকে একালের তরুণরা চেনে না বললেই চলে। ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান অবজারভারে তাঁর সাংবাদিকতা শুরু। তারপর ইংরেজি-বাংলা অনেক পত্রিকায় কাজ করেছেন। ৮০’র দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘যদি কিছু মনে না করেন’ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিশাল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এদশে টিভি সাংবাদিকতার তিনিই জনক। ১৯৭০ সালের জানুয়ারি থেকে দৈনিক পাকিস্তানে ‘আত্মা দিয়ে লেখা’ শীর্ষক জাতীয় নেতাদের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ফজলে লোহানীর অন্তরঙ্গ আলাপ-চারিতা প্রকাশিত হয় ১১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। শেষ কিস্তি প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল ৪ ফেব্রæয়ারি। যে কোনো কারণেই হোক সেটি আর প্রকাশিত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ফজলে লোহানীর ওই অসমাপ্ত সাক্ষাৎকারে দেশ ও রাজনীতির একটি চিত্র উঠে এসেছে। সাক্ষাৎকারটি সংক্ষিপ্ত আকারে এখানে ছাপা হলো।]
কৃশকায় একটি ছেলে নদীর ধার ধরে দৌড়ে হাট থেকে ফিরছিল। পাটবোঝাই বড় বড় নৌকা, চালের কারবারি, গুড়ের সওদাগর, কুলিদের শোরগোল ভালো লাগে তার। বড় নৌকা তার দাদার বাবা ওয়াসিমুদ্দিনেরও ছিল। একবার এক নীলকর ইংরেজ সাহেবকে মোকদ্দমায় হারিয়ে দিয়েছিলেন ওয়াসিমুদ্দিন। জরিমানা গুনতে হয়েছিল সাহেবকে।
হাটের ধারের খোলা মাঠে গিয়ে লাঠিখেলা দেখতেও ভালো লাগে ছেলেটির। আরো ভালো লাগে মুকিম মুন্সির গান। ওই ছেলেটি বড় হলে দেখা গেল একটাই চাওয়া তার- বাঙালির মুক্তি। দেশভাগের বেশ আগেই তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। নাম তার শেখ মুজিবুর রহমান। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তার গুরু।
শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, ‘শহীদ সাহেবকে অনেকে চিনতেন না। কী বিরাট ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ ছিলেন তিনি!’
প্রশ্ন করলাম, ‘অনেকে বলেন যে, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন উপরতলাকার মানুষ।’
শেখ সাহেব জবাব দিলেন, ‘যিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ব্যক্তিগতভাবে জেনেছেন, তিনি এ ধরনের কথা বলবেন না। তিনি আমাকে ছেলের মতো ভালোবাসতেন। ১৯৪১-এর পর থেকে আমি সব সময়ই পাশে থাকতাম।’
গণতান্ত্রিক আন্দোলন আজ নতুন দিকে মোড় ফিরিয়েছে- এ পথের কথা সোহরাওয়ার্দী হয়তো ভেবেছিলেন। কিন্তু তিনি জীবিত থাকতে এই নতুন উত্তরণ দেখে যেতে পারেননি। আওয়ামী লীগ আজ সমাজতান্ত্রিক আদর্শের কথা বলছে। আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে রয়েছে- আওয়ামী লীগের আদর্শ স্বাধীন, শোষণহীন ও শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম করা।
প্রশ্ন করলাম, এই আদর্শ হচ্ছে একটি বিপ্লবধর্মী আদর্শ। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছাড়া এই আদর্শ নির্বাচনের মাধ্যমে বাস্তবে রূপায়িত করা যাবে কি?
শেখ মুজিব বিশ্বাস করেন, বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনই অগ্রগতির পথ। ‘আজ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। আজ জনসাধারণ বুদ্ধিসচেতন’, শেখ বললেন।
গত ১১ জানুয়ারি পল্টনের জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক প্রোগ্রাম পেশ করেছেন এই বলে যে, মূল শিল্পগুলো, ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ হবে।
এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট একটি ধারণার দরকার রয়েছে।
তাহলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, বীমা ও মূল শিল্প অন্যান্য প্রদেশেও সম্ভব কি না? জাতীয়করণ ব্যবস্থা কি প্রতিটি প্রদেশেই বিস্তৃত হবে?
এ ব্যাপারে শেখ মুজিব মনে করেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের জনসাধারণও আজ একচেটিয়া পুঁজিপতি ও বুর্জোয়া সামন্ত শ্রেণির হাতে নিগৃহীত। সেখানেও গণতান্ত্রিক আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠেছে।
বললেন, পাকিস্তানে একচেটিয়া পুঁজির যে কার্টেল সৃষ্টি হয়েছে, তা ভাঙার জন্যই ব্যাংক, বীমা ও মূল শিল্পগুলো জাতীয়করণের কথা বলা হয়েছে। একচেটিয়া ধনতন্ত্রের সর্বগ্রাসী কর্তৃত্ব ভেঙে দেওয়ার প্রথম ব্যবস্থা হবে এর মাধ্যমেই।
তিন বছর আগে বেলুচিস্তানে দেখা হয়েছিল এক পাঠানের সঙ্গে। নিঃস্ব হয়ে সে জনমজুরি করছে কোয়েটার রাস্তায়। কোয়েটা থেকে শখানেক মাইল দূরে তার একখন্ড জমি ছিল। ছোট জমির ওপর নির্ভর করে স্ত্রী আর দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে বেঁচে থাকা অসম্ভব। সেই ছোট্ট জমির অংশ একটু একটু করে সে বিক্রি করতে থাকে। এমনি করেই তার একমাত্র আশার শেষ সম্বলটুকু নিঃশেষ করে ফেলে একদিন। হাতের টাকা ফুরিয়ে যায়। তারপর একদিন রাতের অন্ধকারে সে পালিয়ে আসে তার গাঁ ছেড়ে। প্রিয়জনদের পরিত্যাগ করে।
‘তোমার ছেলে-মেয়ে আর স্ত্রীর খবর কী?’
‘কিচ্ছু জানি না।’
‘কত দিন ধরে তুমি কোয়েটার বাজারে কুলির কাজ করছ?’
‘ছ মাস।’
এই ছ মাসে এই নিঃস্ব মানুষটির প্রিয়জনরা কী করছে? সংসার ভেঙে গেছে তার চিরতরে।
গল্প শুনে শেখ মুজিবের চোখ ছলছল করে উঠল।
‘এ জুলুমের শেষ হবেই।’
আরেকটি প্রশ্ন করলাম, আমলাতন্ত্র আমাদের দেশে একটি বিশেষ শ্রেণি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভর করে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবে রূপায়ণ করা কি সম্ভব হবে?
শেখ সাহেব জবাবে বললেন, ‘যে আমলাতন্ত্র জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য কাজ করবে না, তাকে শেষ পর্যন্ত সরে পড়তে হবে।’
সাতচল্লিশ থেকে সত্তর। ২২টি বছরের শেষ। ২২টি হৃদয়-নিংড়ানো, জ্বালাময়ী, ব্যথাদীর্ণ ক্লেশময় বছর।
অত্যাচার আর অন্যায়ের একটানা ইতিহাস এ কয়টি বছরে লেখা হয়েছে।
শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, ‘সোনার বাংলা নিঃশেষ হয়ে গেছে এ ক’টি বছরে। বাংলার ঘরে ঘরে আজ আর বাতি দেবার লোক নেই।’
গোপালগঞ্জে যে যুগে কংগ্রেসি ছাত্ররা খদ্দরের সাদা টুপি মাথায় দিয়ে ‘কুইট ইন্ডিয়া’ স্লোগান দিয়ে বেড়াত, সেই যুগে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের শুরু। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কলকাতায় কংগ্রেস ট্রাম-বাস পুড়িয়ে অসহযোগ আন্দোলন করছে। গোপালগঞ্জের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার পড়েছে- ব্রিটিশ ভারত ছাড়ো। শেখ মুজিব তখন গোপালগঞ্জ মহকুমা মুসলিম লীগ ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারি। আর নির্বাচিত হয়েছেন অল ইন্ডিয়া মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশনের কাউন্সিলর হিসেবে।
পাকিস্তান আন্দোলন মুসলমান ছাত্রসমাজের কাছে ছিল এক অগ্নিমন্ত্র। মুসলমান ছাত্রদের যে অংশ অপেক্ষাকৃত উদার আর প্রগতিশীল মনোভাব নিয়ে আন্দোলন করছিল, তাদের সঙ্গে শরিক ছিলেন শেখ মুজিব।
উনিশ শ’ ছেচল্লিশের নির্বাচনে মুসলিম লীগের জয়লাভ। উনিশ শ’ সাতচল্লিশের সিলেট রেফারেন্ডাম। ব্রিটিশের ভারত ত্যাগ। পাকিস্তানের জন্ম। মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে এরপর কী করে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের প্রভাব বৃদ্ধি এবং সম্পূর্ণভাবে ক্ষমতা দখল- এসব কথা ঐতিহাসিকের দলিলে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম জেলে যান শেখ মুজিব। উনিশ শ’ আটচল্লিশের ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিনিয়ালস স্ট্রাইক উপলক্ষ করে। এরপর শেখ মুজিবুর রহমান অনেকবারই জেলে গিয়েছেন।
শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে বললেন, ‘আমি বলেছিলাম জেলারকে, জুলুম করতে পারো আমার ওপর। কিন্তু আমাকে মারতে পারবে না কখনো।’
নারায়ণগঞ্জের মাঠে ১৯৬৬ সালের জনসভা। ওপারে মগরাপাড়া, সোনাকুন্ডা, আরো দূরের গাঁ থেকে এসেছেন জনতা। নতুন কথা শোনার জন্য। মঞ্চে দাঁড়িয়ে সারা দেশের উদ্দেশে শেখ মুজিব ছুড়ে দিলেন আগুনের জ্বলন্ত ফুলকির মতো একটি বাক্য, আমাদের বাঁচতে দাও। এ কথা এর আগেও বলে গেছেন অনেকে। কিন্তু এমন জ্বালাময়ী করে এর আগে কেউ বলেননি। তাই ইসলামাবাদ থেকে গর্জে উঠলেন আইয়ুব খান, দ্য ল্যাংগুয়েজ অব ওয়েপন উইল আনসার দ্য ডিমান্ডস বা দ্য শেখ। আইয়ুব বললেন, ‘সারা দেশে আমি গৃহযুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে দেব।’
মিথ্যা সাজানো মামলা আগরতলার ষড়যন্ত্র। শেখ মুজিবকে পঁচিশ বছর জেলে থাকতে হবে। পল্টনের মাঠে আর কখনো তাঁকে আসতে হবে না। শাসিয়েছিলেন সেদিনকার রক্তচক্ষু শাসকরা।
এর আগেই শেখের বিরুদ্ধে তেরোটি মামলা আনা হয়েছিল। আপত্তিকর বক্তৃতা দেওয়া তাঁর অপরাধ। শেখ মুজিব নিজেই এই মামলাগুলো সম্পর্কে বলেছেন, ‘১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসে প্রথমে আমাকে যশোরে গ্রেপ্তার করা হয়। খুলনার এক জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার পর যশোর হয়ে আমি ঢাকা ফিরছিলাম। যশোরে পুলিশ এলো। আপত্তিকর বক্তৃতা দেওয়ার অভিযোগে ঢাকা থেকে প্রদত্ত এক পরোয়ানা দেখিয়ে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়।’
এই উপাখ্যানের শেষ এখানেই নয়।
শেখ সাহেব বলে যান, ‘যশোরের মহকুমা হাকিমের সামনে আমাকে হাজির করা হয়। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেন। আমি ঢাকায় ফিরে এলে সদর মহকুমা হাকিম আমার জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু ওই দিনই মাননীয় দায়রা জজ আমার জামিন মঞ্জুর করায় আমি মুক্তি পাই।’
‘সন্ধ্যা সাতটায় আমি বাড়ি পৌঁছাই। কিন্তু বিড়ম্বনার শেষ এখানেই নয়। এক ঘণ্টা পর রাত আটটায় পুলিশ আরেকটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে আমার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত।’ শেখ মুজিবুর রহমান বলতে থাকেন, ‘সিলেটে আপত্তিকর বক্তৃতা দেওয়ার অভিযোগে এই পরোয়ানা সেখান থেকে দেওয়া হয়েছে। গ্রেপ্তার করে সেই রাতেই পুলিশ প্রহরাধীনে আমাকে সিলেটে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন সকালে সিলেটের মহকুমা হাকিম আমার জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে আমাকে হাজতে পাঠিয়ে দেন। এর পরদিন সিলেটের মাননীয় দায়রা জজ আমার জামিন মঞ্জুর করেন, আমি মুক্তি পাই।’
এ যেন রহস্যরোমাঞ্চ সিরিজের গোয়েন্দা কাহিনি। যুক্তিতর্কের অতীত চরম বিবেকহীনতার এক সুদীর্ঘ বিরতিহীন বর্ণনার মতো শোনায় শেখ মুজিবুর রহমানের মুখের কথাগুলো।
ইনসেট
এ যেন রহস্যরোমাঞ্চ সিরিজের গোয়েন্দা কাহিনি। যুক্তিতর্কের অতীত চরম বিবেকহীনতার এক সুদীর্ঘ বিরতিহীন বর্ণনার মতো শোনায় শেখ মুজিবুর রহমানের মুখের কথাগুলো।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন