শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

খাগড়াছড়িতে বাঁশের সঙ্কট

খাদ্যে পরিণত হওয়ায় বংশবৃদ্ধি ব্যাহত

মো. ইব্রাহিম শেখ, খাগড়াছড়ি থেকে : | প্রকাশের সময় : ২৮ মার্চ, ২০২১, ১২:০১ এএম

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী পাহাড়িদের অন্যতম জনপ্রিয় সুস্বাদু খাবার ‘বাঁশকোড়ল’। খাগড়াছড়িতে বাঁশ বন থাকায় একেবারেই সহজলভ্য বাঁশকোড়ল। মারমারা একে ‘মহ্ই’ আর ত্রিপুরারা ‘মেওয়া’ বলে। আর চাকমাদের ভাষায় বাঁশকোড়লকে বলা হয় ‘বাচ্চুরি’।
বাঁশ কোড়ল বর্তমানে শুধু পাহাড়িদেরই প্রিয় খাবার নয়। অন্যরকম স্বাদের জন্য এটি এখন বাঙালিদের কাছেও জনপ্রিয়। পাহাড়ি এলাকায় ঘুরতে আসা পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণই হচ্ছে বাঁশ কোড়ল। এছাড়াও আন্তর্জাতিকভাবে এটি খুব জনপ্রিয় একটি মজাদার খাবার। চীন, ভারত, জাপান, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডসহ অনেক দেশে এই খাবারের প্রচলন থাকায় চাহিদাও বেশি। খাবারটি জাপানে ‘তেকেনাকো’, চীন ও থাইল্যান্ডে ‘ব্যাম্বো স্যুট’, মিয়ানমারে ‘মায়াহেট’, নেপালে ‘থামা’, ভারতের আসামে ‘বাঁহ গাজ/খবিচা’, এবং ইন্দোনেশিয়ায় ‘রিবাং’ নামে পরিচিত।

খাবার হিসেবে বাঁশকরুল (বাঁশের নরম অংশ) ব্যাপক ব্যবহারের কারণে ধ্বংসের মুখে পার্বত্য খাগড়াছড়ির মূল্যবান বাঁশ সম্পদ। এতে সরকার প্রতি বছর বাঁশ থেকে যেমন কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। তেমনি বাঁশ সম্পদের মূলজাতও ধ্বংস হচ্ছে। অথচ এই বনজ সম্পদ সুরক্ষায় কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না পার্বত্য বন বিভাগ। বর্ষা মৌসুমে খাগড়াছড়ি জেলার ৫০টি বড় বাজারে ১৫ থেকে ২০ লাখ পিস বাঁশকরুল সবজি হিসেবে বিক্রি হয়। সবজি হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করা গেলে ছয় মাস পরে এই খাত থেকেই পাওয়া যেত ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা।

খাগড়াছড়ি পরিবেশ আন্দোলন ফোরামের সভাপতি মো. রবিউল ইসলাম ইনকিলাবকে জানান, পার্বত্য এই জেলার বিভিন্ন পাহাড়ে প্রাকৃতিকভাবেই উৎপাদিত হয় মুলি, ওড়াল, ডুলু ও মিতিঙ্গাসহ বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ। জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত সাধারণত বাঁশের বংশবৃদ্ধির সময়। আর বন বিভাগ বছরের এই সময়ে সব ধরনের বনাঞ্চল থেকেই বাঁশ সংগ্রহ নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে স্থানীয় পাহাড়ি এবং বাঙালিরা বাঁশকরুল খাবারের জন্য সংগ্রহ করে।

পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, জেলায় ছোট-বড় কমপক্ষে ৫০টি বাজারে তিন মাসজুড়ে বন বিভাগ ও প্রশাসনের নাকের ডগায় বাঁশকরুল বিক্রি হয়। তিন মাসে প্রতি সপ্তাহে প্রতিটি বাজার দু’বার করে প্রায় ১ হাজার ৩০০ বার বসে। প্রতি বাজারে ১০০ থেকে ১৬০ কেজি করে বাঁশকরুল বিক্রি হয়। এ হিসাবে তিন মাসে বিক্রি হয় প্রায় দেড় লাখ থেকে দুই লাখ কেজি।

প্রতি কেজিতে ১০টি বাঁশকরুল হিসেব করলে বিক্রি করা বাঁশকরুলের সংখ্যা হয় কমপক্ষে ১৫ লাখ থেকে ২০ লাখ পিস। যা মাত্র ছয় মাস পরে রাঙামাটির চন্দ্রঘোনা পেপার মিলে কাঁচামাল হিসেবে বিক্রি করলেও আয় হতো চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা। কিন্তু স্থানীয় নৃগোষ্ঠীর লোকেরা এমন হিসাবের বিপক্ষে। তারা খাদ্য হিসেবে বাঁশকরুল সংগ্রহের পক্ষে।

এ বিষয়ে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার পেরাছড়া গ্রামের আপনা চাকমা বলেন, বাঁশকরুল তাদের প্রিয় খাবার। অনেক পাহাড়ি পরিবারের জীবন-জীবিকা এর উপর নির্ভর করে। সদর উপজেলার নয় মাইল এলাকার সুধীর ত্রিপুরা বলেন, এই মৌসুমে গাছ-কাঠ না থাকায় অনেক কষ্ট করে তারা গভীর জঙ্গল থেকে বাঁশকরুল সংগ্রহ করেন। এছাড়া তাদের বিকল্প কিছু করার নাই।

স্থানীয় বেসরকারি তৃণমূল উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রিপন চাকমা বলেন, সরকারি উদ্যোগে বাঁশ সম্পদ সংরক্ষণের জন্য বছরের তিনমাস জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেই হবে না। বাঁশের বংশবৃদ্ধির মৌসুমে রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা হলে বাঁশ ধ্বংসের প্রবণতা হ্রাস পাবে।

খাগড়াছড়ি বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মমিনুর রশীদ ইনকিলাবকে বলেন, বাঁশ সংরক্ষণের জন্য তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা তো রয়েছে। কিন্তু বাঁশকরুল পাহাড়ের বাসিন্দাদের জনপ্রিয় খাবার হওয়ায় বংশবৃদ্ধির মৌসুমে শতভাগ বন্ধ করা যাচ্ছে না। তারপরও যাতে নির্বিচারে বাঁশকরুল সংগ্রহ এবং বাজারে বিক্রি করা না হয়, সেজন্য বন বিভাগের পক্ষ থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন