বিশেষ সংবাদদাতা : গাবতলী হাটে একটা স্থানকে ঘিরে লোকজনের উপচেপড়া ভিড়। হাটে আসা লোকজন একবারের জন্য হলেও সেদিকে উঁকি দিচ্ছেন। চিড়িয়াখানার কোনো দর্শনীয় প্রাণ নয়, উৎসুক মানুষের ভিড় বিরাট আকারের একটি গরুকে ঘিরে। ছবি আর সেলফি তুলতে ব্যস্ত অনেকে। নাম তার জর্দান। দাম হাঁকা হয়েছে ১১ লাখ টাকা। গাবতলী হাটে ওঠা গরুর মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ দাম। কুষ্টিয়া থেকে আনা হয়েছে গরুটি। মালিক নজরুল ইসলাম জর্দা জানান, নিজের নামের সাথে মিল রেখে তিনি গরুটির নাম রেখেছেন জর্দান। তিনি বলেন, গত বছর আমি ওকে সাড়ে ৪ লাখ টাকায় কিনেছি। তার পর থেকে খুব যতেœ লালন-পালন করছি। গত বছর যখন গরুটি কিনি তখন এর বয়স ছিল ১ বছর ৭ মাস। তারপর থেকে প্রতিদিন প্রায় দুই কেজি গমের ভুসি, আড়াই কেজি ছোলা ভিজানো খাওয়াচ্ছি। পাশাপাশি সরিষার খৈল, ধানের কুঁড়া, ভুসি খাওয়ানো হয় ওকে। এক বছরে জর্দানের পেছনে প্রায় আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে দাবি করে নজরুল ইসলাম বলেন, আমি ওর দাম নির্ধারণ করেছি ১১ লাখ টাকা। অনেকেই ওর দাম ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত বলেছে। কিন্তু আমি বিক্রি করিনি। আমি যে দাম বলেছি, সেই দামে তো আর বিক্রি করা যাবে না। একটু কম-বেশি হবে। এটা আসলে পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে। কমলাপুর হাটে এক জোড়া গরুর দাম হাঁকা হয়েছে ১৬ লাখ টাকা। মেহেরপুর থেকে আনা হয়েছে গরু দুটো। ব্রাদার্স ক্লাবের পূর্বে সাদেক হোসেন খোকা কমিউনিটি সেন্টারের পাশে লাল ও সাদা রঙের বড় সাইজের গরু দুটোকে ঘিরে উৎসুক মানুষের ভিড়। মালিক মহিবুর রহমান জানান, ছয় দাঁতের গরু দুটির মধ্যে লাল গরুটি নেপালি জাতের। আর সাদাটি দেশী। ১০ মাস ধরে গরু দুটি তিনি লালনপালন করছেন বলে জানান। ১৬ লাখ টাকার বিপরীতে গতকাল বুধবার পর্যন্ত গরু দুটির দাম উঠেছে ১১ লাখ টাকা। মহিবুরের বিশ্বাস, ১৬ লাখ টাকায় বিক্রি করতে না পারলেও বাকি দিনগুলোতে গরু দুটির দাম আরও উঠবে। সেই পর্যন্ত তিনি দেখবেন।
ঈদুর আজহা উপলক্ষে রাজধানীর কোরবানির হাটগুলো জমে উঠেছে। এরই মধ্যে হাটগুলো কোরবানির পশুতে অনেকটাই ভরে গেছে। সাধারণ পশুর চেয়ে বেশি দামের গরু-ছাগলের প্রতি মানুষের আগ্রহ এবারও চোখে পড়ার মতো। গাবতলী হাটে জর্দান ছাড়াও ১০ লাখ টাকা দামের উটকে ঘিরে মানুষের ভিড় লক্ষ করা গেছে। পাইকার সমিতির সভাপতি মজিবর রহমান জানান, কোরবানিকে টার্গেট করে বেশ কিছুদিন আগে থেকে গাবতলী হাটে উট আনা হয়েছে। গত মাস থেকে ৫/৬টি উট হাটে আছে। ঈদকে কেন্দ্র করে আরও নতুন নতুন উট এসেছে। সেগুলোর দাম হাঁকা হচ্ছে ৮ থেকে ১২ লাখ টাকা। গাবতলী হাটে বড় সাইজের ছাগল এখনও ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি বলে জানিয়ে মজিবর রহমান বলেন, দু-এক দিনের মধ্যে অবশ্যই দামি ছাগল উঠবে। গাবতলী হাটে দেশী-বিদেশী নানা জাতের গরুর ভিড়ে আরও একটি গরু আলোচনায় এসেছে। নেপালি হরিণা গরুটি দেখতে অবিকল চিত্রাহরিণের মতো। মাঝারি সাইজের গরুটির সারা শরীরই লাল রঙের মধ্যে গোলগোল সাদা ছাপে ভরা। ছিমছাম শরীরে পেটের দিকটা চাপা আর মাথার সাইজ কিছুটা লম্বাটে ও ছোট। মালিক মানিকগঞ্জের বাগবাড়িয়ার জয় মাহমুদ। তিনি জানান, গরুটির বয়স চার বছর। গত বছর মোহাম্মদপুরের খামারি ইমরান হোসেন গরুটি লালমনিরহাটের এক গরু ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কিনে নেন। তিনি জানান, খামারে এক বছর লালনপালনের পর কোরবানি উপলক্ষে এবার হাটে তুলেছেন। এরই মধ্যে প্রতিদিনই গরুটি দেখতে প্রচুর দর্শনার্থী ভিড় করছেন। জয় জানান, অবিকল হরিণের মতো দেখতে মাঝারি সাইজের হরিণা গরুটির দাম হাঁকানো না হলেও উৎসাহী ক্রেতারা নিজে থেকেই দেড় লাখ থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত দাম করছেন।
গতকাল রাজধানীর কয়েকটি কোরবানির হাট ঘুরে ইজারাদারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ঈদের আগের রাত পর্যন্ত কোরবানির পশু আসতেই থাকবে। বিশেষ করে এবার গরুর কোনো কমতি থাকবে না। রাজধানীর গাবতলী, যাত্রাবাড়ী, কমলাপুর ও দনিয়া হাট ঘুরে দেখা গেছে, গতকাল বুধবার পর্যন্ত যে হারে দাম হাঁকা হয়েছে তাতে গতবারের তুলনায় এবার বেশি দাম হাঁকছেন পাইকাররা। আলাপকালে কয়েকজন ক্রেতা জানান, তারা যে গরুর দাম ৪৫ থেকে ৫০-এর মধ্যে আন্দাজ করে রেখেছেন, সেই মধ্যম সাইজের গরুর দাম হাঁকা হচ্ছে ৬০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা। ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা যেসব গরুর দাম চাওয়া হচ্ছে সেগুলো একেবারে ছোট সাইজের। ছাগলের দাম আরও বাড়তির দিকে জানিয়ে যাত্রাবাড়ী হাটের একজন ক্রেতা বলেন, একটু বড় সাইজের একটা ছাগলের দাম হাঁকা হয়েছে ১৮ হাজার টাকা, যার দাম সাধারণ বাজারে ১২ হাজার টাকার ওপরে হবে না। তবে বেশিরভাগ ক্রেতাই মনে করেন, ঈদ যত ঘনিয়ে আসবে দাম তত কমবে। এখন ক্রেতার তুলনায় দর্শনার্থীর সংখ্য বেশি বলে পাইকাররা যথেচ্ছ দাম হাঁকছেন। পুরোদমে বিক্রি শুরু হলে দাম অনেকটাই কমে যাব। দনিয়া হাটের একজন স্বেচ্ছাসেবক জানান, গত দু’দিন ধরে একটি গরুর দাম আড়াই লাখ টাকা দাবি করেছেন এর মালিক। দনিয়া কলেজের সামনে সাদা রঙের গরুটি বড় সাইজের। গতকাল দাম কমিয়ে এর দাম দুই লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত দাম উঠেছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। ওই স্বেচ্ছাসেবক জানান, এখন এরকমই দাম চাচ্ছে পাইকাররা। তার ভাষায়, দাম চাইতে তো পয়সা লাগে না, ট্যাক্সও দিতে হয় না। যার যেমন খুশি দাম চাচ্ছে। কিন্তু বিক্রির দাম আলাদা। বিক্রি করতে হলে দামের মতো দাম চাইতে হবে। তা না হলে কোনোভাবেই বিক্রি করা যাবে না। এসব কথা পাইকাররা ভালো করেই জানে।
ভারতীয় গরু নেই, তবুও বাজারে পর্যাপ্ত গরু
কোরবানির হাটের ইজারাদার, পাইকার, ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এবার ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু আসা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও কোরবানির ঈদের এক সপ্তাহ আগেই হাটে যথেষ্ট গরু রয়েছে। বিবিসি জানায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর ঈদুল আজহার সময় ৮০ লাখের মতো গরুর দরকার হয়। যার চার ভাগের এক ভাগ অবৈধভাবে ভারত থেকে আসত। কিন্তু দু’বছর ধরে সীমান্তের ওপার থেকে ভারতীয় গরু আসা বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশে গরুর ব্যবসায়ী ও খামারিরা বলছেন, এ কারণে দেশের ভেতরেই প্রচুর খামার গড়ে উঠেছে যেখান থেকে চাহিদা মেটানো হচ্ছে। খামারি ও গরুর ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে খামারের সংখ্যা ও গরুর উৎপাদন অনেক বেড়েছে এবং দেশের ভেতরের সরবরাহ থেকেই কোরবানির চাহিদা মেটানো সম্ভব। কোরবানির পশুর বাজার নিয়ে গবেষণা করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বিবিসিকে বলেন, দেশের ভেতরে সরবরাহ বাড়ায় দামের ওপর চাপ ক্রমান্বয়ে কমে আসছে। প্রতিবছর ভারত থেকে বিশ লাখের মতো গরু আসত। আর আমাদের দেশে কোরবানির ঈদে আশি লাখের মতো গরু প্রয়োজন হয়। গত বছর থেকে ভারতের গরু আসা বন্ধ হওয়ায় মাংসের দাম বেড়েছে। ফলে মানুষ উৎসাহিত হয়ে খামার করছে। দেশের ভেতরে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় গরুর দামের ওপর চাপ কমে আসছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন