মিজানুর রহমান তোতা : যশোরের ভবদহ এলাকার পানিবন্দীদের দুর্ভোগ মোটেও কমেনি। বরং সার্বিক পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়েছে। একটানা ২৭ দিন পানির মধ্যে বসবাস তাদের। ভবদহ স্লুইস গেট স্থাপনের পর এবার স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্গতিতে পড়েছেন পানিবন্দীরা।
এর আগে পানিবদ্ধতার ব্যাপকতা এতটা বেশি হয়নি বলে পানিবন্দীরা জানান। জেলা প্রশাসনের হিসাবানুযায়ী, প্রায় ২শ’ গ্রামের ২ লাখ ৬৭ হাজার মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। যদিও বেসরকারি হিসেবে এর সংখ্যা আরো বেশি। পানিবদ্ধ এলাকায় ত্রাণ সাহায্য আছে কিন্তু অপ্রতুল। যদিও ত্রাণের চেয়েও এখন বেশি কষ্ট রান্না, ঘুমানোর। গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন পানিবন্দীরা। চারিদিকে পানি আর পানি। বিরাট এলাকার মানুষের মাঝে কোনো ঈদ আনন্দ নেই। তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ‘কি করে বাঁচবো, ছেলেপেলে নিয়ে আর কষ্ট সহ্য করতে পারছি না’-পানিবন্দীরা এমন আর্তনাদ করছেন। জেলা প্রশাসন বলেছে, গত কয়েকদিনে মাত্র এক দেড় ইঞ্চি পানি কমেছে। ভবদহের আশেপাশের ছোট বড় বিলের পানি মোটেও নামছে না। পানি নামার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
ভবদহ স্লুইস গেট যশোর ও খুলনার ৭টি উপজেলা এলাকার ৬ লক্ষাধিক মানুষের জন্য একটি অভিশাপ। পানি সরাও মানুষ বাঁচাও এর সঙ্গে ভবদহ স্লইস গেট তুলে দেওয়ার দাবি উঠেছে জোরেশোরে। গতকাল ভবদহ পানি নিষ্কাশন আন্দোলনের উপদেষ্টা বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ইকবাল কবির জাহিদ দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, প্রায় প্রতিটি বর্ষা মৌসুমেই ভবদহ এলাকার মানুষ পানিবন্দী হয়। এটি যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। পানিবদ্ধতা যতটা না প্রাকৃতিক, তার চেয়ে অনেক বেশি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। বছরের পর বছর ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর মানবসৃষ্ট দুর্যোগ একাকার হয়ে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করে আসছে বিশেষ করে যশোরের ৩টি উপজেলা কেশবপুর, মনিরামপুর ও অভয়নগরের। তার মতে, ভবদহ স্লুইস গেট তুলে দিতে হবে, নতুবা গেটের পাশ দিয়ে শ্রীনদীতে আলাদা সংযোগ করতে হবে। জরুরিভাবে উজানে নদী সংযোগ, ড্রেজি করে পলি অপসারণ, বিল কপালিয়ায় টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) চালু করে জোয়ার আধার সৃষ্টি করতে হবে। ভবদহ স্লুইস গেট দিয়ে আশেপাশের ২৭টি বিলের পানি নিষ্কাশন হয়ে থাকে। বিলের তলদেশ পলিতে উঁচু হওয়ায় গেট দিয়ে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। পানিবন্দীদের অভিযোগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ঠিকাদারদের দুর্নীতি তো আছেই তাছাড়া নদীতে পাটা, বাঁধ ও মাছের ঘের তৈরি করে নিষ্কাশন পথ বন্ধ করার কারণেও পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। প্রবল বর্ষণও হয়েছে এবার রেকর্ড পরিমাণ।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, সবুজ বিপ্লবের ঘোষণা দিয়ে ১৯৬০ সালের দিকে যশোরের সদর, মনিরামপুর, কেশবপুর, অভয়নগর, খুলনার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া উপজেলার মধ্যবর্তী ভবদহ নামকস্থানে শ্রীনদীর উপর নির্মাণ করা হয় একটি বড় ¯ুইস গেট। একপর্যায়ে যশোর ও খুলনার প্রায় ২শ’ বর্গকিলোমিটার এলাকার ৬ লক্ষাধিক মানুষের মরণফাঁদে পরিণত হয় ভবদহ স্লুইস গেট। গেটটিতে মোট কপাট ৩৬টি। গেট সংলগ্ন শ্রীনদী, টেকা ও মুক্তেশ্বরী এই ৩টি নদী রয়েছে। ওই স্লুইস গেট দিয়ে বিল কেদারিয়া, বিল বকর ও বিল আড়পাড়াসহ যশোর ও খুলনা এলাকার মোট ২৭টি বিলের পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিটি বর্ষা মৌসুমে বিল তীরবর্তী আশেপাশের শত শত গ্রামে পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হতে থাকে। পরবর্তীতে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। ভবদহ স্লুইস গেট চিহ্নিত হয় যশোর ও খুলনার বিরাট এলাকার দুঃখ হিসেবে। একসময় ভবদহ স্লুইস গেট সরকারি অর্থ লুটপটের কারখানায় পরিণত হয়েছে। ভুক্তভোগীদের অনেকে ব্যাঙ্গ করে বলে থাকেন টাকা লোপাটের স্লুইস গেট। যেটি যশোর ও খুলনার বিরাট এলাকার অভিশাপ। কিন্তু আশীর্বাদ পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের। ভবদহ সমস্যার সমাধানের নামে যুগ যুগ ধরে সমস্যা জিইয়ে রেখে শুধু সরকারি অর্থ লুটপাট হয়েছে-এ অভিযোগ ক্ষতিগ্রস্ত ভবদহ এলাকার সাধারণ মানুষের। ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দের অভিযোগও একই। ভবদহ স্লুইস গেটের কারণে নদনদী ও খাল-বিলের পানি নিষ্কাশন হতে পারে না। ভবদহ সংশ্লিষ্ট নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হওয়ায় বহুদিন জোয়ার-ভাটাও হয় না। ২০০৭ সালে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ভবদহ সমস্যার সমাধান হয়। পরবর্তীতে ধারাবাহিকতা রক্ষা করেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড। যার কারণে আবারও পানিবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
আমাদের উপজেলা প্রতিনিধিরা জানান, যশোর-সাতক্ষীরা সড়কের ৯টি স্থান, গোলাঘাটা, বাজিতপুর, ফতেপুর, পাঁজিয়া ও কেশবপুর থেকে সাবদিয়া পর্যন্ত, সাগরদাঁড়ি সড়কসহ সকল অভ্যন্তরীণ সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কেশবপুর বিচ্ছিন্ন যেন দ্বীপে পরিণত হয়েছে। পানিবন্দীরা বিভিন্ন রাস্তা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে। জেলায় মোট ১শ’ ১৬টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ পর্যন্ত ১১ লাখ টাকা সরকারি বরাদ্দ পাওয়া গেছে বলে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম জানান। বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে শিশুখাদ্য, পর্যাপ্ত আলো ও জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। গো খাদ্যেও সংকট তীব্র। বিভিন্ন জায়গা থেকে ত্রাণ নিয়ে আসা ব্যক্তিরা মেইন রাস্তার পাশে দিয়েই চলে যাচ্ছেন বলে পানিবন্দীদের অভিযোগ। সর্বশেষ গতকালও বৃষ্টি হয়েছে। এতে পানিবন্দীদের দুর্দশা আরো বেড়েছে। পানিবন্দীদের আকাশে মেঘ দেখলেই বুক সকাঁপে। রাস্তার পাশে খোলা আকাশের নিচে টোং-ঘর বানিয়ে তাদের বসবাস। সেখানে বৃষ্টি হলে বর্ণনাতীত কষ্ট হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন