অর্থনৈতিক রিপোর্টার : ঈদ মানেই বাড়তি কেনাকাটা। ঈদুল আযহা কোরবানির পশু কেনাসহ থাকে বিভিন্ন বাড়তি খরচ। আর তাই ঈদকে সামনে রেখে বাড়তি কেনাকাটায় বাজারে নগদ অর্থের প্রবাহ বাড়তে শুরু করেছে। এতে চাঙ্গা হয়ে উঠছে অর্থনীতি। টাকা উত্তোলন ও ফান্ড স্থানান্তরে ব্যাংকের শাখা ও এটিএম বুথে মানুষের ভিড় বাড়ছে। গত বৃহস্পতিবারেও ব্যাংকের বিভিন্ন শাখাগুলোতে বাড়তি ভিড় লক্ষ্য কার গেছে। এদিকে ঈদ উপলক্ষে মোবাইল ব্যাংকিং ও পোস্ট অফিস সেবায় পরিবার-পরিজনের কাছে টাকা পাঠানো বেড়েছে। প্রবাসীরাও বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। মূলত শহর থেকে গ্রামÑ সর্বত্রই ঈদকেন্দ্রিক বাড়তি লেনদেনে নগদ টাকার প্রবাহ বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিবছরই দেশের অর্থনীতির আকার বড় হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে জাতীয় ও মাথাপিছু আয়। এর অর্থ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার মান বাড়ছে, যা অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির মাপকাঠি। কারণ যে দেশের মাথাপিছু আয় যত বেশি, সে দেশের জীবনযাত্রার মানও তত উন্নত বলে ধরে নেয়া হয়। এছাড়া মূল্যস্ফীতি নিম্নমুখী থাকায় জাতীয় আয় বৃদ্ধির সুফল সব শ্রেণীর মানুষই ভোগ কম-বেশি করছে।
এদিকে কোরবানির পশুসহ অন্যান্য কেনাকাটায় বাড়তি খরচের কথা মাথায় রেখে এবার নতুন-পুরনো মিলে ৩০ হাজার কোটি টাকার নোট সরবরাহের ব্যবস্থা রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে একদম নতুন নোট ১৫ হাজার কোটি টাকা। এদিকে ঈদের আগে ও পরে টানা ছয় দিন ব্যাংক বন্ধ থাকছে। এ কারণে এটিএম বুথে পর্যাপ্ত টাকা রাখার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেছেন, ঈদের সময় দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ে। শহর থেকে গ্রামমুখী হচ্ছে টাকার প্রবাহ। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিও চাঙ্গা হয়ে উঠছে। এ সময় পশুসহ অন্য সব খাতেই লেনদেন অনেক বাড়ে। এর মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যে যে স্থবিরতা ছিল, সেটা অনেকটা কেটে যাবে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে দেশে মূল্যস্ফীতি কম থাকায় ঈদে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ঈদে বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়। এর ইতিবাচক দিক হলো, এ সময় বণ্টন ব্যবস্থায় একটি পরিবর্তন হয়। এতে অধিকাংশ মানুষের কাছেই টাকা পৌঁছে যায়। আর নেতিবাচক দিক হলো মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
জানা গেছে, ঈদের সময় সাড়ে ২০ লাখ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সম্ভাব্য বোনাস বাবদ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা, দেশব্যাপী ৬০ লাখ দোকান কর্মচারীর বোনাস ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, পোশাক ও বস্ত্র খাতের ৭০ লাখ শ্রমিকের সম্ভাব্য বোনাস ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হিসেবে ঈদ অর্থনীতিতে যোগ হবে। এর বাইরে প্রবাসীরা তাদের পরিবার-পরিজনের কাছে বাড়তি অর্থ পাঠাচ্ছেন। গেল জুলাইয়ের চেয়ে আগস্ট মাসে রেমিট্যান্স বেড়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ। এ মাসে প্রবাসীরা ১১৮ কোটি ৩৬ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা আগের মাসে ছিল ১০০ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে ১৭ কোটি ৮১ লাখ ডলার বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে রেমিট্যান্স প্রবাহের গতি আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভংকর সাহা বলেন, ঈদের আগে মানুষের খরচ বেড়ে যায়। এ সময় পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপনের লক্ষ্যে বেশি অর্থ পাঠান বিদেশিরা। এ ধারাবাহিকতায় আগস্টে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। সেপ্টেম্বরের প্রথম দুই সপ্তাহে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও গতি পাবে বলেও জানান তিনি।
কোরবানিতে পশু জবাইকে কেন্দ্র করেই উদযাপিত হয় মূল উৎসব। এরই মধ্যে রাজধানীসহ সারা দেশে জমতে শুরু করেছে পশুর হাট। তবে শুক্রবার থেকে পশু বেচাবিক্রি পুরোপুরি জমে উঠেছে। বলে জানিয়েছেন পশু ব্যবসায়ীরা। এবার সারা দেশে ১ কোটির বেশি পশু কোরবানি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গেল বছর পশু কোরবানি হয়েছিল ৯৬ লাখ ৩৫ হাজার। কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন হাই অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, প্রতিবছর দেড় থেকে ২ হাজার কোটি টাকার কোরবানির পশুর বাণিজ্য হয়। এর সিংহভাগ রয়েছে মফস্বল ঘিরে। আর এসব পশুর চামড়া সংগ্রহ করতে গ্রামে গ্রামে আগাম বিনিয়োগ করছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, আগে যেখানে একটি পশু পাঁচ থেকে সাত ভাগে কোরবানি দেয়া হতো, এখন তা একজনেই কোরবানি দিচ্ছেন। এর অর্থ আগের চেয়ে মানুষের আয় ও সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চলতি মূল্যে মোট দেশজ আয় (জিডিপি) দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ২৯ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা। এ হিসাবে মাথাপিছু আয় ১ লাখ ৮ হাজার ১৭২ টাকা; আগের অর্থবছরের ছিল ৯৬ হাজার টাকা। ১ বছরের ব্যবধানে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১২ হাজার ১৬৮ টাকা বা ১২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এছাড়া মন্ত্রী, এমপিসহ রাজনৈতিক নেতারা ভোটারদের খুশি করতে একাধিক পশু কোরবানি দেন। এবারও অনেক মন্ত্রী, এমপি তাদের নিজ এলাকায় কোরবানি দেবেন বলে জানা গেছে। শুধু পশু ব্যবসায়ীরাই নন, কোরবানি উপলক্ষে সংশ্লিষ্ট অন্য খাতের লেনদেনও চাঙ্গা হয়ে উঠছে। কোরবানির গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হলো ছুরি, বঁটি, দা, চাপাতি, কুড়াল, রামদা। এগুলো ছাড়া কোরবানিই সম্ভব নয়। জানা গেছে, কোরবানির ঈদ সামনে রেখে কামাররা দা, বঁটি, চাকু, চাপাতিসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এ খাতে সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও কয়েকশ’ কোটি টাকার লেনদেন হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া ঈদ উপলক্ষে ছোটদের নতুন পোশাক, জুতা, সেন্ডেল কেনাকাটা হবে। এতে চাঙ্গা হবে অর্থনীতি। জানা গেছে, কোরবানিতে ব্যবহার হয়, এমন পণ্য যেমন পেঁয়াজ, রসুন, আদা, এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, জিরা, তেজপাতা প্রভৃতির মজুদ বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২ হাজার ৫০০ টন এলাচ, ৭ হাজার ৬০০ টন দারুচিনি, ১৭০ টন লবঙ্গ এবং ৩৭০ টন জিরা আমদানি করা হয়েছে। এসব উপকরণ আর্থিক প্রবাহকে বাড়াবে এবং অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন