স্টাফ রিপোর্টার : সীমান্তের ওপার থেকে আসছে অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্র। মিয়ানমার সীমান্ত ব্যবহার করে একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ স্থল ও সাগর পথে অস্ত্র নিয়ে আসছে। সীমান্তে সক্রিয় চোরাচালান সিন্ডিকেট মাদক ও অস্ত্র ব্যবসার পাশাপাশি বিভিন্ন চোরাই পণ্যও নিয়ে আসছে ওপার থেকে। পবিত্র কোরবানির ঈদ সামনে রেখে দেশের সব কয়টি সীমান্ত পয়েন্টের পাশাপাশি কক্সবাজারভিত্তিক উখিয়া-টেকনাফের চোরাচালান সিন্ডিকেটও এখন ব্যাপক তৎপর হয়ে উঠেছে। ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, মদসহ বিভিন্ন প্রকার মাদকদ্রব্যের বিশাল অংকের চালান আসছে কক্সবাজার টেকনাফ নাইক্ষংছড়ি বান্দরবান সীমান্তে। বিভিন্ন প্রকার চোরাইপণ্য আটকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন যতই তৎপর হচ্ছে ততই চোরাচালান সিন্ডিকেট পাচারের ধরন পাল্টানোর কারণে পাচারকারী চক্রের গডফাদারেরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সীমান্তের ওপার থেকে ভারী অস্ত্রও আসছে। বিশেষ করে মিয়ানমার সীমান্ত হয়ে স্থল ও সাগর পথে আসছে ভারী অস্ত্র।
সূত্র জানায়, উপকূলীয় অঞ্চল হওয়ায় টেকনাফ উখিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা থাকে অরক্ষিত। যে কারণে চোরাকারবারিরা এ রুটটিই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে থাকে। বাংলাদেশে মিয়ানমার ও ভারত হয়েই সাধারণত অস্ত্র ঢুকছে। তবে ভারী অস্ত্রগুলো ঢুকছে মিয়ানমার সীমান্ত হয়ে এ পথেই। একে-৪৭ রাইফেল, এলএমজি, এম-১৬ রাইফেলসহ নানা ধরনের ভয়ঙ্কর অস্ত্র। স্প্যানিশ অস্ত্রের মতো অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের বেশির ভাগই আসে মিয়ানমার থেকে। চাইনিজ রাইফেল, পিস্তল, রিভলবার, স্টেনগান, মেশিনগান, সাব-মেশিনগান, কালাশনিকভ সিরিজের একে-৪৬, একে-৪৭, একে-৫৪, একে-৫৬, একে-৭৪ ও এম-১৬-এর মতো ভয়ঙ্কর অস্ত্র আসছে এই রুটে।
পুলিশ বলছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশক্রমে মানবপাচারকারী ও চোরাচালান সিন্ডিকেটের চিহ্নিত সদস্যদের ধরতে অভিযান চলছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে মানবপাচারকারী ও মাদকচোরাচালানী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান শুরু হচ্ছে শীঘ্রই। এমনটি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাদের মতে, সীমান্তে চোরাচালান রোধে বিজিবিসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। তবে বাস্তব চিত্র বিভিন্ন বলে দাবী করছেন স্থানীয় সাধারণ মানুষ।
এদিকে কক্সবাজার ১৭ বিজিবি’র অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার জানান, ইয়াবা চোরাচালান প্রতিরোধে সরকার কর্তৃক ঘোষিত জিরো ট্রলারেন্স নীতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সীমান্তরক্ষী ও চেকপোস্টের দায়িত্বপূর্ণ বিজিবি সদস্যরা সার্বক্ষণিক কাজ করছেন। তিনি জানান, গত কয়েক মাসে বিজিবি সদস্যরা প্রায় ১৫ কোটি টাকা মূল্যের ইয়াবা, দেশী মদ, বিয়ার, ক্যান, ফেন্সিডিল ও গাঁজা আটক করে তা ধ্বংস করেছে। তিনি আরো বলেন, কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে সীমান্ত পার হয়ে ইয়াবাসহ নানা প্রকার মাদকদ্রব্য যাতে পাচার হয়ে আসতে না পারে, সেজন্য বিজিবি সদস্যদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।
উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আবুল খায়ের জানান, ইয়াবা পাচার প্রতিরোধের পাশাপাশি পুলিশ শিগগিরই বিশেষ অভিযানের মাধ্যমে মানবপাচারকারী ও চোরাচালান সিন্ডিকেটের সদস্যদের গ্রেপ্তারে বিশেষ অভিযান শুরু করবে। যাতে কোরবানির ঈদে মানুষ স্বচ্ছন্দে ঈদ উদযাপন করতে পারে।
বিজিবি সূত্র বলেছে, দেশের সীমান্ত এলাকায় অবৈধ অস্ত্র চোরাচালান বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কক্সবাজার সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকায় ডাকাতের উপদ্রবও বৃদ্ধি পেয়েছে। সীমান্তে আরও কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বিজিবি সতর্ক অবস্থানে আছে বলে দাবী করা হয়েছে। বিজিবির সূত্র মতে, ভারী অস্ত্রশস্ত্র ওইসব সন্ত্রাসী দলের। অন্যদিকে পুলিশ বলছে, সন্ত্রাসীরা কক্সবাজার ও মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে এসব অস্ত্র ব্যবহার ও বিক্রির উদ্দেশ্যে নিয়ে আসছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিয়ানমার বিচ্ছিন্নতাবাদী দলসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ সীমান্ত দিয়ে আসা অস্ত্রের ব্যবহার এবং অস্ত্র চোরাচালানের সঙ্গে সক্রিয় রয়েছে। টেকনাফ-উখিয়ার বিভিন্ন রুটেই অবৈধ অস্ত্রের চালান আসছে। সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো অস্ত্র কেনা বেচার জন্য সাগর পথকেও ব্যবহার করছে। ভারী অস্ত্রের বড় ব্যবসায়ী টেকনাফের ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। অস্ত্র নেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রিম অর্ধেক টাকা জামানত হিসেবে দিতে হয় এবং দুই এক দিনের মধ্যেই অস্ত্র এসে পৌঁছে যায় ক্রেতার হাতে। সীমান্তের ওপার থেকে অস্ত্র বাংলাদেশের সীমান্ত গলিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। সেখান থেকে নির্ধারিত পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও বিভিন্ন উপায়ে দেশের অভ্যন্তরে নিয়ে আসছে অস্ত্র। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গারাই অস্ত্র বহন করে থাকে বেশি। বিশেষ করে শ্রমজীবী রোহিঙ্গাদের এ কাজে এখন বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে।
জানা গেছে, সীমান্তের ওপার থেকে চোরাই পথে আসা অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য পাচারের ক্ষেত্রে কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়ক ও মেরিন ড্রাইভ সড়কটি অন্যতম নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। উখিয়া-টেকনাফ সীমান্ত একদিকে যেমন পেশাদার সন্ত্রাসী ও চোরাকারবারিদের নিরাপদ অভয়ারণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, তেমনি পাচারের ক্ষেত্রেও নিরাপদ রুট হিসেবে বেছে নেওয়া হয় কক্সবাজার-টেকনাফ-আরাকান সড়ক। এছাড়াও অঘোষিত অস্ত্র চোরাচালানের গডফাদারেরা সাগর পথেও অস্ত্র পাচার করছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে।
একটি গোয়েন্দা সূত্র মতে, আন্তর্জাতিক অস্ত্র ও মাদক পাচারকারীদের কাছে বাংলাদেশ ট্রানজিট রুট হিসেবে বেশ নির্ভরযোগ্য হয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। ২০০১ সালে জাতিসংঘ প্রদত্ত একটি প্রতিবেদনে এর মূল কারণটা চিহ্নিত হয়েছিল। বলা হয়েছিল ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের ট্রানজিট রুটে পরিণত হয়েছে। কারণ, মাদক উৎপাদনকারী ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল’ এবং ক্ষুদ্র অবৈধ অস্ত্র উৎপাদনকারী ‘গোল্ডেন ক্রিসেন্টের’ মাঝামাঝিতে বাংলাদেশের অবস্থান। একই মত পোষণ করে লন্ডনভিত্তিক বেসরকারি সংগঠন ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকশন নেটওয়ার্ক অন স্মল আর্মস’ ও কলম্বো ভিত্তিক ‘সাউথ এশিয়ান স্মল আর্মস নেটওয়ার্ক’।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মিয়ানমার থেকে আসা চোরাইপণ্য পাচারে নিরাপদ রুট হিসাবে চিহ্নিত নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু, ঘুমধুম, জলপাইতলী, কুমির প্রজনন কেন্দ্র, উখিয়ার ডেইলপাড়া, চাকবৈঠা, আমতলী, তুলাতলী, বালুখালী, রহমতের বিল, আনজুমানপাড়া, নলবনিয়া, ধামনখালীসহ টেকনাফের অর্ধশতাধিক পয়েন্ট দিয়ে মরণনেশা ইয়াবা, হেরোইন, বোতলজাত মদসহ চোলাই মদ পাচার হয়ে আসছিল দীর্ঘদিন থেকে। সীমান্তরক্ষী বিজিবি সদস্যরা মাঝে মধ্যে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কসহ সীমান্ত পারাপারের সময় অভিযান চালিয়ে মাদকদ্রব্যসহ বিভিন্ন চোরাইপণ্য আটক করতে সক্ষম হলেও চোরাচালানীর গডফাদারেরা ধরা না পড়ার কারণে সীমান্তে চোরাচালান বন্ধ হচ্ছে না বলে মনে করছেন স্থানীয় লোকজন।
স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, বিজিবিসহ আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে চোরাচালান চক্রের তালিকা থাকলেও রহস্যজনক কারণে এদের অধিকাংশই রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, স্থানীয় থানা প্রশাসনের সাথে গভীর সখ্যতা গড়ে তোলায় এসব ইয়াবা ও চোরাচালানকারী ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, চোরাচালান সিন্ডিকেটের মধ্যে অন্যতম গডফাদার তুমব্রু এলাকার দুবাই প্রবাসী ফজল আহমদের ছেলে সুলতান আহমদ, বালুখালির ছড়া গ্রামের বালু ফরিদের ছেলে মফিজ, বেড়া আহমদের ছেলে আলা উদ্দিন, জমির উদ্দিন, ছৈয়দ নুর, নুরুল আবছার, টাইপালং গ্রামের মৃত দরবেশ আলীর ছেলে গিয়াস উদ্দিন, শামশুল আলমের ছেলে নজরুল ইসলাম, হিজলিয়া এলাকার বাবুল, রাজাপালং গ্রামের মুক্তার, হাজিরপাড়া গ্রামের আতা উল্লাহ, ডিগলিয়া গ্রামের জসিম উদ্দিন, জয়নাল, টাইপালং গ্রামের বাবুল, হাজির পাড়া গ্রামের গিয়াস উদ্দিন, কোটবাজার এলাকার মনু সওদাগর, থাইংখালী এলাকার মনজুর আলম প্রঃ ইয়াবা মনজুরসহ আরো অনেকে ইয়াবা ও বিভিন্ন মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের নীরবতার কারণে দিনদুপুরে চষে বেড়াচ্ছে এসব চোরাকারবারীরা। সর্বশেষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়। সভায় মানবপাচারকারী ও চোরাচালানি গ্রেপ্তারে বিশেষ অভিযান চালানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফভিত্তিক চোরাচালান চক্র দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা ও নানা প্রকার মাদক পাচারে জড়িত। এই চোরাকারবারিদের ধরতে পুলিশ, বিজিবি, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য ও আইন প্রয়োগ সংস্থা তৎপর হয়ে ধরপাকড় শুরু করলে চোরাকারবারিরা কৌশল পরিবর্তন করে অথবা আত্মগোপন করায় তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, টেকনাফ ও উখিয়া থেকে বিগত এক বছরে শতাধিক অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এসব অস্ত্রের বেশির ভাগই চোরাচালান হয়ে দেশে ঢুকেছিল। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন স্তরে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে, এই দুই উপজেলার সীমান্ত এলাকার ৯টি পয়েন্ট দিয়ে অবৈধ অস্ত্রের চালান আসছে। অবৈধ অস্ত্র প্রবেশের অন্যতম রুট হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে উখিয়া-টেকনাফ সীমান্তের। দেশি-বিদেশি অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীরাও এই অঞ্চলে ভীষণ তৎপর। কখনো কখনো অস্ত্রের চালান থেকে খোয়া যাওয়া এক দুটি অস্ত্র আটক করে পুলিশ। অধিকাংশের কোনো খবর থাকে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। এতে করে অস্ত্রের চালান আসছে নিয়মিত। (সমাপ্ত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন