মারাত্মক দূষণের শিকার এখন নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ। নদী দখল ও দূষণ, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য, অতিষ্ট নারায়ণগঞ্জবাসী। নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ দূষণের চিত্র অত্যন্ত উদ্বেগজনক। নদী দখল ও দূষণ, শব্দ দূষণ ও বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের পরিবেশ অধিদফতর, বিআইডব্লিউটিএ ও জেলা প্রশাসনের দেখভাল করার কথা থাকলেও তারা সেটা না করে অনেক ক্ষেত্রে উল্টো দূষণকারীদের সহযোগিতা করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের প্রধান নদী বন্দর নারায়ণগঞ্জের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে একাধিক নদ-নদী, শাখা নদী ও খাল। নারায়ণগঞ্জের পূর্বে বয়ে গেছে মেঘনা, পশ্চিমে বুড়িগঙ্গা, দক্ষিণ-পশ্চিমে ধলেশ্বরী নদী ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদও প্রবাহিত হয়েছে জেলার পশ্চিমে এবং শীতলক্ষ্যা নদী প্রবাহিত হয়েছে শহরের মাঝ দিয়ে। এছাড়াও ছোট বড় শতাধিক খাল এসে মিশেছে এসব নদীতে। কিন্তু এ সমস্ত নদ-নদী ও খালগুলো প্রভাবশালী ভ‚মিদস্যু ও দখলবাজরা দীর্ঘদিন ধরে দখল করে আসছে।
নারায়ণগঞ্জের নদীগুলো অবৈধভাবে দখল হওয়ার কারণে পানি প্রবাহের গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে ধীরে ধীরে। তাছাড়া নদীগুলো ভয়াবহ দূষণের স্বীকার হচ্ছে, শিল্প কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য, বসতবাড়ি, হাট-বাজারের নোংরা দূষিত পানি, মৃত প্রাণি, প্রাণির পঁচা উচ্ছিষ্ট অংশ নদীতে ফেলা হচ্ছে। অপরিকল্পিত ও অস্বাস্থ্যকর টয়লেট ব্যবস্থা ও বিভিন্ন বড় বড় ভবনের টয়লেট ড্রেনের সাথে সংযোগ করে নদীতে ফেলা হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ শহরের মানুষের ব্যবহারের দূষিত নোংরা পানি, মাছ ও মাংস বাজারের নোংরা বর্জ্য, ড্রেনে দীর্ঘদিন জমে থাকা দূষিত বর্জ্য সরাসরি ড্রেনের মাধ্যমে নদীর সাথে সংযোগ করা হচ্ছে, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন ও বিভিন্ন পৌরসভার বর্জ্য অপরিকল্পিতভাবে ড্রেনের মাধ্যমে সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২ হাজারের উপরে। যার অধিকাংশই দূষিত তরল বর্জ্য নির্গমনকারী প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ডাইং কারখানা অন্যতম। অধিকাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠানে বর্জ্য শোধনাগার বা ইটিপি নেই। আর যাদের আছে তারা খরচ বাঁচাতে অধিকাংশ সময়ে ইটিপি বন্ধ রাখে বলে অভিযোগ আছে। এতে করে সাংঘাতিকভাবে নদী দূষণ হচ্ছে। মৃত প্রায় এ সমস্ত নদ-নদীগুলো দেখলে মনে হয় এ যেন বর্জ্য রাখার ভাগাড়। এ সমস্ত নদ-নদী ধ্বংস করার পেছনে কাজ করছে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এতে নদ-নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী ও জলজ প্রাণি ধ্বংস হচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জের প্রাণ শীতলক্ষ্যা নদীর দুর্গন্ধযুক্ত পানি ও বিভিন্ন খাল ডোবার দিকে তাকালেই এ দৃশ্য চোখে পড়ে। সম্প্রতি সরেজমিনে নৌকায় ও শীতলক্ষ্যা পাড়ে ঘুরে দেখা যায়, নদীর পাড়ে ময়লা আবর্জনার স্তুপ পড়ে আছে। এমন কোনো বর্জ্য নেই, যা শীতলক্ষ্যায় ফেলা হচ্ছে না। পানি আলকাতরার মতো কালো। দুর্গন্ধে নাকে রুমাল না চেপে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। শিল্পবর্জ্যই শীতলক্ষ্যা দূষণের প্রধান কারণ।
সরেজমিনে মেঘনা নদীতে গিয়ে দেখা যায়, নদীর পানি এখনো পুরোপুরি ব্যবহারের অনুপযোগী না হলেও দূষিত হতে বেশি বাকি নেই। শিল্পবর্জ্য ফেলা হচ্ছে মেঘনায়। শীতলক্ষ্যা নদীর নবীগঞ্জ ঘাটে স্থানীয়রা জানায়, পানিতে কিছুক্ষণ হাত বা পা ডুবিয়ে রাখলে মারাত্মক চুলকানিসহ ফোসকা ওঠে। বর্ষায় পানি একটু ভালো হলেও তা বেশিদিন স্থায়ী হয় না।
এদিকে, পলিথিন পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হলেও নারায়ণগঞ্জে দিন দিন এই ব্যাগের ব্যবহার মাত্রাতিরিক্ত বেড়েই চলছে, যা পরিবেশকে ঠেলে দিচ্ছে হুমকির দিকে। ব্যবহৃত পলিথিনের পরিত্যক্ত অংশ দীর্ঘদিন অপরিবর্তিত ও অবিকৃত থেকে মাটি, পানি দূষিত করে। পলিথিন মাটির উর্বরতা হ্রাস করে ও মাটির গুনাগুন পরিবর্তন করে ফেলে। পলিথিন পোড়ালে এর উপাদান পলিভিনাইল ক্লোরাইড পুড়ে কার্বন মনোক্সাইড উৎপন্ন হয়ে বাতাস দূষিত করে। পলিথিনের ব্যাগ ও অন্যান্য জিনিস পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
পলিথিন ও বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্য ব্যাপকভাবে ব্যবহারে নারায়ণগঞ্জের নদী-খাল, ড্রেন ও উর্বর জমিতে মিশে মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ এবং মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধে আইন থাকলেও নেই কোন কার্যকারিতা। পলিথিন বন্ধে পরিবেশ অধিদফতর নারায়ণগঞ্জ কার্যালয় পুরোপুরি ব্যর্থ। কেবল নদীর দূষণ নয়, বায়ুদূষণেও পিছিয়ে নেই নারায়ণগঞ্জ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরগুলোর তালিকার উপরের দিকেই আছে নারায়ণগঞ্জের নাম। মার্কিন পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থার তৈরি করা বায়ুমান সূচক (একিউআই) অনুযায়ী, বায়ুমান (বাতাসে ভাসমান বস্তুকণা, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, ওজোন, সালফার ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ) ৫০ এর নিচে থাকলে তা স্বাস্থ্যকর বলে ধরা হয়। আর ৩০০ এর ওপরে উঠলে তা বিপজ্জনক।
বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদফতরের পাঁচ বছরের (২০১৩-১৮) গবেষণা বলছে, ঢাকার চেয়েও বেশি দূষিত নারায়ণগঞ্জের বাতাস। আয়তনে নারায়ণগঞ্জ দেশের সবচেয়ে ছোট জেলা হলেও এই জেলাতেই রয়েছে প্রায় সাড়ে তিনশ’ ইটভাটা। যার মধ্যে অধিকাংশ ইটভাটাই অবৈধ। এসব ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ বা কাঠের গুড়ি। কয়লার পরিবর্তে জ্বালানি হিসেবে কাঠ বা কাঠের গুড়ি পোড়ানোর ফলে ভাটাগুলো থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।
ইট ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়া শুধু কৃষি জমি বা পরিবেশের ক্ষতি করছে এমনটিই নয়, জনস্বাস্থ্যেও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে গড়ে ওঠা এসব ইটভাটা পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি হুমকির মুখে ফেলছে জনস্বাস্থ্য। ইট ভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সিমেন্ট কারখানার ফ্লাই অ্যাশ (নির্গত ছাই)। শুধুমাত্র নারায়ণগঞ্জে সিমেন্ট কারখানা আছে ডজন খানেক। সিমেন্ট কারখানার আশপাশে নিশ্বাস নিতে গেলে মনে হয়, নাক ও মুখ দিয়ে ছাই ঢুকছে। এছাড়াও নির্মাণকাজ, সড়কের ধুলা, গাড়ির ধোঁয়া ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের কালো ধোঁয়া ইত্যাদি বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ।
শব্দ দূষণেও পিছিয়ে নেই নারায়ণগঞ্জ। নারায়ণগঞ্জ জেলায় নীরব ঘাতক শব্দ দূষণের বহু উৎস রয়েছে। এর মধ্যে গাড়ির হর্ন, নির্মাণকাজ, মাইকের ব্যবহার, দিন নেই রাত নেই পাইলিংয়ের কাজ, ইট ভাঙার যন্ত্র, সিমেন্ট মিক্সারের যথেচ্ছ ব্যবহার, রাজনৈতিক সভা থেকে শুরু করে বিয়ে ও পিকনিক সকল ক্ষেত্রে মারাত্মক শব্দ দূষণ হয়।
নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন উপলক্ষে মাইক ও লাউড স্পিকার ব্যবহার করে উচ্চ শব্দে গান বাজানো একটা রীতিতে পরিণত হয়েছে। তবে আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না বলে আইন থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল আমিনের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতর নারায়ণগঞ্জ জেলার উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুনের মোবাইলেও একাধিকবার ফোন করলে তিনিও রিসিভ করেননি। এমনকি পরিচয় ও বিষয় জানিয়ে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
নারায়ণগঞ্জ বিআইডবিøওটিএ এর যুগ্ম-পরিচালক শেখ মাসুদ কামাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, নদী দখলকারীদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান বিরতিহীনভাবে চলছে এবং নদী দখলকারীরা যত শক্তিশালী হোক না তাদের ছাড় দেয়া হবে না।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, নদী দখল ও দুষণ হয়েছে এটা সত্য। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা উচ্ছেদের ব্যবস্থা করছি এবং বিআইডবিøউটিএ যখন নদী উচ্ছেদে অভিযান চালায় জেলা প্রশাসন সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে নিষিদ্ধ পলিথিন বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন