দু’দিন পরই শবে বরাত। মুসলমানদের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ দিন। শবে বরাতের কয়েক দিন পরই পবিত্র রমজান। অথচ শবে বরাতের আগেই নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন। আর এ লাভ নিচ্ছেন মুনাফাখোররা। পবিত্র রমজান মাস আসার আগেই প্রায় সব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গতকাল রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া যায়।
এদিকে সরকারের বিপণন সংস্থা (টিসিবি) বলছে, টানা এক মাস ধরে বেড়ে চলেছে অন্তত ১২টি পণ্যের দাম। পণ্যগুলো হলো- সয়াবিন, চিনি, মসুর ডাল, মুগডাল, পেঁয়াজ, আটা, ময়দা, গরুর গোশত, খাসির গোশত, মুরগি, গুড়া দুধ, হলুদ, আদা, জিরা। ক্রেতারা বলছেন, পবিত্র রমজান মাসকে পুঁজি করে মুনাফাখোররা এই পণ্যগুলোর দাম পরিকল্পিতভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। এভাবে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে সীমিত আয়ের মানুষেরা পড়েছেন বিপাকে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বাজার ঘুরে দেখা গেছে, নতুন করে বেড়েছে খোলা সয়াবিন, আটা, ময়দা, ব্রয়লার মুরগি, গুড়া দুধ, চিনিসহ অন্তত আরো ৬টি পণ্যের দাম। খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ মুনাফাখোর আড়তদারদের কারসাজিতে পণ্যের দাম বাড়ছে। তারা গোডাউনে পণ্য লুকিয়ে রেখে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। বাধ্য হয়েই বেশি দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করতে হয়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষক ড. জায়েদ বখত বলেন, রোজার মাসকে কেন্দ্র করে প্রতিবছরই মানুষের মধ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়। অসৎ ব্যবসায়ীরা এই প্রত্যাশার একটা সুযোগ নেন। এখন সেটাই হয়েছে। দেখা যায় অনেক সময় পর্যাপ্ত পণ্য সরবাহ থাকার পরও জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। এটা হয় ম ূলত ভোক্তাদের আচরণের কারণে। তিনি আরো বলেন, ভোক্তারা মনে করে এই সময় দাম বাড়বে, ব্যবসায়ীরাও মনে করে এই সময়ে দাম বাড়বে। এইটা মনে করে ব্যবসায়ীরা আগে থেকেই জিনিসপত্র ধরে রাখে। ভোক্তারাও দাম আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বেশি করে পণ্য কিনে রাখে।
রাজধানী ঢাকার বাজারের তথ্য বলছে, গত এক সপ্তাহে খোলা সয়াবিনের দাম বেড়েছে লিটারে এক থেকে দুই টাকা। ৫ লিটার বোতলের দাম বেড়েছে ১০-২০ টাকা পর্যন্ত। এক লিটার বোতলের দাম বেড়েছে ৬ টাকা। প্যাকেট আটার দাম বেড়েছে কেজিতে দুই টাকা। খোলা ময়দার দাম বেড়েছে কেজিতে দুই টাকা। ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে কেজিতে ৫ টাকা থেকে ১০ টাকা। চিনির দাম বেড়েছে কেজিতে ৩ টাকা।
টিসিবি’র তথ্য বলছে, গত এক মাসে আটার দাম বেড়েছে ১. ৪৭ শতাংশ। কিছুদিন আগে যে আটার দাম ছিল ৩৫ টাকা কেজি দর; এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৩৬ টাকায়। ৩৫ টাকা কেজি ময়দার দাম বেড়ে হয়েছে ৩৮ টাকা।
এক মাসের ব্যবধানে খোলা সয়াবিনের দাম বেড়েছে ৫.১৫ শতাংশ। ১১৫ থেকে ১১৮ টাকা দামের সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়। গত মাসে এই এক লিটার বোতলের দাম ছিল ১৩৫ টাকা, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায়। আর ৫ লিটার বোতল তেল এখন ৬২০ থেকে ৬৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খোলা পামওয়েলের দাম বেড়েছে ৭.৯২ শতাংশ। এখন পামওয়েল তেল ১০৮ থেকে ১১০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। গত এক মাসে পামওয়েল সুপারের দাম বেড়েছে ৮.৭০ শতাংশ। পাম (সুপার) এখন বিক্রি হচ্ছে ১১৫ টাকা।
টিসিবি’র হিসাবে গত এক মাসে মসুর ডালের দাম বেড়েছে ৫ শতাংশ। এক মাস আগে এই মসুর ডাল বিক্রি হতো ৯৫ টাকা কেজি দরে। এখন সেই ডাল বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা থেকে ১০৫ টাকা কেজি দরে। ১২০ টাকা কেজি মুগ ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকা কেজি। রোজাকে সামনে রেখে দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৮.৩৩ শতাংশ। টিসিবি’র হিসেবে গত ২৬ ফেব্রæয়ারি যে পেঁয়াজের দাম ছিল ২৫ টাকা কেজি। এখন সেই পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কেজিতে। আর আমদানি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। এক মাস আগে এই পেঁয়াজ ছিল ১৮ টাকা থেকে ২০ টাকা। ১৪০ টাকা কেজি দেশি হলুদের দাম বেড়ে হয়েছে ১৫০ টাকা থেকে ১৬০ টাকা। ৬০ টাকা কেজি আমদানি করা আদার দাম ১০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৭০ টাকা। জিরার দাম বেড়েছে ১২ শতাংশ। এক মাস আগের ২৮০ টাকা কেজি জিরা এখন বিক্রি হচ্ছে ৩২০ টাকা দরে।
এ প্রসঙ্গে রাজধানীর নিউ মার্কেটের শহীদুল ইসলাম বলেন, জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়েছে, তাতে সীমিত আয়ের মানুষদের খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দিতে হবে। পবিত্র রমজান মাসকে পুঁজি করে মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা অধিকাংশ পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। একই এলাকার বাসিন্দা শরিফা খাতুন নামের এক গৃহিনী বলেন, গরিব মানুষের জন্য রোজার মাস কষ্টের। রোজার মাসকে কেন্দ্র করে জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়ে গেছে, সেভাবে তার আয় বাড়েনি।
পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার জন্য খুচরা ব্যবসায়ীরা চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি পাইকারি ব্যবসায়ীদেরকে দায়ী করছেন; আর পাইকারি ব্যবসায়ীরা দাম বেড়ে যাওয়ার জন্য পণ্যের ঘাটতি ও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন।
রাজধানীর বাজারগুলোয় গতকাল একদিনের ব্যবধানে ব্রয়লার ও লাল লেয়ার মুরগির দাম কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা। আর কক মুরগির দাম কেজিতে বেড়েছে ৩০ টাকা পর্যন্ত। শুক্রবার রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকায়। লেয়ার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা থেকে ২২০ টাকায়। আর কক মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৬০ টাকা থেকে ২৭০ টাকায়।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলছেন, দুদিন পরেই শবে বরাত। এ কারণেই মুরগির দাম বেড়েছে। ব্রয়লার বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা কেজি। অবশ্য শবে বরাতকে সামনে রেখে মুরগির দাম বাড়লেও পেঁয়াজের দাম কেজিতে কমেছে ২০ টাকা। এখন ভালো মানের দেশি পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩২ থেকে ৩৫ টাকায়। একইভাবে ফার্মের মুরগির ডিম ডজন বিক্রি হচ্ছে ৯০-৯৫ টাকায়। দেশি রসুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। জিরা পাওয়া যাচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি।
রাজধানীর বাজারগুলোতে বেড়েছে সবজির দামও। সজনে ডাটার দাম এখন ১০০ টাকা কেজি, শশার দাম ৫০ টাকা, পটল ও ঢেঁড়সের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। পাকা টমেটোর কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২৫ টাকা। শিমের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। বরবটির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। বেগুনের কেজি ৩০ থেকে ৪০ টাকা, পেঁপের কেজি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, গাজরের কেজি ২০ থেকে ৩০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। ফুলকপি ও বাঁধাকপির পিস বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ টাকা। লাউ বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ টাকা পিস। ব্যবসায়ীদের বক্তব্য চাহিদা থাকলে পণ্যের দাম বাড়বেই। সে সুযোগ নিচ্ছেন কিছু মুনাফাখোর ব্যবসায়ী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন