লুৎফুর রহমান তোফায়েল
হজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম। প্রত্যেক স্বাবলম্বী, সুস্থ, বিবেকবান ও প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলমানের জন্য জীবনে একবার মহিমান্বিত এই ইবাদত আদায় করা ফরজ। হজ মূলত সফরভিত্তিক একটি ইবাদত। যেখানে মুসলমানরা নিজ দেশ থেকে সফর করে সৌদি আরবের পবিত্র মক্কায় অবস্থিত পবিত্র বায়তুল্লাহ তাওয়াফসহ আরো কিছু জায়গায় নির্দিষ্ট কিছু কাজ সম্পাদন করেন। সুনির্দিষ্ট নিয়মের অধীনে তারা হিজরি সনের জিলহজ মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে এই কাজগুলো সম্পাদন করেন। এরপর প্রায় সবাই মদিনায় অবস্থিত মহানবির (সা.) রওযা মুবারক জিয়ারত করেন। বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় তখন মক্কা ও মদিনায় কয়েকগুণ মানুষের সমাগম ঘটে। মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ ঈমানদার মুসলমান সমবেত হন মহান মাবুদের সন্তুষ্টি লাভের আশায় পবিত্র এই ভূমিতে। এক অভূতপূর্ব মহামিলনের উৎসবে পরিণত হয় হজের আনুষ্ঠানিকতা। এই আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে মুসলিম বিশ্ব রচনা করে এক সুদৃঢ় ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সমবেত মুসলমানদের দেহের গঠন, মুখের ভাষা ও বর্ণে পারস্পরিক ভিন্নতা থাকলেও সেখানে সবাই একই পোশাক জড়িয়ে থাকেন নিজ গায়ে। মুখে সবার উচ্চারিত হয় একই আওয়াজ- লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক...। একই কাতারে দাঁড়িয়ে আদায় করেন প্রতি ওয়াক্তের সালাত, একই নিয়মে সম্পাদন করেন হজের সকল কার্যক্রম, একই ভাষায় বর্ণনা করেন মহান মুনিবের মাহাত্ম্য। এর মাধ্যমে পরস্পরে সৃষ্টি হয় এক অসাধারণ ঐক্যের বাঁধন। মুসলমানরা ফিরে পায় নিজ চেতনা। জাগ্রত হয় ভ্রতৃত্বের মায়া-বন্ধন। সবাই এক সাথে প্রভুর একত্ববাদ বর্ণনা করেন একই সুরে।
এভাবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সৃষ্টি হয় এক অটুট ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের। তারা উজ্জীবিত হয় সাম্য ও ন্যায়ের মন্ত্রে। সম্মিলিতভাবে মহান প্রভুর বান্দা হিসেবে নিজেকে সপে দিতে উদগ্রীব থাকে তাদের মন। তখন তারা পায় মহান মুনিবের অফুরন্ত করুণা। পুণ্য অর্জনের এই সুবর্ণ সুযোগে তারা নিজেকে শামিল করে নেয় মহান আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের কাতারে। একটি মকবুল হজের পর বান্দা জন্মের সময় যে রকম নিষ্পাপ ছিল সে রকমই নিষ্পাপ হয়ে বাড়ি ফিরে। তখন মহান প্রভুর অনুগ্রহ ও ভালোবাসায় সে নিজেকে পরবর্তী জীবনের জন্য তাঁর অনুগত বান্দা হিসেবে জীবন পরিচালনার পরম শিক্ষা লাভ করে।
এরকম একটি পরিবেশে পবিত্র হজ পালনের মাধ্যমে বান্দার অন্তরে জেগে ওঠে মাওলার প্রেম। সেই প্রেমে মগ্ন হয়ে হজের যাবতীয় আহকাম সম্পাদনের পাশাপাশি আপন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের চর্চা করে থাকে। কেননা এই হজ ও কোরবানি মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম (আ.), হাজেরা ও ইসমাইল (আ.)-এর অমর স্মৃতি বিজড়িত একটি ইবাদত। যেখানে ধাপে ধাপে মুসলমানরা উপলব্ধি করে ইবরাহিমের আত্মত্যাগ আর মহান প্রভুর আনুগত্যের নাজরানা। ইবরাহিম (আ.) কীভাবে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কত আত্মত্যাগ করেছেন তা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে তাঁদের সামনে। হজের প্রতিটি কাজেই মহান আল্লাহ রেখে দিয়েছেন নিজ বন্ধু ইবরাহিমের জীবনের বিভিন্ন সময়ের স্মৃতিগুলো। এর মাধ্যমে মুমিনেরা হজ ও কোরবানিতে খুঁজে পায় আপন প্রভুর সান্নিধ্য ও সন্তুষ্টি লাভের মহান শিক্ষা।
নুহ (আ.)-এর সময়ের প্লাবনের পর কাবা ঘরের সংস্কারের প্রয়োজন পড়লে ইবরাহিম (আ.) নিজপুত্র ইসমাইলকে সাথে নিয়ে এ ঘরটি সংস্কার করেন। এবং দোয়া করলেন, “হে আমার প্রতিপালক! আমাদের উভয়কে তোমার আজ্ঞাবহ করো, আমাদের বংশ থেকে একটি অনুগত দল সৃষ্টি কর, আমাদের হজের রীতিনীতি বলে দাও এবং আমাদের ক্ষমা কর। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের এ কাজটি কবুল কর।” আল্লাহতায়ালা ইবরাহিমের (আ.) দোয়া কবুল করে নির্দেশ দিলেন, “হে ইবরাহিম! তুমি মানবজাতিকে হজের জন্য আহ্বান কর। আমার বান্দারা আমার প্রেম ও ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এখানে হজ করতে আসবে। তাদের সব আশা-আকাক্সক্ষা ও মনের সদিচ্ছা পূর্ণ হবে এবং সব অপরাধ ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে।” এছাড়া ইসমাইলের (আ.) শিশুকালে আল্লাহ ইবরাহিমকে (আ.) নির্দেশ দিলেন শিশুপুত্র ইসমাইলসহ স্ত্রী হাজেরাকে মরুভূমির নির্জন এলাকায় রেখে আসতে। ইবরাহিম (আ.) নিজ প্রভুর আনুগত্যের কারণে জনমানবহীন মরুপ্রান্তরে স্ত্রী-সন্তানকে রেখে আসলেন। পানীয় ও খাদ্য সামগ্রী শেষ হয়ে যাওয়ার পর হাজেরা সন্তানের জন্য পানির খুঁজে সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করে পানির খোঁজ করেন। এবং আল্লাহ তখন নিজ রহমতে জমজম কুপের সৃষ্টি করে তাদের পানির চাহিদা পূরণ করেন। এজন্য হজ পালনকারীরা এই সাফ-মারওয়া পাহাড়ে সায়ি করেন। আল্লাহর আদেশে ইবরাহিম (আ.) পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি করতে নিয়ে যাওয়ার সময় শয়তান বাধা দিলে তিনি শয়তানকে পাথর ছুড়ে প্রতিহত করেন। তাই হাজিরা এই স্থানে গিয়ে শয়তানকে উদ্দেশ্য করে পাথর ছুড়েন। এরপর ইবরাহিমের মহাত্যাগের স্মৃতিকে ভাস্কর করে রাখতে আল্লাহ স্বাবলম্বী মুসলমানদের জন্য কোরবানির বিধান অত্যবশ্যকীয় করেছেন। ইবরাহিম যেভাবে নিজ মালিকের প্রেমে আপন পুত্রকে জবাই করতে চেয়েছিলেন মুসলমানরা সেভাবে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় পশু কোরবানি করে থাকে।
এভাবে ইবরাহিম ও ইসমাইল (আ.)-এর স্মৃতিবাহী এসব কর্মকা-ের সাথে তাদের আত্মত্যাগ ও প্রভুপ্রেমের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো ভাসে মুমিনের স্মৃতিপটে। তারা সবাই একসাথে সাদা কাপড়ে মোড়ানো দেহ নিয়ে স্মরণ করে জীবনের শেষ সময়ের কথা। মরণের পর যে এই দুটি কাপড়ই তাদের সম্বল তা খুব সহজে অনুমান করতে পারা যায় তখন। মুমিনের জীবন যে একটি সুশৃঙ্খলাবদ্ধ তা হজের ওই সম্মিলিত নিয়ম-আহকাম পালনের মাধ্যমে সবার মনে জাগ্রত হয়। হজের সফরের মাধ্যমে তারা শিক্ষা লাভ করে যে, এই জীবনটা একটা ক্ষণস্থায়ী সফরের মত। সফরের পর চলে যেতে হবে আমাদের স্থায়ী আবাসনে। যার জন্য পাথেও জোগাড় করার এখনই সময়। এসব কর্মকা-ের মাধ্যমে বান্দারা নিজ প্রভুর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য লাভের এক মহান সুযোগ লাভ করে। মাওলাপ্রেমিক প্রতিটি হৃদয় তাই হজ ও কোরবানিকে সামনে রেখে উপার্জন করে নেয় পরকালের যথেষ্ট পাথেয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন