শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

সহীহ হাদীসে শবে বরাত বা মধ্য শা’বানের রাত

আমিনুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২৬ মার্চ, ২০২১, ১২:০৯ এএম

শবে বরাত এর পরিচয় : শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে ফার্সি ভাষায় শবে বরাত বলে। হাদীসে ‘লাইলতুল বরাত’ নামে এসেছে। শব অর্থ রাত এবং বরাত অর্থ মুক্তি। অর্থাৎ মুক্তির রাত। এ রাত্রে মহান আল্লাহ মুক্তি ও মাগফিরাতের দরজা খুলে দেন। সূরা দুখান এর ৩ ও ৪ নং আয়াতে ‘লাইলাতুম মুরবারাকা’ বা বরকতময় রাত এর শব্দের ব্যাখ্যায় তাফসীরে জালালাইনে প্রসিদ্ধ তাফসিরকার লিখেছেন বরকত ময় রাত হচ্ছে- কদরের রাত অথবা মধ্য শাবানের রাত অর্থাৎ শবে বরাত। তার ভাষায় ‘হিয়া লাইলাতুল কদর আও লাইলাতুন নিছফে মিন শাবান’। এ রাতকে মুফাসসিরগণ লাইলাতুল বারাত, লাইলাতুল মুবারাকাহ, লাইলাতুল রহমান নামে অবহিত করেছেন। ফার্সি ভাষা রাজ ক্ষমতা থাকার সুযোগে হাদিসের লাইলাতুল বারাত কে শবে বরাত নামে পরিচিত পেয়েছে। তাফসীরে মারিফুল কোরআনে সূরা দুখানের ৩ ও ৪নং আয়াতের তাফসিরে লিখেন, ইকরিমা প্রমূখ কয়েকজন তফসীরবিদ থেকে বর্ণিত আছে ‘এ আয়াতে বরকতের রাত্রি বলে শবে বরাত অর্থাৎ শাবান মাসের ১৫তারিখের রাত্রিকে বুঝানো হয়েছে।’

শবে কদর যেমন মুবারক রাত তেমনি শবে বরাত ও একটি মুবারক রাত। উভয় রাতে কোরআন নাযিল হয়েছে। তাফসিরে রাজি ২৭/২৩৯ পৃষ্ঠায় ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত-তিনি বলেন নিশ্চয় আল্লাহ তা’য়ালা মধ্য শাবান রাতে (শবে বরাত) যাবতীয় সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত ফায়সালা করেন। আর শবে কদরে তা নির্দিষ্ট দায়িত্বশীলের নিকট অর্পন করেন।
ইবনে আব্বাস (রা.) আরো বলেন নিশ্চয় আল্লাহ তা’য়ালা লওহে মাহাফুজ থেকে পূর্ণ কুরআন একত্রে অবতরণ করে শবে বরাতে। আর অবতরণের ধারা সমাপ্ত করেন শবে কদরে। (কুরতুবী ১৬/১২৬)। এই হাদিসে “লাইলাতুল কদর” শব্দটি যেমন এসেছে তেমনি “লাইলাতুল বরাত” শব্দটিও এসেছে পরিস্কার ভাবে। পরবর্তীতে এই শব্দটি শবে বরাত নামে পরিবর্তিত হয়েছে ফার্সি ভাষা রাজ ক্ষমতায় থাকার কারণে। শবে বরাতের ৮/১০টি সহি হাদিসঃ অসংখ্য ছহীহ হাদীস শবে বরাত সম্পর্কে রয়েছে। তিরমিজি শরীফের প্রথম খন্ডের ১৫৬ পৃষ্ঠায় শুধু মাত্র হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণিত হাদিসটিকে জয়িক বা দুর্বল বলার চেষ্টা করেছেন-ইমাম তিরিমিজি এবং ইমাম বোখারী।
হযরত আবু বকর (রা.) বর্ণিত হাদিসটিকে ইমাম তিরিমিজি জয়িফ বা দুর্বল বলেন নি। সুনামে ইবনে মাজাহ ৯৯ পৃষ্ঠাতে ‘লাইলাতুন নিছফে মিন শাবান বা শবে বরাত সম্পর্কে ৪টি হাদিস রয়েছে-এ হাদিসের কিতাবে আবু মুসা আশয়ারী (রা.) বর্ণিত হাদিসটিকে দুনিয়ার সকল হাদিস বিশারাদগণ সহীহ বলেছেন। প্রসিদ্ধ এই দুটি হাদিসের কিতাব ছাড়া অসংখ্য হাদিসের কিতাব যেমন ‘সহীহ ইবনে হাব্বান, বায়হাকী মুযনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল’ অসংখ্য হাদিসের কিতাবে তারা সহীহ হিসাবে অগনিত হাদিস লিপিবদ্ধ করেন।
এ কথা বলা যায় যে, শবে বরাত সম্পর্কে বর্ণিত হাদিস সমূহের ২/১টি হাদিসের বর্ণনাকারী জয়ীফ বা দুর্বল। শবে বরাত সম্পর্কে কোন ছহীহ হাদিস নাই। যারা বলেন তাদেরকে তাওবা করতে হবে। কারণ পর্যালোচনা ও সমালোচনা ছাড়া আট দশটি হাদিস সকল হাদিস বিশারদের কাছে সহীহ বা বিশুদ্ধ। আর দেওবন্দ মাদ্রসার মুহাদ্দিস আনোয়ার শাহ কাশমিরি শবে বরাত সম্পর্কিত সকল হাদিসকে সহীহ বলেছেন। (টীকা দেখন ১৫৬পৃষ্টা)।
তিরিমিজি শরীফ। শবে বরাতের সহীহ হাদিস ঃ ১। সুনানে ইবনে মাজাহ ৯৯ পৃষ্ঠায় ‘নিছফে শাবান’ অধ্যায়ে ৪টি হাদিস আছে। একটি হাদিস উল্লেখ করছি যা আবু মুসা আশআরি থেকে বর্ণিত। আবু মুসা আশআরী (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, রাসুল (সা.) বলেছেন আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে তার দৃষ্টির প্রতি (রহমতের) দৃষ্টিপাত করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষপোষণকারী ব্যতিত সকলকে ক্ষমা করে দেন।
২। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর একই ভাষ্যের একটি হাদিস যা আহমদ বিন হাম্বল তার আল মুসনাদ গ্রন্থে উল্লেখ করেন। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল মুসনাদ কিতাবে আমরের পুত্র আবদুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেছেন। হযরত রাসুলে করীম (সা.) বলেছেন, অর্ধ শাবানের রাতে আল্লাহ পাক তার বান্দাদের প্রতি কৃপাদৃষ্টি দান করেন এবং দুই শ্রেণীর বান্দা ব্যতিত সকলকে ক্ষমা করে দেন। প্রথম দুই শ্রেণীর মানুষ হল ওই ব্যক্তি যে তার মুসলিম ভায়ের শত্র“তায় লিপ্ত এবং দ্বিতীয় ব্যক্তি হল মানুষ হত্যাকারী। । (আহমদ ইবনু হাম্বল, আলমুসনাদ ২/১৭৬)।
হযরত আয়েশা ও হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত হাদিস দুটি ছাড়া আরো ৮/১০ জন সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত হাদিসকে সকল মুহাদ্দিসগণ সহীহ বলেছেন। শবে বরাত সম্পর্কে যাদের বর্ণিত হাদিসকে সকল হাদিস বিশারদগণ সহীহ বলেছেন তারা হলেন -১। হযরত আবু বক্কর, ২। আবু মুছা আশআরি, ৩। আবদুল্লাহ ইবনে আমর, ৪। মুয়াজ বিন জাবাল, ৫। আবু হুরাইরা (রা.), ৬। আবু সা’লাবা, ৭। আউফ ইবনে মালিক, ৮। হযরত ওসমান বিন আবিল আস, ৯। আউফ বিন মালেক প্রমূখ সাহাবীগণ।
শবে বরাতের অসংখ্য হাদিস সহীহ হওয়া সম্পর্কে মুহাদ্দিসদের অভিমত : ১। আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশমিরির অভিমতঃ দেওবান্দ মাদ্রাসার মুহাদ্দিস আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশমিরি বলেন ‘হাজিহিল লাইলাতু লাইলাতুল বরাত, ওয়া ছাহহার রেওয়াত ফি ফজলে লাইলাতুল বরাত। ওয়া আমমা মা জুকেরা আরবাবুল কুতুব মিনায যিয়াফে ওয়াল মুনকেরাত ফালা আছলা লাহা” অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত হলো লাইলাতুল বরাত বা শবে বরাত এবং লাইলাতুল বরাত সম্পর্কে কিছু কিছু আলেমরা যে বলেছেন তা জয়ীফ এবং মুনকার হাদিস। তার কোন ভিত্তি নাই। বরং শবে বরাতের সকল হাদিস সহীহ। (তিরিমিজি শরীফের ১৫৬ পৃষ্ঠার টিকা)।
২। আল্লামা আল নাছির উদ্দিন আলবানীর অভিমত : আহলে হাদিস মতবাদে বিশ্বাসীদের ধারণা মতে বর্তমান দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ হাদিস গবেষক নাছির উদ্দিন আলবানী। কথায় কথায় তারা তার উদ্ধৃতি পেশ করেন। তিনি লাইলাতুল বরাত সম্পর্কে মুয়াজ বিন জাবালের হাদিসটি উল্লেখ করে বলেন “হাদিসুন সহীহুন রুওিয়া আন জামাআতিন মিনাছ ছাহাবতি মিন তুরুকিন মুখতালিফাতিন। ইয়াশুদ্ধু বা’যুহা বা’জান, ওয়া হুম মুয়াজবিন জাবাল, আবু ছালাবা আবদুল্লাহ বিন আমর, আবু মুসা আশআরী, আবু হুরাইরা, আবু বক্কর ছিদ্দিক (রা.) আউফ বিন মালেক ও আয়েশা (রা.) অর্থাৎ মাআজ বিন জাবাল বর্র্ণিত হাদিসটি সহীহ। সাহাবায়ে কেরামের বিশাল অংশ বিভিন্ন সনদে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। যা একটি অপরটিকে দৃঢ় করে। তারা হলেন মুআজ ইবনে জাবাল, আবু সালাবা, আবদুল্লাহ বিন আমর, আবু মুছা আশআরি, আবু হুরায়রা, আবু বক্কর ছিদ্দিক (রা.), আউফ বিন মালেক ও হযরত আয়েশা। (সিলসিলাতুল আহদিসীস সহীহা ৩/১৩৫)।
আল বানীর কথায় বুঝা গেল মাআজ বিন জাবাল যে ভাষায় হাদিসটি বর্ণনা করেছেন অনুরূপ আরো আট জন সাহাবী একই হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। তাই হাদিসটি সহীহ এবং সুদৃঢ়।
নাছির উদ্দিন আলবানী হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণিত হাদিসটি বর্ণনা করে লিখেন “শবে বরাত সম্পর্কিয় হাদিসের ক্ষেত্রে সার কথা হলো, শবে বরাত সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসগুলো সমষ্টিগতভাবে নিঃ সন্দেহে ‘সহীহ”।
তিনি আরও বলেন ‘ইসলাহুল মাসাজিদ’ বইয়ের লেখক কাসেমী কতিপয় হাদিস বিশারদের উদ্বৃতি দিয়ে লিখেছেন যে, ‘শবে বরাতের ফযীলতপূর্ণ কোন সহীহ হাদিস নেই।” তার এ কথার উপর আস্থা রাখা উচিৎ হবে না। তবে কেউ যদি এমনটা বলেই থাকে তাহলে বুঝতে হবে হাদিসের বিভিন্ন সূত্র অনেষনে যথাযথ প্রচেষ্টা তার সীমিত হওয়ার কারণে এ রকম ঘটেছে অথবা চঞ্চলতা হেতু এক কাজ করেছে। (সিলসিলাতু আহদিসিস সহীহা ০৩/১৩৮-১৩৯)।
৩। আবদুর রহমান মুবারকপুরীরর মতঃ তিরিমিজি শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘তুহফাতুল আহওয়াযী’ তে আল্লামা মুবারকপুরী বলেন “ফি ফজিলতে লাইলাতুন নিছফে মিন শাবান ইদাতু আহাদিছিন, মজমুয়ুহা ইয়াদুল্লু আন্না লাহা আছলান”। অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত এর ফজীলত সম্পর্কে বেশ কয়েকটি হাদিস রয়েছে। যা প্রমান করে যে, এর ভিত্তি আছে। তিনি আরো বলেন, মধ্য শাবানের রাত অর্থাৎ শবে বরাত হাদিসে প্রমাণিত নয় যারা মনে করে তাদের বিরুদ্ধে এই হাদিস গুলো দলিল (তুহফাতুল আহওয়াজী ৩/৩৮৪-৩৮৫) ।
৪। ইবনে তাইমিয়ার (রহ.) মত : তিনি বলেন, “লাইলাতুন নিছফে মিন শাবান ফকাদ রুওিয়া ফি ফজলিহা মিনাল আহাদিছিল মরফুআহ ওয়াল আছার মা ইয়াকতাজি আননাহা লাইলাতুন মুফাদদালাহ।” অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে অনেক হাদিসে মরফু এবং আছার বর্ণিত হয়েছে। যা দ্বারা বুঝা যায় যে, ঐ রাত ফজিলত পূর্ণ একটি রাত।” (ইকতিযা পৃষ্ঠা নং-৪৮৪)।
৫। ড. খোন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীরের অভিমত : কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদিস বিভাগের অধ্যাপক রিয়াদ ইউনির্ভাসিটি থেকে পি-এইচডি ডিগ্রী প্রাপ্ত ডঃ খোন্দকার বলেন “৮জন সাহাবীর সূত্রে বিভিন্ন সনদে এ হাদীসটি বর্ণিত। শবে বরাত বিষয়ে এটিই একমাত্র সহীহ হাদীস। এ হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, এ রাতটি ফযীলতময় এবং রা রাতে আল্লাহ তার বান্দাদেরকে ক্ষমা করেন। (খুতবাতুল ইসলাম-২৬৪পৃষ্ঠা) ।
উপসংহারঃ যে খানে ৮/১০টি শবে বরাতের পক্ষে সহীহ হাদিস রয়েছে সেখানে হযরত আলী ও হযরত আয়েশার দুটি হাদিসের যুক্তি দেখিয়ে শবে বরাতের পক্ষে কোন সহীহ হাদিস নেই তা বলা ঠিক নয়। একটি কথা বলছি যাদের কাছে হাদিস অনুসন্ধানের উপকরণ কম এমন কেউ যেন আন্দাজ অনুমান করে শবে বরাত সম্পর্কে কোন সহীহ হাদিস নেই এমন কথা থেকে বিরত থাকবেন। অন্যথায় হাদীস অস্বীকার করার কারণে কি শাস্তি হবে চিন্তা করতে পারেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
মোঃ সুজাত হসেন ২৯ মার্চ, ২০২১, ১১:০৯ পিএম says : 0
মাশাআল্লাহ
Total Reply(0)
মুসতাক ১৮ মার্চ, ২০২২, ৪:২২ পিএম says : 0
আলহামদুলিল্লাহ।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন