চুড়িহাট্টা ও নিমতলী পর এবার আরমানিটোলা। একের পর এক ভয়াবহ কেমিক্যাল বিস্ফোরণের ঘটনায় সাধারন মানুষের মৃত্যুর পরেও টনক নড়ছে না প্রশাসন কিংবা কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের। ভবিষ্যতে পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যালের গোডাউন সরানো হলেও শো-রুম সরিয়ে নিতে রাজী নন ব্যবসায়ীরা। পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা স্থানান্তরে বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি পার্ক নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। কিন্তু কাজ হচ্ছে না কিছুই। অথচ বর্তমানে পুরান ঢাকায় অবৈধ গুদাম রয়েছে ২৬ হাজারের মতো। প্রায় প্রতিটি বাড়ির নিচে বেজমেন্টে বস্তার পর বস্তা, কন্টেইনারের স্তুপ দেখা যায়। কোনটি অতি দাহ্য পদার্থ আবার কোনটি কম দাহ্য পদার্থ।
অন্যদিকে হাজী মুসা ম্যানশনে আগুনের ঘটনায় আশিকুজ্জামান ও ইশরাত জাহান মুনা দম্পতি লাইফ সাপোর্টে বলে জানিয়েছেন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন। তিনি জানান, আরমিটোলার আগুনের ঘটনায় প্রথম থেকেই চারজন আইসিইউতে ছিল। এর মধ্যে আশিক ও মুনার অবস্থার অবনতি হওয়ায় গত শুক্রবার দিবাগত রাতে তাদেরকে লাইফ সাপোর্টে দেয়া হয়েছে। বাকি দুইজন আইসিইউতে আছে। বাকি ২০ জন পোস্ট অপারেটিভে আছে। যেহেতু তাদের সবার শ্বাসনালী বার্ন রয়েছে, তাই তাদের শঙ্কামুক্ত বলা যাবে না।
গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, গোটা ভবনের দায়িত্ব নিয়েছে পুলিশ। ভবনের ভুল গেট ও মার্কেটে তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছে। শনিবার সকালের দিকে হঠাৎ ভবনের ভেতর থেকে প্রচন্ড ধোঁয়া বের হয়ে আসতে থাকে। পরে ফায়ার সার্ভিসের ফোন দেয়া হলে তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ফায়ারম্যান নিজাম উদ্দিন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমরা এসে ভেতরে ঢুকে ধোঁয়া দেখতে পাই। তবে এটি নতুন কোন ধোঁয়া না। শুক্রবার আগুন নেভানোর পরেও কিছু কিছু জায়গায় ধোঁয়া জমে ছিল, সেগুলো বের হচ্ছে, আতংকিত হওয়ার কিছু নেই।
গতকাল শনিবার আরমানিটোলার আগুনের ঘটনাস্থল হাজী মুসা ম্যানশন পরিদর্শনে যান বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি পার্কের প্রকল্প পরিচালক সাইফুল ইসলাম। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমরা সকাল থেকে আশপাশের কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের সিরাজদিখানে চলমান প্রকল্পের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেছি। ব্যবসায়ীদের সেখান যাওয়ার ইচ্ছা আছে। তবে তারা এখানে একটা শোরুম রাখতে চান। তারা চান ওয়ারহাউজগুলো দূরে রাখতে। প্রকল্পের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকল্পের জমি নেয়া হয়ে গেছে। এক সপ্তাহের মধ্যে মাটি ভরাট শুরু হবে। ৬ মাসের মধ্যে মাটি ভরাট কাজ শেষ হবে। আশা করছি, ২০২২ সালে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংস্থার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক কানেকশন। ভোট নষ্ট হওয়ার আশংকায় স্থানীয় নেতাদের বিরোধীতার কারণেই সরানো যাচ্ছে না গুদামগুলো। এলাকাবাসীও একই ধরনের অভিযোগ করে বলেছেন, জেনেশুনেই তারা মৃত্যুর মধ্যেই বসবাস করছেন। মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমান আদালত অভিযান চালায়। সিলগালা করে দেয়া হয়। কিছুদিন যেতে না যেতেই স্থানীয় নেতাদের শেল্টারে গুদামগুলো খোলে দেয়া হয়। গত দুই বছরে পুরাণ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ১১২টি কারখানা সিলগালা করার পাশাপাশি ১৭৩ জনকে কারাদন্ড দেয়া হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০১০ সালের জুন নিমতলীতে প্রথম বড় ধরনের অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ওই সময় ৭০ জন মারা যায়। এই ঘটনার পর সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা দফায় দফায় বৈঠক করেন। ২০১১ সালের ২০ এপ্রিল পুরাণ ঢাকা থেকে সব রাসয়ানিক কারখানাগুলো সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আর এই জন্য কেরানীগঞ্জ ও কামরাঙ্গীচর বিশাল জায়গায়ও চুড়ান্ত করা হয়। এজন্য বিসিকের চেয়ারম্যানকে আহবায়ক করে একটি এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবকে প্রধান করে আরেকটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করে স্বরষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা উর্ধ্বতন গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের কারণে গুদাম সরানো যাবে না। এগুলো না সরালে প্রায়ই বড় ধরনের অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটবে। আরমানিটোলা, বাবুবাজার, মিটফোর্ড, চকবাজার, লালবাগ, ইসলামপুর, চানখারপুলসহ আশপাশের এলাকা আবাসিক ভবনে গড়ে ওঠেছে ঝুকিপূর্ণ গুদামগুলো। এসব গুদাম ও কারখানার অধিকাংশেরই বৈধ কাগজপত্র ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমোদন নেই। গোডাউনের ৯৮ ভাগই অবৈধ। মাত্র দুই ভাগ গোডাউনের অনুমোদন আছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের তালিকা অনুযায়ী-সরকারিভাবে ১৩৭টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স আছে। বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যভুক্ত ১১শ’র বেশি ব্যবসায়ী আছে। বর্তমানে পুরান ঢাকায় অবৈধ গুদাম রয়েছে প্রায় ২৬ হাজারের মতো। প্রতিটির বাড়ির নিচে বেজমেন্টে বস্তার পর বস্তা, কন্টেইনারের স্তুপ দেখা যায়। কোনটি অতি দাহ্য পদার্থ আবার কোনটি কম দাহ্য পদার্থ। পুরাণ ঢাকার বাহিরে টঙ্গী, গাজীপুর, নরসিংদী ও চট্রগ্রামে রাসয়ানিক গুদাম আছে। অবৈধ পথেই কেমিক্যাল আসছে বেশি। তিনি আরও বলেন, গত শুক্রবার আরমানিটোলায় যে গুদামটিতে আগুন লেগেছিল সেটির কোন অনুমোদন ছিল না। আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি। রোববার গুদাম সরানো নিয়ে একটি মিটিং হওয়ার কথা রয়েছে। রাজনৈতিক কারণে আমাদের সিন্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করা যায় না।
পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা গতকাল বলেন, নিমতলির ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটি ১৭টি সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেয় সরকারের কাছে। সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হলে চকবাজারসহ অন্যান্য অগ্নিকান্ড এড়ানো যেত।
আরমানিটোলায় অগ্নিকান্ডের ঘটনার মামলা তদন্ত করার নির্দেশ
আরমানিটোলায় হাজী মুসা ম্যানশনে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় বংশাল থানায় দায়ের করা মামলাটি তদন্ত করে আগামী ১০ জুন প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। শনিবার মামলার এজাহার আদালতে পৌঁছালে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বেগম মাহমুদা আক্তার এজাহারটি গ্রহণ করেন। এরপর তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এ তারিখ নির্ধারণ করেন।
আদালতের সংশ্লিষ্ট থানার সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন (জিআরও) বলেন, মামলায় এজাহার নামীয় আট জন আসামি রয়েছেন। এছাড়াও অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১০/১৫ জন আসামি রয়েছেন। উল্লেখ্য, গত ২৩ এপ্রিল শুক্রবার ভোররাতে আরমানিটোলার হাজী মুসা ম্যানশনে ভবনে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিটের তিন ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুনে চারজনের মৃত্যু হয়। আগুনে দগ্ধ হন আরো ২৩জন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন