বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বোরো ধান কাটার উৎসব

শিলা বৃষ্টি ও আগাম বন্যার শঙ্কা : শ্রমিক সঙ্কটে দুশ্চিন্তায় কৃষক ধান কাটায় কৃষকদের সহযোগিতার জন্য নেতাকর্মীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২০ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০০ এএম

দেশের প্রায় সব অঞ্চলে বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। তবে বোরো ধানের প্রধান উৎসস্থল হাওরাঞ্চলে ধান কাটা চলছে পুরোদমে। বিস্তীর্ণ হাওরের যেদিকে চোখ যায় শুধু ধান আর ধান। এ অঞ্চলের কৃষকরা পাকা ধান কেটে গোলায় তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। নাওয়া-খাওয়া ভুলে নারী-পুরুষ, ছেলে বুড়ো সবাই ধান কাটা- না হয় মাড়াইয়ের কাজ করছে। কারণ সারা বছরের খোরাক তাদের স্বপ্নের এই ফসল যে দ্রুত ঘরে তুলতে হবে। তা হলে যে কোনো সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগে সব তছনছ হয়ে যেতে পারে।

এরই মধ্যে হিটশকে অনেক জমির ধান পুড়ে গেছে। অবশিষ্ট যা আছে তাও ঠিক মতো ঘরে তুলতে পারবে কি না তা নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। যে কোনো সময় কালবৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে শিলাবৃষ্টি এসে ক্ষেতের ফসল তছনছ করে দিতে পারে। বৃষ্টি এবং ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যার ভয় রয়েছে। আবহাওয়া পূর্বভাসে বলা হয়েছে, তাপমাত্রা বাড়লেও দেশের কোথাও কোথাও বজ্রবৃষ্টিসহ ঝড়ো হাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া বন্যা পূর্বাভাসা সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে আগামী ২৪ এপ্রিলের মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টিপাতের ফলে আকস্মিক বন্যা হতে পারে। এতে কৃষকের মনে দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেছে। এ ছাড়া করোনা মহামারি রোধে সারা দেশে কঠোর লকডাউন চলছে। এতে কৃষি শ্রমিকের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ফলে ধান মাঠেই নষ্ট হওয়ার শঙ্কায় দিন কাটছে কৃষকের। এদিকে ধান দ্রুত কাটার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে কৃষিশ্রমিকের ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। গত বছরও লকডাউন থাকায় হাওরাঞ্চলের একমাত্র ফসল বোরো ধান কাটতে কৃষিশ্রমিকের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও ধান কেটে সহায়তা করেছিল। প্রয়োজনে এবারও পাকা ধান ঘরে তোলার যুদ্ধে সবাই অংশ নেবে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের নেতাকর্মীদের কৃষকের ধান কেটে সহযোগিতা করার নির্দেশ দিয়েছেন।

সুনামগঞ্জ থেকে মো: হাসান চৌধুরী জানান, হাওর অধ্যুষিত এ জেলায় ১৫৪টি ছোট বড় হাওরে বোরো ধান চাষ করা হয়েছে। হাওরজুড়ে বাতাসে দুলছে সোনালি ধানের শীষ। কৃষক তাদের কষ্টের ফসল ঘরে তুলতে, নানা ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন।

গতকাল জেলার বিভিন্ন উপজেলার হাওর ঘুরে দেখা গেছে কোথাও কোথাও কৃষকরা ধান কাটতে শুরু করেছেন। আবার কোথাও কোথাও ধান শুকানোর জন্য খলা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার মশল ঘাট গ্রামের কৃষক মাসুক মিয়া বলেন ২০ কাঠা জমিতে বোরো ধান রোপণ করেছি। খরায় ফসল কিছুটা নষ্ট হয়েছে। তারপরও যা আছে তা ঠিক মতো ঘরে তুলতে পারলে শুকরিয়া।
অপরদিকে ভিন্ন কথা বলছেন- জেলার শাল্লা, বিশ্বম্ভপুর উপজেলার কৃষকরা। তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়- শাল্লা উপজেলার, খলার হাওর, খাতুয়া হাওর, ভেড়াডহর হাওর, উদগল হাওর, ছাগলনাইয়া হাওর এবং বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার পুরিয়া হাওর, খচরা হাওর, আঙ্গারুলি হাওর এর কিছু অংশসহ এসব হাওরে গরম ঝড়ো বাতাসে ধান নষ্ট হয়ে গেছে। গরম বাতাসে পুড়ে গেছে ধান গাছ। ধানের শীষ রঙপাল্টে ধান গাছ সাদাটে এবং কোথাও কোথাও কালচে হয়ে গেছে। শীষ থেকে ধানের দানা নিয়ে দেখা যায় খোসার ভেতরে দানা হয়নি, দুধ ও পানি জমেনি সব শুকিয়ে গেছে। যেখানে ধানের ফুল প্রথম ফুটেছিল তা সব ঝড়ে গেছে।

এদিকে করোনা প্রকোপ বেড়ে যাওয়াতে দেশে চলছে লকডাউন। এতে ধান কাটার শ্রমিকের সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে। দিরাই, শাল্লা, জামালগঞ্জ, তাহিপুর, সুনামগঞ্জ সর্বত্র শ্রমিক সঙ্কট রয়েছে। বাইরে থেকে শ্রমিক আসতে পারছে না। শ্রমিক সংকটের ফলে আগে থেকেই কৃষকরা দিশেহারা। চলতি বোরো মৌসুমে সুনামগঞ্জ জেলায় ৮ লাখ ৮৭ হাজার ৭৬ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়েছে। তবে হিটশক এবং খরার কারণে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কিশোরগঞ্জ থেকে নাছিম খান জানান, এ জেলার হাওরাঞ্চলে শুরু হয়েছে বোরো ধান কাটা। হাওরবাসীর সারা বছরের খোরাক একমাত্র বোরো ধান। এই ধান কাটার মাঝেই করোনা প্রাদুর্ভাবে ১৪ এপ্রলি থেকে শুরু হয়েছে কঠোর লকডাউন। এতে প্রতিবছরের মতো উত্তরবঙ্গের রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, জামালপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ধান কাটার শ্রমিকরা কিশোরগঞ্জে আসা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এতে হাওর অঞ্চলের কৃষকরা বোরো ধান কাটা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো: শামীম আলম জানান, হাওর অঞ্চলে এখন যথেষ্ট পরিমাণ ধান কাটার শ্রমিক রয়েছে। যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে গতবার করোনার সময় যেভাবে অন্যজেলা থেকে শ্রমিক আসার জন্য সাময়িকভাবে গণপরিবহনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল এবারও সেটা করা হবে।

কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চল নিকলী ও করিমগঞ্জের কিছু অংশ সরজেমিনে দেখা যায় কিছু কিছু এলাকায় ধান কাটা শুরু হয়েছে। তবে দুই একদিনের মধ্যেই পুরোদমে ধান কাটা শুরু হবে বলে জানিয়েছেন- করিমগঞ্জের কান্দাইল গ্রামের বড়হাওর এলাকার কৃষক ধনু মেম্বার ও ঝাড়ু মিয়া এবং নিকলী উপজেলার ভাটিনানশ্রী গ্রামের ইমান আলী ও আব্দুস ছাত্তার। তারা বলেন, হিটশকে কিছু জমির ধান নষ্ট হলেও বাকি জমিতে ধান ভালোই হয়েছে। তবে বাইরের শ্রমিক ছাড়া শুধু স্থানীয় শ্রমিক দিয়ে দ্রুত ধান কাটা যাবে না। এছাড়া হাওর অঞ্চল বন্যাপ্রবণ এলাকা। রয়েছে ঝড়, শিলাবৃষ্টির আশঙ্কা, তাই এসব জমির ধান দ্রুত কাটতে না পারলে কৃষকরা অনেক ঝুঁকিতে পড়বে। তবে হাওর অঞ্চলের ধান দ্রুত মাড়াইয়ের জন্য সরকার কৃষকদের শতকরা ৭০ ভাগ ভর্তুকি দিয়ে ৬৩টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন দিয়েছে

নেত্রকোনা থেকে এ কে এম আব্দুল্লাহ জানান, জেলার হাওরাঞ্চলে পুরোদমে বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। জেলার মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী উপজেলার বিভিন্ন হাওরাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, সর্বত্র কৃষকরা ধান কাটা, মাড়াই ও শুকাতে ব্যস্ত সময় পার করছে। কোথাও কৃষিশ্রমিক, কোথাও আবার সরকারের ভর্তুকি দেয়া কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন দিয়ে ধান কাটা ও মাড়াই হচ্ছে। হিটশকে কিছু জমির ধান নষ্ট হওয়ায় অনেকে মধ্যে হতাশা বিরাজ করলেও ধান কাটা ও মাড়াই নিয়ে হাওরাঞ্চলে এক ধরনের উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।

হাওরাঞ্চলে কৃষকদের সারা বছরের একমাত্র ফসল হচ্ছে বোরো ধান। আগাম বন্যা কিংবা শিলাবৃষ্টিতে তাদের হাড়ভাঙা কষ্টের ফলানো সোনার ফসল যাতে কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হয়, তার জন্য কৃষাণ-কৃষাণীরা পাকা ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছে। কৃষকরা জানায়, এপ্রিলের ১০/১২ তারিখ থেকে হাওরে ব্রি আর ২৮ ধান কাটা শুরু হয়েছে। আর এখন ব্রি আর ২৯ ধান কাটা শুরু হয়েছে। হাওরাঞ্চলে ধান কাটা শ্রমিকের তীব্র সংকট রয়েছে। অনেক কৃষক ধান কাটা, মাড়াই ও শুকাতে তাদের স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের যুক্ত করছেন, আত্মীয়-স্বজনদেরও ধান কাটায় যুক্ত করা হয়েছে। ডিঙ্গাপুতা হাওরে ধান কাটারত মল্লিকপুর গ্রামের কৃষক চন্দন জানান, গেল কয়েক বছরের চেয়ে এবার ডিঙ্গাপোতা হাওরে বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। তিনি ৮৫ কাটা জমিতে হাইব্রিড জাতের ধান আবাদ করেছেন। কাটাপ্রতি ৭ থেকে ৮ মণ ধান পেয়েছেন। শেওড়াতলী গ্রামের কৃষক আবুল হোসেন জানান, ধান কাটার পর জমিতেই ভেজা ধান ৮ শত ২৫ টাকা মণ দরে ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছেন। হাটনাইয়া গ্রামের কৃষক সবুজ মিয়া জানান, আগাম বন্যা কিংবা শিলাবৃষ্টিতে যাতে ধানের কোনো ক্ষতি না হয়, তার জন্য হারভেস্টার মেশিন দিয়ে দ্রুত জমির ধান কাটার চেষ্টা করছি। মদন উপজেলার ফতেপুর গ্রামের কৃষক রমজান মিয়া জানান, মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে দাদন নিয়ে জমিতে ধান রোপণ করেছি। ধানের ভালো ফলন হয়েছে। এখন কেটে ঘরে তুলতে পারলে- আশা করি, মহাজনের দারদেনা শোধ করেও ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারব।

সম্প্রতি গরম ঝড়ো হাওয়ায় হাওরাঞ্চলে ৭ হাজার ৪ শত ৪৪ হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়েছে। তারপরও সবার প্রত্যাশা আর কোনো দুর্যোগে না পড়লে এ বছরও ধান ভালোই হবে। জেলা প্রশাসক কাজি মো: আব্দুর রহমান জানান, শ্রমিক সঙ্কট দূর করতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিক আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আশা করছি, হাওরাঞ্চলের কৃষকরা নির্বিঘেœ তাদের পরিশ্রমের ফসল ভালোভাবেই ঘরে তুলতে পারবেন।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া থেকে এএম মিজানুর রহমান বুলেট জানান, কুয়াকাটায় কৃষকরা মাঠে বোরো ধান কাটা নিয়ে প্রচুর ব্যস্ত সময় পার করছে। চোখ যতদূর যায় বিস্তীর্ণ মাঠ জোড়া সোনালি ধান। চারদিকে পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ। সূর্যের আলো উঁকি দেওয়ার সাথে সাথেই কৃষকরা দল বেঁধে কাস্তে হাতে নেমে পড়ছেন ধান কাটায়। দম ফেলানোর ফুরসত নেই।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ধান কেটে আঁটি বেঁধে রেখেছেন ক্ষেতের মাঝেই। পড়ন্ত বিকালে সেই আঁটি মাথায় কিংবা গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছেন কৃষকরা। বাড়িতে চলছে ধান মাড়াইয়ের কাজ। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমানতালে ব্যস্ত রয়েছে। নীলগঞ্জ ইউনিয়নের আদমপুর গ্রামের কৃষক মো: আল আমিন (২৫) বলেন, এবারে বোরো ধান চাষ করে ভালো ধান পাইছি। তবে পানির অভাবে খরচটা একটু বেশি হইছে।

টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থেকে মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, কৃষকের আগাম চাষ করা ইরি-বোরো ধান ঘরে তুলতে করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে। অধিক মজুরিতেও ধানকাটা শ্রমিক না পেয়ে বিপাকে পড়েছে এলাকার কৃষক। করোনার কারণে উত্তরবঙ্গসহ বাইরের জেলার ধানকাটা শ্রমিক আসতে না পারায় অধিক টাকা মজুরিতেও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ধান কাটা নিয়ে দুঃচিন্তায় রয়েছে কৃষক। চড়া দামে ধান কাটা শ্রমিক না পেয়ে অনেক কৃষক এলাকার দরিদ্র যুবকদের মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিক ধান কেটে ঘরে তুলছেন বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। এতে বাজার মূল্যের চেয়ে অধিক মূল্যে দিয়ে ধান কাটতে হচ্ছে।
মির্জাপুর পৌর এলাকার বাওয়ার কুমারজানী গ্রামের বাসিন্দা কৃষক আলাল উদ্দিন জানান, তার নিচু জমিতে আগাম চাষ করা ধানকাটা নিয়ে দুঃচিন্তায় রয়েছেন। যে কোনো সময় বড় ধরনের ঝড়বৃষ্টি হলে ধান তলিয়ে যাবে। করোনার কারণে শ্রমিক আসতে না পারায় ধানকাটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলে তিনি জানান। একই কথা জানান, গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক ও চান মিয়াও। নিচু জমির পাকা ধান জমিতে থাকায় তারা দুশ্চিন্তায় দিন পার করছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন