সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : রামপালে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে সরকার ও পরিবেশবাদীদের দূরত্ব এখনও কমেনি, ঘটেনি বিতর্কের অবসান। বরং এই বিতর্ক আগের চেয়ে আরও তীব্র হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াও রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সমালোচনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকল সমালোচনার জবাব দিয়েছেন। এরপরও অসন্তÍুষ্ট পরিবেশবাদীরা। সংসদীয় কমিটির কাছে তারা তাদের অসন্তÍুষ্টির বিষয়টি জোরালোভাবেই তুলে ধরেন।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে পরিবেশের যে সমীক্ষা করা হয়েছে তা সঠিকভাবে করা হয়নি। তাদের মতে, শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে যে শিল্পায়ন গড়ে উঠবে তার কারণেও সুন্দরবনের অনেক ক্ষতি হবে। এছাড়া কয়লা পরিবহন নিয়েও সরকার বারবার নানা যুক্তি দিলেও বাস্তবে এ বিষয়ে কোনো সমীক্ষা হয়নি। তাদের মতে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল করে সুন্দরবন রক্ষা নীতিমালা করতে হবে।
তবে সরকার বলছে, যথাযথ নিয়ম মেনেই এখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে। সুন্দরবন রক্ষা করেই সব কাজ করা হবে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় রামপালই সব থেকে উত্তম জায়গা। তিনি বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তিতে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হবে। এতে সুন্দরবনের পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না।
গেল সপ্তাহে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক সংসদীয় কমিটির বৈঠকেও আলোচনা হয়েছে। এই বৈঠকে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতৃবৃন্দও উপস্থিত ছিলেন। তারা প্রকল্পটির তীব্র বিরোধিতা করেন। তবে সভায় বিদ্যুৎকেন্দ্র সংশ্লিষ্টরা তাদের পক্ষে নানা যুক্তি উপস্থাপন করেন।
রামপালে কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিদ্যুতের অব্যাহত চাহিদা মেটাতে বর্তমানের উৎপাদন সক্ষমতা ১৫ হাজার মেগাওয়াট থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াটে বাড়াতে হবে। সে কারণেই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি হচ্ছে। স্বল্প মেয়াদে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, কুইক রেন্টাল কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। দীর্ঘস্থায়ী বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় কয়লার ব্যবহার বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, চীন, জাপান, ভারত তাদের মোট বিদ্যুতের ৪০ থেকে ৯৮ শতাংশ উৎপাদন করে কয়লা দিয়ে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে কয়লা বিদ্যুতের পরিমাণ মাত্র ১ শতাংশের সামান্য বেশি।
স্থান হিসেবে রামপালকে নির্বাচনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য হচ্ছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রয়োজন সস্তা পরিবহন ব্যবস্থা। সেজন্য কয়লা খনির কাছাকাছি অথবা সমুদ্র উপকূল বা গভীরতাসম্পন্ন নদীর তীরে নির্মাণ করা হয়ে থাকে। আরেকটি বিবেচ্য দিক হচ্ছে যতদূর সম্ভব কম সংখ্যক মানুষকে স্থানান্তর করা। এসব দিক বিবেচানায় নিয়েই এখানে ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে।
আর পরিবেশবাদীদের মতে, রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশনের (এনটিপিসি) সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। চুক্তিটি দেশের জাতীয় স্বার্থকে রক্ষা করে করা হয়নি। তাদের মতে, রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি হবে দুই দেশের সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দুই দেশের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি নামে একটি কোম্পানিও গঠন করা হয়েছে। এই প্রকল্পের অর্থায়ন করবে মোট অর্থের ১৫ শতাংশ পিডিবি, ১৫ শতাংশ ভারতীয় পক্ষ আর ৭০ শতাংশ ঋণ নেয়া হবে। যে নিট লাভ হবে সেটা ভাগ করা হবে ৫০ শতাংশ হারে। তবে এই ঋণের গ্যারান্টার হবে বাংলাদেশ। আর উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনবে পিডিবি। বিদ্যুতের দাম নির্ধারিত হবে কয়লার দাম ওঠানামার ওপর ভিত্তি করে।
এ ব্যপারে সংসদীয় কমিটির কাছে আনু মুহম্মদ সুস্পষ্টভাবে বলেন, সুন্দরবনের ক্ষতি করে এমন কোনো কিছুই করা যাবে না। সুন্দরবন রক্ষায় নীতিমালা করতে হবে। এই নীতিমালার মাধ্যমে সুন্দরবনবিনাশী তৎপরতা বন্ধ করা হবে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ আমাদের উন্নয়নের জন্য দরকার। কিন্তু তা সুন্দরবনের বিনিময়ে হতে পারে না। বিদ্যুৎকেন্দ্র করার অনেক জায়গা পাওয়া যাবে। বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে সেসব জায়গায় বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যেতে পারে। বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে বলে তিনি জানান।
আনু মুহাম্মদ বলেন, সরকার বারবার বিদেশি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদাহরণ দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের নদীগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায় সেখানে পরিবেশের কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই। এই অবস্থায় সরকার কী করে দাবি করে যে তারা সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে না।
একইভাবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে যে পরিবেশের সমীক্ষা করা হয়েছে তা সঠিকভাবে করা হয়নি। এই কেন্দ্রের কারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যেসব প্রভাব পড়বে তা যাচাই না করেই এই সমীক্ষা প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। এছাড়া যেসব তথ্য দেয়া হয়েছে তার বেশিরভাগই কোনো বিশেষজ্ঞের বক্তব্য না। কর্মকর্তাদের বক্তব্য। তিনি বলেন, শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে যে শিল্পায়ন গড়ে উঠবে তার কারণেও সুন্দরবনের অনেক ক্ষতি হবে। এখনই জমি কেনা শুরু হয়ে গেছে। এছাড়া কয়লা পরিবহন নিয়ে সরকার বারবার নানা যুক্তি দিলেও বাস্তবে এ বিষয়ে কোনো সমীক্ষা করা হয়নি।
এদিকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে স্বচ্ছভাবে সব কাজ করা হয়েছে। সুন্দরবন রক্ষা করেই সব কাজ করা হবে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় রামপালই সব থেকে উত্তম জায়গা। তিনি বলেন, রামপালে অত্যাধুনিক কেন্দ্র করা হবে। বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তিতে। এতে সুন্দরবনের পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না। তিনি বলেন, পরিবেশবিদরা সুন্দরবনের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন, কিন্তু আমরা বলছি কোনো ক্ষতি হবে না। পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করেই উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন