সায়ীদ আবদুল মালিক : নির্ধারিত সময়ের আগেই বেচাকেনা শুরু হয়ে গেছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের আস্থায়ী কোরবানির পশুর হাটে। ইজারা নিয়মমতে ঈদের দিনসহ চার দিনের অনুমোদন দেয়া হলেও এবারের কোরবানির হাটে বেচাকেনা শুরু হয়ে গেছে তার দু-তিন দিন আগে থেকেই, যদিও হাটগুলো এখনও তেমন একটা জমে ওঠেনি। ঈদুল আজহার আরও চার দিন বাকি। ঢাকা শহরের মানুষ এত আগে কোরবানির পশু না কিনলেও পরিবারের ছোট-বড় সদস্যরা দলবেঁধে এ হাট ওই হাট ঘুরে কোরবানির পশু দেখেন। দরদাম বোঝার চেষ্টা করেন। রাজধানীর অস্থায়ী হাটগুলোতে গরু, মহিষ, উট, ছাগল ও ভেড়াসহ পর্যাপ্ত কোরবানির পশু ইতোমধ্যে উঠে গেলেও বেচাকেনা কম। হাটগুলোতে এখন ক্রেতার চেয়েও দর্শনার্থী বেশি।
বিক্রেতারা বলছেন, হাটে এখন যারা আসছে তারা শুধু দাম জেনেই চলে যাচ্ছে। কেউ কিনছে না। তবে আগামীদিন থেকে ক্রেতা পাওয়া যাবে। বেচাকেনার সময় এখনও হয়নি। আগামী দু-এক দিনের মধ্যে হাট পুরোপুরি জমে উঠবে বলে প্রত্যাশা তাদের।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পুরান ঢাকার ধোলাইখাল সংলগ্ন সাদেক হোসেন খোকা মাঠ হাটের গরু মাঠের বাইরে চলে গেছে। ধোলাইখাল সড়কের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে প্রধান কাউন্টার মঞ্চ। সড়কে গর্ত করে স্থাপন করা হয়েছে বাঁশের খুঁটি। এসব খুঁটিতে পশু বাঁধা হয়েছে। অর্থাৎ নির্ধারিত সীমানা ছাড়িয়ে হাট সম্প্রসারিত হয়েছে সড়কজুড়ে। স্থানীয়দের অভিযোগ, বেপরোয়া ইজারাদার কিছুতেই মাঠের মধ্যে তার হাটটি সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছেন না। গতবারের মতো এবারও প্রধান সড়কের ওপর হাট বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে যথারীতি ভয়াবহ যানজটের আশঙ্কা করছেন এলাকার বাসিন্দারা।
কলতাবাজারের বাসিন্দা তোরাব আলী বলেন, ইজারাদাররা অত্যন্ত প্রভাবশালী। সিটি কর্পোরেশনের কোনো শর্তই তারা মানছে না। এ কারণে এলাকার মানুষও কিছু বলছে না। মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করছেন তারা। মানুষের এ দুর্ভোগ লাঘবে সিটি কর্পোরেশন লোকদেখানো তৎপরতা ছাড়া কিছু করতে পারছে না।
হাটের সীমানা নিয়ে এই অরাজকতা শুধু ধোলাইখালেই নয়, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ২২টি অস্থায়ী হাটের অধিকাংশেই এ অবস্থা বিরাজ করছে। দনিয়া হাটটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বসানো হলেও এটাকে মহাসড়কের ওপর নিয়ে আসার পাঁয়তারা চলছে। কমলাপুর বক্স কালভার্ট সড়ক বন্ধ হয়ে গেছে। কমলাপুর থেকে মুগদা স্টেডিয়াম পর্যন্ত প্রধান সড়কের দু’ধারে গরু বাঁধার আয়োজন চলছে। পোস্তগোলায় শ্মশানঘাট থেকে বুড়িগঙ্গার পাড় ধরে সদরঘাটের দিকে যাওয়া সড়কের বেশির ভাগ বন্ধ হয়ে গেছে। গরু রাস্তায় চলে এসে শ্যামপুর হাটেরও। অন্যদিকে উত্তরা আবাসিক এলাকার হাটটি সীমানা ছাড়িয়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়ছে। বাড্ডা ও ভাটারার হাটও ঢুকে পড়েছে অলিগলিতে।
যোগাযোগ করা হলে পোস্তগোলা হাটের কর্মকর্তা মোহাম্মদ চিশতি বলেন, আমাদের হাট কখনও রাস্তা দখল করেনি। নির্ধারিত সীমানার মধ্যেই আছে। তবে সাদেক হোসেন খোকা মাঠ হাটের এক প্রতিনিধি বলেন, এত গরু আসছে। এগুলো দাঁড়াবে কোথায়? বেপারিদের চাহিদার কারণেই কিছু গরু রাস্তায় রাখা হয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ খালিদ আহম্মেদ বলেন, ইজারার শর্ত অনুযায়ী কোনো হাটই নির্ধারিত সীমানার বাইরে যেতে পারবে না। এজন্য আমাদের মোবাইল কোর্ট তৎপর রয়েছে। গতকাল বিকালে মোবাইল টিম অভিযান চালিয়ে দনিয়া ও শ্যামপুর হাটের গরু প্রধান সড়ক থেকে সরিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, ধোলাইখালসহ পুরান ঢাকার হাটগুলো আগামীদিন পরিদর্শন করা হবে। অনিয়ম পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রাজধানীতে এবার ২২টি অস্থায়ী হাট বসছে। এগুলোর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনায় ১৪টি ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনায় রয়েছে আটটি। এছাড়া ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে রয়েছে একটি করে দুটি স্থায়ী হাট। এগুলোতে এখনও কেনাবেচা জমে ওঠেনি বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
উত্তর সিটির স্থায়ী ও দেশের সবচেয়ে বড় পশুহাট গাবতলিতে গতকাল গিয়ে দেখা যায়, ট্রাক-পিকআপে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে গরু-মহিষ, উট, ছাগল ও ভেড়া আসছে। তবে হাট এখানো জমে ওঠেনি। ক্রেতার উপস্থিতিও খুবই কম। গোশত ব্যবসায়ীরাই কেবল গরু-ছাগল কিনছেন। এছাড়া কুমিল্লা, সিলেটসহ বাইরের জেলার ব্যবসায়ীরাও এ হাট থেকে গরু কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
হাটটির ইজারাদার লুৎফর রহমানের ছেলে রাকিব ইমরান জানান, হাট এখনো জমেনি। তবে দু-এক দিনের মধ্যেই জমবে বলে আমরা আশা করছি। হাট ঘুরে দেখা যায়, পুরো হাটে দেশী গরুর আধিপত্য। ভারতীয় গরুর পরিমাণ খুবই কম। তবে এর বেশিরভাগই গত পাঁচ-ছয় মাস আগে খামারীরা ও ব্যবসায়ীরা দেশে এনে লালনপালন করে বড় করেছেন। গরু ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম বলেন, বর্তমানে কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে দিনে দেড় থেকে দুই হাজার ভারতীয় গরু আসছে। এছাড়া আর কোন সীমান্ত দিয়ে গরু আসছে না। ভারত থেকে আসা গরুর অধিকাংশই বিভিন্ন জেলা ও রাজধানীর অন্য হাটে চলে যাচ্ছে। গাবতলী হাটে আসছে খুবই কম। হাটগুলোতে ক্রেতা তেমন না থাকলেও খামারিরা দেশী গরুর দাম হাঁকাচ্ছে বেশি। মাঝারি সাইজের গরু ৬৫ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা, বড় গরু আড়াই লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত চাওয়া হচ্ছে। তবে ছোট সাইজের গরুও হাটে আসছে। এর দাম ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা চাওয়া হচ্ছে।
গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত গাবতলী হাট ঘুরে দেখা যায়, সারি সারি গরু-ছাগল নিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় রয়েছেন বিক্রেতারা। হাটে নিয়ে আসা পশুকে খাওয়ানো ও দেখভালের মধ্য দিয়েই সময় কাটছে তাদের। কুষ্টিয়া থেকে গরু নিয়ে আসা আমির হোসেন বলেন, ‘আমরা নিজেগের চাইতে এই গরুর যতœ বেশি নেই।
মেহেরপুরের খামারি সাইরাজ উদ্দিন ও আলমগীর হোসেন জানান, দেশী গরুর কোনো সঙ্কট নেই। দেশে যে গরু আছে তা দিয়েই চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে। দেশী গরুর দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তারা বলেন, এখন গরু লালন-পালনের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। ঢাকায় আনতে গরু প্রতি ট্রাক ভাড়া দিতে হয় ২/৩ হাজার টাকা। তাছাড়া গত তিন বছর ধরে খামারিরা ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। এ কারণে এবার পুষিয়ে নিতে দাম একটু বেশি চাওয়া হচ্ছে। তবে ভারতীয় গরু আসা নিয়ে শঙ্কার কথা জানান তারা। বর্তমানে ভারতীয় গরু কম আসছে জানিয়ে তারা বলেন, গত কয়েক বছর দেখা গেছে, ঈদের দু-এক দিন আগে হঠাৎ করেই ভারত সীমান্ত খুলে দেয়। তখন দেশী গরুর দাম পড়ে যায়। এতে আর্থিক ক্ষতির শিকার হন খামারিরা।
হাটে উট, মহিষ ও ছাগলের সরবরাহও আছে। তবে বিক্রি তেমন হচ্ছে না বলে জানান ব্যবসায়ী খবির হোসেন। যা দু-একটি বিক্রি হচ্ছে তার অধিকাংশই কিনছেন গোশত ব্যবসায়ীরা বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ গোশত ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম জানান, দেশে প্রতি বছর এক কোটি ২৫ লাখের মতো গরু জবাই হয়। এর মধ্যে ৬৫ লাখ কোরবানির সময়। আর বাকি ৬০ লাখ জবাই হয় সারা বছর ধরে। এছাড়া কোরবানির সময় ৫০ লাখের মতো ছাগল জবাই হয়ে থাকে। তিনি বলেন, দেশে ভারতীয় গরুর কোনো প্রয়োজন নেই। বিকল্প হিসেবে মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটান থেকে গরু আসছে। তাছাড়া দেশেই গরু উৎপাদন বাড়িয়ে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে।
এদিকে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন পশুর হাট ও আশপাশের এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান শুরু হবে আজ থেকে। হাটের পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা দেখার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতিও দেখবেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম বিভাগ থেকে জানা গেছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্ধারিত ২২টি অস্থায়ী ও দুটি স্থায়ী পশুহাটে শনিবার থেকে সাতজন ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকেও মনিটরিং সেল কাজ করবে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
হাট ঘুরে দেখা যায়, এবার ২০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে তিন লাখ টাকার মধ্যে বিভিন্ন রকম দেশী গরু পাওয়া যাচ্ছে। আর বিদেশী গরুর মধ্যে ভারতীয়, পাকিস্তানি, নেপালি, অস্ট্রেলিয়ান ও ফিজিয়ান গরুর উঠেছে বেশি। এ গরুগুলোর দাম সাধারণত আড়াই লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত হাঁকা হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন এসব গরু বিদেশী হলেও তা বাংলাদেশেই পালিত। বিদেশী গরুর বীজে স্থানীয়ভাবেই এ গরু জন্মানো হয়েছে।
দেশী-বিদেশী গরুর মালিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ বিক্রেতার বাড়ি কুষ্টিয়ায়।
এ ছাড়া, সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ায় সুবাদে কয়েক মাস আগে গরু আমদানি করে কোরবানিতে বিক্রির জন্য পালন করেন কুষ্টিয়ার ব্যবসায়ীরা। ফলে শুধু গাবতলী নয় দেশের প্রায় সব হাটেই এ জেলার গরু বেশি বলে জানান তারা।
হাটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত জোরালো দাবি করে সানোয়ার হোসেন বলেন, পর্যাপ্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়াও আমাদের নিজস্ব ৫০০ ভলান্টিয়ার আছে। এখানে কোনো ধরনের অসঙ্গতি হওয়ার কোনো কারণ নেই। বিক্রেতা ও ক্রেতারা স্বাচ্ছন্দ্যেই এখানে কেনাবেচা করতে পারবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন