পাসপোর্ট তৈরি, বিয়ে দেয়া, অনুষ্ঠান আয়োজন সব করে দেয় জঙ্গি সদস্যরাই
স্টাফ রিপোর্টার : সিরিয়ায় জিহাদে যাওয়ার পরিকল্পনাকারী দুই দম্পতির বিয়েতে ১৫ জঙ্গি উপস্থিত ছিল। তাদের বিয়ে দেয়া, বিয়ের অনুষ্ঠান, পাসপোর্ট করা থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সকল কাজ জঙ্গি নেতারাই করে দেয়।
এছাড়া, মার্জিয়া আক্তার সুমি ও নাহিদা সুলতানা দুজনেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরপরই সুমি মাহমুদকে এবং নাহিদা আমিনুলকে বিয়ে করে। এ গোপন বিয়েতে উৎসবের আয়োজন করা হয়, যাতে অংশ নেয় অন্তত ১৫ উগ্রপন্থী সদস্য। তারা চারজনই নতুন ধারার নিউ জেএমবির সদস্য। র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে আটক নিউ জেএমবির দুই মহিলাসহ তাদের দুই স্বামী এসব কথা র্যাবকে জানিয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে এ চার জঙ্গির পারিবারিক পরিচয়, উগ্রপন্থী দলে যোগদান, পরে বিয়েসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে র্যাব।
র্যাব জানায়, জঙ্গি ফাহিম, ফরহাদ, পরাগ আহম্মেদ, আশরাফুল ইসলাম, আবু রেহান, মিজান, হৃদয়, আবু আলী, বকুল খান জহিরুল ও সিপন, শফিক, রহমান ও কাদের ওদের বিয়েতে উপস্থিত ছিল। এ গোপন বিয়ের উৎসবের মাধ্যমে আরও নতুন সদস্য সংগ্রহের চেষ্টা চালায় তারা। আর এতে কলকাঠি নাড়ে জঙ্গি মিজান, ফাহিম ও জহির। এর মধ্যে ফাহিম মাদারীপুরে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়।
র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ বলেন, চার জঙ্গির সূত্র ধরে আরও কয়েকজনকে গোয়েন্দা জালে নেয়া হয়েছে। এছাড়া প্রাপ্ত তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই শেষে পরবর্তী অভিযান চালানো হবে। তিনি বলেন, জঙ্গিরা বিয়ে করে গ্রুপ তৈরির চেষ্টা করছে। তাদের দমনে র্যাবের গোয়েন্দারা তৎপর রয়েছেন।
র্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে দুই দম্পতির কাছ থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়। তারা আরও জানায়, উল্লিখিত জঙ্গিদের মধ্যে আরও কয়েকজনের গোপনে বিয়ে হওয়ার কথা রয়েছে।
নারী জঙ্গি মার্জিয়া আক্তার সুমির বাবা মুনসুর আলী শেখ। ১৯৯৯ সালে পাবনার সুজানগর থানার উলাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করে সুমি। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে ২০১৫ সালে ময়মনসিংহ মোমিনুন নেসা সরকারি মহিলা কলেজে দ্বাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয় সে।
চলতি বছরের জুনে প্রভাতের আলো নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে যুক্ত হয় সুমি। এ গ্রুপের এক সদস্য ‘কোটিপতির জামাই’র সঙ্গে সুমি মেসেজ আদান-প্রদান করত। একপর্যায়ে ‘কালো পাখি’ নামে আরেকটি আইডির সঙ্গেও পরিচয় হয়।
মেসেজ আদান-প্রদানের মাধ্যমে সুমি জানতে পারে আইডিটি শরিফুল ইসলাম শরিফ ওরফে মাহমুদ নামক এক ব্যক্তির। ফেসবুকে মুসলিম কন্যা, রেড লাইট ইত্যাদি আইডির সঙ্গেও পরিচয় হয়। একপর্যায়ে মাহমুদের সঙ্গে সুমির প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরে তারা মেসেজ ও মোবাইলের মাধ্যমে জিহাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করত। গত মাসে মাহমুদের ডাকে সাড়া দিয়ে বাবার বাসা থেকে পালিয়ে গাজীপুর যায়। ওই দিনই বন্ধু আমিনুল, সিপন, নাইমুর ও খোকনকে নিয়ে গাজীপুরের সাইনবোর্ড এলাকার একটি কাজী অফিসে সুমিকে বিয়ে করে মাহমুদ এবং কোনাবাড়ির সবুজ কানন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করে। সেখানে জহির নামে এক লোক আসত। মাহমুদ বাসা থেকে সকালে বেরিয়ে যেত এবং সন্ধ্যায় বাসায় ফিরত। মোবাইল ও ফেসবুকে কথা বলা নিরাপদ নয় বলে মাহমুদ সুমিকে টেলিগ্রাম আইডি খুলে দেয়। মাহমুদ তাকে আরও বলে, দু’জন পাসপোর্ট করে জিহাদের জন্য সিরিয়া যাবে।
শরিফুল ইসলাম ওরফে সুলতান ওরফে মাহমুদের বাড়ি শেরপুর শহরের সিএনবি কোয়ার্টারে। ২০১৫ সালের জুনে ফেসবুকের মাধ্যমে মিজান নামে একজনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। মিজানের ফেসবুক আইডির নাম ছিল শরিফ তাপস। মিজান ফেসবুকের মাধ্যমে তাকে বিভিন্ন ইসলামিক প্রশ্ন করত। ২০১৬ সালের মার্চে মিজানের সঙ্গে দেখা করার জন্য উত্তরার আজমপুরে যায় সে। সেখানে ছাপরা মসজিদে মিজানসহ আরও ১০-১২ জন ‘দ্বীনি ভাই’র সঙ্গে দেখা হয়। মিজান তাকে মোবাইলে ‘শেয়ারইট’-এর মাধ্যমে টেলিগ্রাম, থ্রিমা, ফ্রিডম ভিপিএন অ্যাপস দেয়। টেলিগ্রামের মাধ্যমে টাইফুন গ্রুপের খলিল, মিলন, নিলয়সহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এ গ্রুপের একজন আমীর আছে। একপর্যায়ে তার সঙ্গে মিজান, প্রিন্স ফাহিম, হৃদয়, আবু আলীসহ আরও অনেকের পরিচয় হতে থাকে। এর মধ্যে কোটিপতির জামাই নামক একটি ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে সুমির সঙ্গে তার পরিচয় হয়।
আরেক নারী জঙ্গি নাহিদা সুলতানার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার কাশিপুরে। সে ২০১৫ সালের মার্চের দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে আইডি খোলে। ফেসবুকে তার সঙ্গে পীর বংশের পোলা (আমিনুল) নামে একটি আইডির পরিচয় হয়।
এ আইডি থেকে তাকে মেসেজ পাঠানো হয়, ‘আপনি ছেলে না মেয়ে?’ পরে তারা একে অপরের মোবাইল নম্বর নেয় এবং আমিনুল নাহিদাকে ফোন করে। আমিনুল জিহাদি বিভিন্ন বিষয় নাহিদার আইডিতে পোস্ট ও ট্যাগ করত। এভাবে তাদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান চলতে থাকে। গত বছর ঈদুল ফিতরের দিন আমিনুল ও নাহিদার মধ্যে দু’জনের পরিবার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
একপর্যায়ে আমিনুল বিবাহিত এবং দুই সন্তানের জনক বলে জানায়। আমিনুল নাহিদাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে সে প্রথমে রাজি না হলেও পরে আমিনুলের ইসলামী জ্ঞান, জিহাদি মনোভাব এবং হিজরতে যাওয়ার ইচ্ছার কারণে রাজি হয়। পরে ২২ মে গাজীপুর টঙ্গী কলেজ গেটে কাজী অফিসে গিয়ে তারা বিয়ে করে।
আমিনুল ইসলামের গ্রামের বাড়ি শেরপুরের নালিতাবাড়ির নিশ্চিন্তপুরে। ২০০২ সালে সে তার বড় ভাই আবদুল হাকিমের ওষুধের দোকানে বসত। ২০০৩ সালে পরে এলাকার নন্নী বাজারে নিজেই আম্বিয়া মেডিকেল হাউস নামে ওষুধের দোকান দেয়।
২০১৫ সালের মাঝামাঝিতে ‘পীর বংশের পোলা’ নামে ফেসবুক আইডি খোলে। এই আইডিটি কয়েক মাস চলার পর বন্ধ হয়ে গেলে সে নিজ নামে একটি ফেসবুক আইডি খোলে। অন্যদিকে নাহিদা সুলতানা ‘এক মুসলিম কন্যা’ ও ‘নাহিদ সুলতানা’ নামে ফেসবুক আইডি ব্যবহার করত।
তাদের বিয়েতে জঙ্গি ফাহিম ছাড়াও পরাগ আহম্মেদ, আশরাফুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন অংশ নেয়। বিয়ের কিছুদিন পর নাহিদা জানতে পারে তার বিয়ের দ্বিতীয় সাক্ষী ফাহিম মাদারীপুরে হিন্দু শিক্ষক হত্যাচেষ্টা মামলার প্রধান আসামি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন