গত বছর দেশে করোনা মহামারি শুরুর আগে থেকেই বেসরকারি খাতে ঋণের গতি ছিল একেবারেই মন্থর। বৈশ্বিক মহামারি করোনায় মাসের পর মাস ধরে যোগাযোগব্যবস্থাসহ ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যত ছিল বন্ধ। করোনা ডামাঢোলে উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে না আসায়, ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া আরো নিম্নমুখী হয়ে পড়ে। কারণ উদ্যোক্তাদের নতুন বিনিয়োগের পরিস্থিতি নেই। প্রণোদনার অর্থ বিতরণের পরও বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে কাক্সিক্ষত মাত্রার প্রায় অর্ধেকে। ৬ মাসে ব্যাংক খাত থেকে ঘোষণা অনুযায়ী মাত্র ৫৯৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। বিনিয়োগ মন্দায় ঋণ নেয়ার লোক পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। আর তাই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে দিন দিন বাড়ছে অলস টাকার পাহাড়। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতে তৈরি হয়েছে ইতিহাসের সর্বোচ্চ অলস তারল্যের স্তূপ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগযোগ্য অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। এখন বছরের প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) হিসাব প্রকাশ করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এই সময়ে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ আরো বেড়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। অথচ গত এক বছর আগেও তীব্র তারল্য সঙ্কটে ভুগছিল বেশিরভাগ ব্যাংক। নগদ জমা সংরক্ষণের হার (সিআরআর) ও সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদ (এসএলআর) সংরক্ষণেই হিমশিম খাচ্ছিল বেসরকারি ব্যাংকগুলো তারল্যের সংস্থান করতে বেশি সুদে অন্য ব্যাংকের আমানত বাগিয়ে নেয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। আর এখন এর ঠিক উল্টো চিত্র ব্যাংকগুলোতে। বেশিরভাগ ব্যাংক আমানতের সুদহার কমিয়ে ৪ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছে। একই সঙ্গে সময়ের পরিবর্তনে এখন ঋণ বিতরণ বাড়াতে ‘ইন্টারনাল ক্রেডিট রিস্ক রেটিং বা আইসিআরআর’ নীতিমালা শিথিল করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া বাধ্য হয়ে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ও বিকল্প বিনিয়োগকে উৎসাহিত করছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনা বাড়ায় নতুন ঋণ নেয়ার মতো পরিস্থিতি আরও পিছিয়ে গেল। দীর্ঘদিন বিনিয়োগ না হওয়ায় পুঞ্জীভ‚ত এই অর্থ ব্যাংকগুলোকে ভোগান্তিতে ফেলেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার বিষযটিও করোনা মহামারির ওপর নির্ভর করছে। আর আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতিতে অনেক খাতের পণ্য ও সেবার চাহিদা কমে গেছে। নতুন বিনিয়োগ দূরে থাক, বিদ্যমান উৎপাদনের সক্ষমতারও পুরোপুরি ব্যবহার হচ্ছে না। এটা অর্থনীতির জন্য মোটেও ভালো লক্ষণ না। কারণ অর্থনীতিতে স্বাভাবিক গতি বজায় থাকলে এই অর্থ বিনিয়োগ হতো। এ অবস্থায় বেসরকারি খাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি সিএসএমই খাতের ঋণের জন্য কাঠামোগত সংস্কার দরকার বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে থেকেই বেসরকারি ঋণের গতি ছিল মন্থর। করোনার পর থেকে তা আরো নিম্নমুখী হয়ে পড়েছে। কারণ উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছেন না। ফলে মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী আমদানিও কমছে। এর মানে উৎপাদনের যে সক্ষমতা রয়েছে, সেটার পুরোপুরি ব্যবহার হচ্ছে না। এসব কারণে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদাও কম। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর হাতে অতিরিক্ত তারল্য ও অলস টাকা বেড়ে গেছে। এটা অর্থনীতির জন্য মোটেও ভালো লক্ষণ না।
সূত্র মতে, দেশে করোনা সংক্রমণের ভীতি মাঝে কিছুটা কাটলেও গত মাস থেকে পরিস্থিতি আবার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ফলে অনিশ্চয়তা থেকে নতুন বিনিয়োগে ঝুঁকি নিতে চাইছেন না কেউ। এতে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ ব্যাংকের হাতে অলস টাকা পড়ে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছর ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে কোনো ধরনের বিনিয়োগে নেই এমন অর্থের পরিমাণ (অলস টাকা) প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। গত তিন মাসের ব্যবধানে অলস টাকা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। যদিও ডিসেম্বর পরবর্তী তিন মাসের হিসাবে এই অংক আরও বেড়েছে। সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশি সব খাতের ব্যাংকেই অলস টাকা পড়ে আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মতে, করোনা সংক্রমণ শুরু হলে অর্থনীতিতে চাহিদা বাড়াতে বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়ানো হয়। আবার করোনার মধ্যে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স এসেছে অনেক বেশি। ব্যাংকের আমানত সংগ্রহেও ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু প্রণোদনা ঋণের বাইরে দীর্ঘদিন নতুন ঋণের চাহিদা নেই। সব মিলিয়ে ব্যাংকের হাতে উদ্ধৃত তারল্য ও অলস টাকা বেড়েছে। নতুন করে আবার করোনা ভয়াবহ রূপ ধারণ করায় অলস টাকার পরিমাণ আরও বাড়বে বলে উল্লেখ করেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ লাখ ৪ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯৮ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা ছিল বেসরকারি ব্যাংকগুলোর। সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর কাছে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ৮৩ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। আর ২২ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্য জমা হয় বিদেশি ব্যাংকগুলোর হাতে। এর তিন মাসে আগে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। আর গত তিন মাসের ব্যবধানে অতিরিক্ত তারল্য বেড়েছে প্রায় ৩৫ হাজার ৮৮ কোটি টাকা। অন্যদিকে একই সময়ে ব্যাংকগুলোর হাতে পড়ে থাকা অলস টাকার পরিমাণও বেড়েছে। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে অলস টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। এই অংক অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি, তিন মাস আগে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যা ছিল ২১ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা। করোনা প্রাদুর্ভাব শুরুর আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে অলস টাকার পরিমাণ ছিল মাত্র- ৬ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ আরো বেড়েছে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাধারণ সম্পাদক ও দি সিটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, করোনার কারণে সব কিছু ধীর হয়ে গেছে। নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। অতিরিক্ত তারল্য ব্যাংক খাতকে এখন কষ্ট দিচ্ছে। যেভাবে আমানত আসছে, ঠিক সেই তুলনায় নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। তার মতে, নতুন বিনিয়োগের জন্য আমাদের আন্তরিকতার অভাব না থাকলেও দেশে করোনার কারণে এ মুহূর্তে বড় কোনও শিল্প উদ্যোগ নেই বললেই চলে। ভালো ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগের ঝুঁকি নিতে চাইছেন না বলেও জানান তিনি।
বেসরকারি খাতের ঋণের সাম্প্রতিক গতিধারা এবং শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কমে যাওয়ার পরিসংখ্যানেও বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার বিষয়টি প্রতিফলিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছরের ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বেসরকারি খাতে ঋণ বেড়েছিল মাত্র ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। এটি গত আট বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ছিল। চলতি অর্থবছরেও বেসরকারি খাতের ঋণে শনিরদশা চলছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সাড়ে ১১ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এটি স্মরণকালের সর্বনিম্ন। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ৩৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ। কারখানা সম্প্রসারণ, সংস্কার ও নতুন কারখানা স্থাপনের জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়। শুধু মূলধনী যন্ত্রপাতিই নয়, এ সময়ে শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি কমেছে প্রায় ১৬ দশমিক ২২ শতাংশ। এ ছাড়া শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমেছে ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
এ ছাড়া করোনার ক্ষতি পোষাতে সরকার ঘোষিত বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলো যাতে সঙ্কটে না পড়ে, সে জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেশ কয়েকটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন এবং বিদ্যমান তহবিলের আকার বাড়ানো হয়েছে। এর আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৫১ হাজার কোটি টাকার মতো তহবিলের জোগান পায় ব্যাংকগুলো। এছাড়া সিআরআর দুই দফায় দেড় শতাংশ কমিয়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে আরো ১৯ হাজার কোটি টাকা নতুন করে ঋণ দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করে ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি ব্যাংকে তারল্য বাড়াতে তিন দফায় রেপো রেট কমিয়ে ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে। চালু করা হয়েছে এক বছর মেয়াদি বিশেষ রেপো। ১৭ বছর পর ব্যাংক রেট ১ শতাংশ কমিয়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে। অন্যদিকে করোনার সময় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে চাঙ্গাভাব অব্যাহত আছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে কয়েক মাস ধরে বাজার থেকে প্রচুর ডলার কিনছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ডলার কেনা বাবদ নগদ টাকাও ব্যাংকের হাতে যাচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, করোনার কারণে মানুষের মধ্যে বিনিয়োগের আগ্রহ কম। তিনি বলেন, বিনিয়োগ না করে শুধু ব্যাংকে টাকা জমা করে লাভ নেই। তবে আগে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ব্যবসায়ীদের টাকা ফেরত দেয়ার মতো সুযোগ দিতে হবে।
উল্লেখ্য, বিদায়ী অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে তারল্যের জোগান দিয়েছে ৫ লাখ ৫৪ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। রেপো, স্পেশাল রেপো ও অ্যাসুরেড লিকুইডিটি সাপোর্ট (এএলএস) হিসেবে এ অর্থ দেয়া হয়। পাশাপাশি প্রণোদনা হিসেবেও প্রায় এক লাখ কোটি টাকার অর্থ জোগান দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জোগান দেয়া এই অর্থও অতিরিক্ত তারল্য সৃষ্টির পেছনে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন